সায়ক ঘোষ চৌধুরী
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সাতটি নতুন জেলা গঠনের কথা ঘোষণা করেছেন। জেলাগুলো হল সুন্দরবন, ইছামতী, রানাঘাট, বিষ্ণুপুর, জঙ্গীপুর, বহরমপুর এবং বসিরহাট।
এমনিতে নতুন জেলার ঘোষণা নতুন কোনো প্রস্তাব নয়। প্রশাসনিকভাবে ছোট ছোট জেলা বানানোর কথা আগেও বিভিন্ন মিটিংয়ে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন। এতে কেন্দ্রীয় সরকারের টাকা আসার সুবিধা হয়, অন্যান্য কিছু প্রশাসনিক সুবিধাও হয়। নতুন জেলা সদর হয়, নতুন জেলাশাসক হন, পরিকাঠামোগত ব্যয়বরাদ্দ বাড়ে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মত একটি ঋণগ্রস্ত রাজ্য, যেখানে “কোষাগারে টাকা নেই” বলে মমতা দেবী প্রায়শই হাহাকার করেন এবং মন্ত্রীর ঘরে হিসাব বহির্ভূত কুবেরের ধন পাওয়া যায়, সেখানে নতুন জেলা তৈরির সুফল আদৌ মানুষের কাছে পৌঁছবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ জাগে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
তবে মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার সময়টি কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ। উনি খুব দ্রুত অনেক কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করে ‘উন্নয়নের বার্তা’ চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। মন্ত্রিসভায় রদবদল করছেন, বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
এসবের মূল লক্ষ্য, খবরের কাগজের হেডলাইন ম্যানেজ করে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ধরা পড়ার ঘটনাটিকে পিছনে ঠেলে দেওয়া। মুখ্যমন্ত্রী আসলে সংবাদমাধ্যম জুড়ে পার্থ-অর্পিতা চর্চা শুনতে রাজি নন। তাই নিত্যনতুন ঘোষণা করে সংবাদমাধ্যমের খবরের দখল নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইছেন। যে ঘোষণাগুলি করছেন, তাতে মানুষের কতটা লাভ হবে তা গৌণ। কারণ ঘোষণাগুলির উদ্দেশ্য তা নয়।
কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার যেমন কোনো ব্যাপারে প্যাঁচে পড়লেই শুরুতে মৌনতা অবলম্বন করে, তারপর বড় বড় কিছু ঘোষণা করে আলোচনার অভিমুখ পরিবর্তন করার চেষ্টা করে, একই প্রচেষ্টা মমতা দেবীর সরকারের মধ্যেও দেখা যায়।
শীঘ্রই দিল্লিতে মোদী-মমতা বৈঠক হওয়ার কথা। সেদিকে পার্থবাবুও তাকিয়ে আছেন। উনি ইতিমধ্যেই বলেছেন, ইডি অর্পিতা মুখার্জির ফ্ল্যাটে যে টাকা পেয়েছে তা তাঁর নয়। কিন্তু কার তা বলেননি। পার্থবাবু হয়ত মনে করছেন মোদীর সঙ্গে মমতা দেবী কথা বলার সুযোগ পেলেই আর ওঁকে টাকার উৎস জানাতে হবে না। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সংগঠন বিস্তারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেলেই তদন্তে ঢিলে দেওয়া হবে, পার্থবাবুও বেরিয়ে আসবেন ওঁর আগে অন্য মামলায় ধরা পড়া মদন মিত্র, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতোই। বরং পুরো অপরাধটা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হবে রাজনৈতিক গুরুত্বহীন অর্পিতার উপরে। ঠিক যেভাবে চিটফান্ড মামলায় অভিনেতা-সাংসদ তাপস পালকে ফাঁসিয়ে দিয়ে তৃণমূলের বৃহত্তর নেতা, মন্ত্রীদের বাঁচানো হয়েছিল। পার্থবাবু তেমন আশা করেই হয়ত টাকা তাঁর নয় বলে মুখ্যমন্ত্রীকে বার্তা দিচ্ছেন।
কুণাল ঘোষ যখন সারদা মামলায় ধরা পড়েছিলেন, তখনো একই কায়দায় মুখ্যমন্ত্রীর নামে নানা ইঙ্গিত করতেন। দেখা গেছে এমন ঘটলেই মমতা দেবী নানাভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। একদিকে দলের ছোটখাটো নেতা, সমর্থকদের ব্যবহার করে পাল্টা প্রচার শুরু করেন, নিজে নির্বাচনে বা রাস্তায় দেখে নেওয়ার হুমকি দেন, তৃণমূলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করেন। অন্যদিকে নিত্যনতুন প্রশাসনিক ঘোষণা করে সংবাদমাধ্যমের নজর ঘোরাতে চেষ্টা করেন।
শিক্ষা দপ্তরের এই বিরাট দুর্নীতি সামনে আসার পরেও একইরকম লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। কাজেই নতুন জেলার ঘোষণা বা মন্ত্রিসভার রদবদলকে দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করার আগে সময় নেওয়ার কৌশল ছাড়া অন্য কিছু ভাবলে ভুল হবে। আগেও দেখা গেছে, মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশাসন ও রাজনীতির মধ্যে বেছে নিতে হলে উনি রাজনীতিই বেছে নেন। এর দুটি কারণ – (১) নিজের প্রশাসন সম্পর্কে উনি আত্মবিশ্বাসী নন, (২) রাস্তায় নেমে লড়াই করার ব্যাপারে ওঁর অমিত আত্মবিশ্বাস। ফলে যখনই কোনো রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়, মমতা দেবী রাস্তায় নামার ছুতো খোঁজেন।
আরো পড়ুন উত্তরবঙ্গ: যেসব প্রশ্নের উত্তর কেউ চায় না, কেউ দেয় না
সম্ভবত বর্তমানে ওঁর লক্ষ্য পার্থবাবুকে এই সঙ্কট থেকে মুক্ত করা; ঠিক যেভাবে আগে কুণাল ঘোষ বা রাজীব কুমারদের মুক্ত করেছেন। সুদীপ্ত সেন-দেবযানী মুখোপাধ্যায়কে যেভাবে কারাগারে চিরনির্বাসন দেওয়া হয়েছে, যাতে সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ না খুলতে পারেন, সেইভাবেই হয়ত অর্পিতাও নির্বাসনে যাবেন। পার্থবাবুকে মুক্ত করা মমতা দেবীর রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা, নয়ত পার্থবাবু কী বলে ফেলবেন তার ঠিক নেই। যেমন কুণাল প্রিজন ভ্যানে উঠতে উঠতে চেঁচাতেন, সারদা মিডিয়ার সবথেকে বেশি সুবিধা যদি কেউ পেয়ে থাকেন, তিনি মমতা ব্যানার্জি। সেই কুণালই আজ জেলের বাইরে এবং তৃণমূলের অভিষেক শিবিরের প্রধান মুখপাত্র।
পার্থকে মুক্ত করতে পারলে মমতা দেবী আবার ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’ হিসাবে তাঁর মুন্সিয়ানা প্রমাণ করতে পারবেন। বদলে হয়ত ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির সুবিধা করে দেবেন ক্রমাগত কংগ্রেসবিরোধী মন্তব্য করে এবং আরএসএসের সংগঠন বিস্তারে সাহায্য করে, নতুন করে বিজেপির দল না ভাঙিয়ে।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।