লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সাধারণত নিরুত্তাপ হয়। কারণ সেখানে সাধারণ ভোটার সরাসরি নিজের প্রতিনিধি নির্বাচন করেন না। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী ভোট দেন। সে পছন্দ তাঁদের যাঁরা ভোট দিয়েছেন তাঁদের পছন্দের সাথে মিলতেও পারে, না মিলতেও পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দিল্লিতে যে দল বা জোট ক্ষমতায় আছে তাদের সংখ্যার জোরের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফল আগে থেকেই বলে দেওয়া যায়।
তাহলেও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে প্রধানত তিনটে কারণে – ১) জয়ের ব্যবধান, ২) ভোটিংয়ের ধরন, যা ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবাহী হতে পারে আর ৩) বিরোধীদের প্রার্থী নির্বাচন।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
তৃতীয় কারণটা নিয়েই সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়ে থাকে। বিরোধীরা সর্বসম্মত প্রার্থী দিলে তা সাধারণত বিরোধী ঐক্য এবং একনিষ্ঠ বিরোধিতার লক্ষণ হিসাবে ধরা হয়। আজ দেশের রাজনৈতিক জগৎ দুটো পরিষ্কার মতাদর্শে ভাগ হয়ে গেছে। বিশেষ করে এরকম পরিস্থিতিতে বিরোধীদের প্রার্থী নির্বাচন আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এবারের মত নির্বাচনের ফলাফল যখন প্রায় নিশ্চিত থাকে, তখনই বিরোধীরা এই সুযোগটাকে রাজনৈতিক বিবৃতি দেওয়ার কাজে লাগিয়ে থাকে বরাবর। নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে দেয় প্রার্থী নির্বাচনের মাধ্যমে। এই কারণেই যশবন্ত সিনহাকে বিরোধী প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত চমকে দেওয়ার মত ছিল। বিজেপির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) কিন্তু এই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনটাকে ব্যবহার করল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলোকে বার্তা দেওয়ার মঞ্চ হিসাবে। তাই দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার সুযোগ দেওয়া হল। জয় নিশ্চিত জেনে তারা ভারতের ইতিহাসে আরও একটা ‘প্রথম’ ঘটনা ঘটাল। একইসঙ্গে বিরোধীদেরও প্যাঁচে ফেলল। তারা কি ভারতের প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতির পথের কাঁটা হবে?
বিরোধীদের সামনে দুটো মাত্র পথ খোলা ছিল – ১) দ্রৌপদীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি হতে দেওয়া, ২) এমন একজন প্রার্থী দেওয়া যার প্রার্থীপদ মতাদর্শগত লড়াইয়ের বার্তা দেয়।
এমন নয় যে বিরোধীরা সে চেষ্টা করেনি। তারা পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীকে অনুরোধ করেছিল। তিনি রাজি না হওয়ায় প্রবীণ রাজনীতিবিদ ফারুক আবদুল্লাহকেও অনুরোধ করা হয়েছিল। এই দুজনের যে কেউ প্রার্থী হলেই তা আদর্শগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠত। প্রথম জন জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর নাতি এবং একজন অরাজনৈতিক কিন্তু সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। দ্বিতীয় জন কাশ্মীরের মানুষের প্রতিনিধি। ফলে গোটা বিশ্বের কাছে একটা বার্তা দেওয়া যেত। কিন্তু দুজনের কেউই রাজি হননি। তারপর বিরোধীরা যশবন্তকে প্রার্থী করে। এঁর প্রার্থীপদ জাতীয় রাজনীতিতে তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জির গুরুত্বের চিহ্ন বলে প্রচারিত হল। মনে হল যেন বিরোধীরা মমতাকে সন্তুষ্ট করতেই তাঁর পছন্দের লোককে মেনে নিল। অথচ এর চেয়ে খারাপ সিদ্ধান্ত আর কিছু হতে পারত না। এই বাছাই একেবারেই অর্থহীন। একথা ঠিক যে যশবন্ত বর্তমান সরকারের একজন কঠোর সমালোচক। কিন্তু তার কারণ গুজরাট থেকে আসা নরেন্দ্র মোদী আর অমিত শাহের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত বৈরিতা, মোটেই মতাদর্শগত পার্থক্য নয়। বরং যশবন্ত প্রার্থী হওয়ায় নাগপুর ঘনিষ্ঠ ব্রাহ্মণের একজন আদিবাসীর পথ আটকে দাঁড়ানোর কথাই প্রথমে মাথায় আসতে বাধ্য। যা আরও সাদা চোখে দেখা যায়, তা হল যশবন্তের ছেলে জয়ন্ত মোদীর ক্যাবিনেট মন্ত্রী ছিলেন এবং এখনো অর্থ বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারপার্সন। এই লোকটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ হল গোরক্ষকরা জামিনে ছাড়া পেলে তাদের মালা পরিয়ে অভ্যর্থনা করা।
ফলে বিরোধী দলগুলোর তাবড় নেতারা মিলিতভাবে কী করে যশবন্তের মত একজনকে প্রার্থী হিসাবে মেনে নিলেন তা রহস্য হয়েই রয়ে গেল। কেন তাঁরা সুধা ভরদ্বাজের মত কারোর কথা ভেবে উঠতে পারলেন না? এই নেতারা কি সত্যিই ভেবেছিলেন মমতা এর প্রতিদান দেবেন? যদি ভেবে থাকেন, তাহলে বলতে হবে মমতা তাঁদের ভুল প্রমাণ করতে একেবারেই সময় নেননি। উপরাষ্ট্রপতি পদের জন্য ইউপিএ প্রার্থী মার্গারেট আলভাকে সমর্থন করার সময় আসতেই মমতার অবস্থান পরিষ্কার হয়ে গেছে।
রাষ্ট্রপতি পদে সর্বসম্মত বিরোধী প্রার্থী স্থির করায় মমতার মতই প্রতিষ্ঠিত হওয়া নিয়ে কয়েকদিন হইহই চলার পরই তিনি নিজের এবং নিজের দলের সঙ্গে যশবন্তের দূরত্ব রচনা করতে শুরু করেন। বস্তুত, প্রায় দ্রৌপদীকেই সমর্থন করে বসেন। মনে রাখা ভাল, মমতার এমন আচরণ এই প্রথম নয়। ২০১২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ফিরে গেলে দেখব, পূর্ণ সাংমা যখন প্রণব মুখার্জির বিপক্ষে প্রার্থী হয়েছিলেন তখন মমতা ছিলেন সাংমার প্রাথমিক সমর্থক। কিন্তু ভোটদানের ঠিক ৪৮ ঘন্টা আগে তিনি মত বদলে ফেলেন।
এবারের উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে মমতা কী করলেন? মনোনয়ন জমা দেওয়ার দিন যত এগিয়ে আসতে লাগল, পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের নাম সম্ভাব্য এনডিএ প্রার্থী হিসাবে শোনা যেতে লাগল। সেই ধনখড়, যাঁর সঙ্গে প্রায় রোজ রাজ্যের তৃণমূল সরকারের ঠোকাঠুকি চলে। সেই ধনখড়কে কি আর মমতা সমর্থন করতে পারেন? নিশ্চয়ই না। তবে তিনি ধনখড়ের পথ প্রশস্ত করে দিতে নিশ্চয়ই পারেন। এমন ভাবনার পিঠোপিঠিই প্রকাশিত হল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ধনখড় আর আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার সাক্ষাতের ছবি। ঠিক তারপরই, ২১ জুলাই, মমতার দল উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোটদানে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করল। এই সিদ্ধান্তের যে ব্যাখ্যা তারা দিয়েছে তাতে গোঁড়া তৃণমূল সমর্থকরাও বিশ্বাস করবেন কিনা সন্দেহ আছে।
আসলে এই সিদ্ধান্তে দুটো কাজ হাসিল হয়েছে। প্রথমত, দিল্লিকে বার্তা দেওয়া গেছে যে মমতা বিজেপির সাথে ‘কাজ’ করতে তৈরি। দ্বিতীয়ত, যদিও এটা অনুমান, কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোর নিশানা থেকে ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জিকে সরিয়ে নেওয়া। প্রসঙ্গত, ২১ জুলাইয়ের সভার দিনই দিল্লিতে ইডি সোনিয়া গান্ধীকে দীর্ঘক্ষণ জেরা করে। সমস্ত বিরোধী দল এর নিন্দা করলেও তৃণমূল কংগ্রেসের শহিদ দিবসের সভায় মমতা সেদিন তাঁর ভাষণে কিন্তু একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি। গতকাল দিল্লিতে কয়েক ঘন্টা কংগ্রেস দপ্তর ব্যারিকেড করে রাখা নিয়েও তিনি কিছু বলবেন না এটাই প্রত্যাশিত।
মমতা যেদিন দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন, সেদিন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার এক নম্বর লোক হিসাবে অভিষেক উঠে এসেছেন। আবার বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে তিনি এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের নজরেও আছেন। বস্তুত, তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের একটা বড় অংশ গরু পাচার, কয়লা পাচার থেকে শুরু করে এসএসসি নিয়োগ কাণ্ড পর্যন্ত নানা অভিযোগে তদন্তের আওতায় আছেন। পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির অনেকেরই অভিযোগ, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলো এবং কেন্দ্রীয় সরকার তৃণমূলের প্রতি নরম মনোভাব দেখাচ্ছে। রাজ্য বিজেপির রাস্তায় নামার জন্য একটা ইস্যুর খুবই প্রয়োজন ছিল। একটা কিছু দরকার ছিল যা নিরুৎসাহ ক্যাডারদের পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। এসএসসি কাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগে পার্থ চ্যাটার্জির গ্রেপ্তারি বঙ্গ বিজেপিকে সেই অক্সিজেন জুগিয়েছে। যেন চিত্রনাট্যের চাহিদা অনুযায়ীই মমতা এবং তাঁর দল নিজেদের পার্থ ও তাঁর কীর্তিকলাপের থেকে আলাদা করে নিয়েছে। তাঁকে ক্যাবিনেট এবং দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
এসএসসি নিয়োগ কেলেঙ্কারি অন্তত কয়েকশো কোটি টাকার দুর্নীতি বলে মনে করা হচ্ছে। ইডি তো ইতিমধ্যেই প্রায় ৫০ কোটি নগদ টাকা উদ্ধার করে ফেলেছে, সঙ্গে গয়নাগাঁটি এবং নথিপত্র। মমতা দাবি করেছেন তিনি কিছুই জানতেন না। একথা বিশ্বাস করা শক্ত, বিশেষ করে যেহেতু তিনি পুলিস এবং গোয়েন্দা বিভাগকে কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণ করেন। মমতা অনেকবার প্রকাশ্যেই গর্ব করে বলেছেন, তিনি নিজের সেনাপতিদের দৈনিক রুটিনের খুঁটিনাটি জানেন। তাহলে এখন জানি না বললে চলে কি? এখনকার বিশ্বস্ত সেনাপতি এবং তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ যখন সারদা মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তখনো অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন তিনি কিছু জানতেন না।
ইতিমধ্যে আরও একটি ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ডের তিন কংগ্রেস বিধায়ককে পশ্চিমবঙ্গ পুলিস নগদ প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা সমেত গ্রেপ্তার করে। তাঁরা দাবি করেছেন তাঁরা গৌহাটি ফিরছিলেন। আশ্চর্যের নয় যে উঠে আসে হিমন্তের নাম। এই মামলার দায়িত্ব নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি। সেই সিআইডি, যারা এত বছর ধরে এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতির গন্ধটুকুও পায়নি।
এই ঘটনাগুলো কি পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত?
এমনও শোনা যাচ্ছে, যে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলোর কাছে যত ফাইল পড়ে আছে, সেগুলো দিয়ে নাকি চাইলে রাজ্যের প্রায় অর্ধেক ক্যাবিনেটকে হাজতবাস করানো যায়। তবে তারা চাইবে না। কারণটা খুব সোজা। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সংগঠনের অবস্থা একেবারেই ভাল নয়। তাদের এমন কোনো নেতাও নেই যিনি গোটা রাজ্যের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং মমতার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারেন। এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি তাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার টালমাটাল হলে তা বামফ্রন্টের সুবিধা করে দিতে পারে।
আরো পড়ুন আরএসএসের পছন্দসই অগভীর বিরোধিতার মুখ শত্রুঘ্ন, বাবুল
আসলে এসবই দাবার এক লম্বা বাজির প্রথম কয়েকটা চাল। এন্ডগেমের অনেক দেরি। ততদিন বিজেপি যেমন তেমন করে সময় কাটাবে। হয়ত ২০২৪ সালে নতুন করে পশ্চিমবঙ্গে আক্রমণ শানানো হবে। তার আগে পর্যন্ত তৃণমূল নেত্রী মমতা আর তাঁর ভাইপোকে শক্ত মুঠোয় রাখা হবে আর মাঝেমধ্যে তাঁদের দিয়ে যা দরকার তা করিয়ে নেওয়া হবে।
~ মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।