সৌরভ চক্রবর্তী
শীতকাল। বাবার অফিসের কোনো এক পিকনিক। আমি খুব ছোট তখন। আলো ঝলমল সেই শীতের সকালে কোথা থেকে যেন ভেসে আসছিল একটা মন কেমনের সুর, মায়াবি কণ্ঠে। “এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না…”। কী কী খেয়েছিলাম, কোথায় সেই পিকনিকটা হয়েছিল, সেসব আজ আর মনে নেই। কিন্তু সেই গান আর সেই কণ্ঠ মনে নকশা এঁকে দিয়েছিল।
তার কিছু বছর পরে স্কুলের বাৎসরিক অনুষ্ঠান হচ্ছে, খুব সম্ভব ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন। মঞ্চে একদল ছাত্রী নৃত্যরতা। কানে ভেসে এল এক আবেদন মাখা রিনরিনে ঝঙ্কার “সবুজ পাহাড় ডাকে”। তখন এখনকার মত আমাদের সবজান্তা গুগল দাদা ছিলেন না, ছিলেন শুধু সিধু জ্যাঠা আর ফেলুদা। তাদের আবার নাগাল পাওয়াও ছিল মুশকিল। জানতে পারলাম না কার কণ্ঠে শুনছি সেই গান।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
এর অনেক পরে, তখন বারো ক্লাস, গানবাজনা শোনা তখন প্রায় ধর্মাচরণের মত। হাতে এল সলিল চৌধুরী সুরারোপিত চার ক্যাসেটের একটা অ্যালবাম – ‘চয়নিকা’ সিরিজের। সেখানে সব গানই আমার সেই বয়সে এক আশ্চর্য শ্রবণ অভিজ্ঞতা। তার মধ্যে একটি গান পেড়ে ফেলল আমাকে। রাতদিন শুনছি সেই গান। যেমন অদ্ভুত তার সুরের কাঠামো, তেমনি অনির্বচনীয় তার গায়ন, অনায়াস তার কণ্ঠ প্রক্ষেপন। সেই কণ্ঠ আবার ফিরে এল আমার কাছে। “এ মন মোর জানি না কোথা যে হারাল”। সত্যিই আমার মনকে সেই গান কিছু সময়ের জন্যে হলেও নিরুদ্দেশ করে দিত। সুরের জাদু এবং কণ্ঠের জাদুর এমন রাজযোটক হলে সেই গান সুখে সংসার করে আমাদের হৃদয়ে। অবশেষে জানতে পারলাম তাঁর নাম। নির্মলা মিশ্র।
এরপর এই হালে, বাঁশি বিষয়ক গান খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম এক হারানো রতন “আমায় বাঁশের বাঁশি দাও বাজাতে”। নচিকেতা ঘোষের অভাবনীয় সুরে নির্মলা মিশ্র গাইছেন আর আবিষ্ট করে রাখছেন আমার মত অজস্র শ্রোতাকে। এই আবেশ ঘোচার নয়। স্বর্ণযুগের শেষ উজ্জ্বল নক্ষত্রের মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু তাঁর গানের আলো আমাদের কানের ভিতর দিয়ে মর্মে ঝরে পড়ছে, আমরা সেই সুরধারায় স্নাত হচ্ছি প্রতিনিয়ত।
নির্মলা মিশ্র গানের কথা এবং সুরকে একজন দক্ষ কারিগরের মত নিটোল রূপ দিতে পারতেন। সঠিক সাঙ্গীতিক শিক্ষা এবং ভাল মনের মানুষ না হলে এইরকম গানের উদ্ভাস ঘটে না। তাই তাঁর সমস্ত গান এত প্রাণবন্ত, এত মনের কাছাকাছি। দুঃখের কথা, তিনি বোধহয় সেইসব শিল্পীদের গোত্রে পড়েন যাঁরা ভীষণ প্রতিভাবান এবং দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও জীবনকালে প্রাপ্য সম্মানটুকু পান না।
আরো পড়ুন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ : গতায়াতের ভুবন
ভীষণ হইহুল্লোড় করতে ভালবাসতেন। শেষ জীবনে আরেক প্রবাদপ্রতিম শিল্পী প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে থেকেছেন, তাঁকে অনুষ্ঠানে পর্যন্ত নিয়ে যেতেন গান গাওয়াতে। ভালবাসতেন পরের প্রজন্মের শিল্পীদের। খুব কম শিল্পীই বার্ধক্যেও নিজেদের কণ্ঠমাধুর্য ধরে রাখতে পেরেছেন। নির্মলা মিশ্র তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। বাংলা গানের সঙ্গে সঙ্গে ওড়িয়া চলচ্চিত্রে সমানভাবে জনপ্রিয় তাঁর গান। তাঁর গাওয়া বেশ কিছু ওড়িয়া গান ক্লাসিক গানের তকমা পেয়েছে। কিন্তু বাংলার উত্তর চব্বিশ পরগনায় জন্ম যাঁর, অসংখ্য বাঙালি সুরকারের সুরারোপিত গানে পুষ্ট যাঁর হৃদয়, মন, সেই মানুষ মৃত্যুর আগে নিশ্চিত গেয়ে উঠতে চেয়েছিলেন সেই গান যা আপামর বাঙালি ভুলতে পারবে না কোনোদিন – “এই বাংলার মাটিতে মাগো জন্ম আমায় দিও/এই আকাশ, নদী পাহাড় আমার বড় প্রিয়…”
নিবন্ধকার সঙ্গীতশিল্পী এবং সঙ্গীতশিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।