২০১২ তখন। এপ্রিলের শেষ ভাগ। দেশজুড়ে চলছে আইপিএল-এর ‘ইনস্ট্যান্ট ক্রিকেট’। নয়া বিনোদনে চুর হয়ে আছে ভারতবাসী। টিভি-তে বিজ্ঞাপন-বিরতি। বিলম্বিত পদক্ষেপে কেউ-একজন পার হয়ে যাচ্ছেন এক বিশাল করিডর, পিছন থেকে ধরা হচ্ছে সেই ছন্দ। কাট। সোনালি অতীত। ভারতীয় সিনেমার প্রথম সুপারস্টার ও ’৭০-এর দশকের ক’টি ক্লিপ। সহসা ভাঙাচোরা কঙ্কালসার একজন। তাঁর মুখোমুখি ঘোষণা : বাবুমশাই, আমার ফ্যানেদের কেউ আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না! অন্তিমে ‘কাটি পতঙ্গ্’ ছবির “ইয়ে শাম মস্তানি…” গানটির সুরে সেই ব্র্যান্ডমার্ক মাথা-হেলানো।
একটি ফ্যানের বিজ্ঞাপন। মাত্র ৩৫ সেকেন্ড। আর এই ৩৫ সেকেন্ডেই তোলপাড় হতে শুরু করল গোটা দেশের পঞ্চাশোর্ধ-সমাজ।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
বিজ্ঞাপন শেষ। কখন যে উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি জানি না। অজান্তে চোখও আলতো ভিজেছে। কতদিন বাদে তাঁর পর্দায় সর্বসমক্ষ উপস্থিতি! অমন চার্মিং ওই মহাতারকার এ-হেন ম্লান মরণোন্মুখ দশা! এরই মধ্যে আমার দিদির ফোন এসে গেল। কান্নাভেজা উত্তেজনা। তাঁর শিখরকালের মস্ত ফ্যান।
আজ সবার বড় কৌতূহল। কী হয়েছে লোকটার? কোনও গভীর অসুখ? যাকে নিয়ে গত প্রায় তিন দশক কারও কোনও খোঁজ ছিল না, তাঁর সম্পর্কে এত্ত জিজ্ঞাসা! মাত্র ৩৫ সেকেন্ডেই বিস্মৃতি থেকে যেন এক ঝটকায় তিনি পৌঁছে গেলেন চার দশক আগে— সত্তরের গোড়ায়। যখন তাঁর সাদা ইম্পালা গাড়িটার সর্বাঙ্গ ভরে যেত অনুরাগিনীদের চুম্বন-স্বাক্ষরে। তাঁর আচমকা বিয়ের খবরে সারা দেশে স্বঘাতিনী হয়েছিলেন সংখ্যায় পৌনে-একশো’র মতো কন্যে।
রাজেশ খান্না এর ঠিক পৌনে-তিন মাস বাদে মারা যাবেন। ১৮ জুলাই, ২০১২। ক্যান্সারের চিকিৎসায় বিজ্ঞান এখন আরোগ্যের ঠিকানা পুরোপুরি দিতে না-পারলেও বেঁচে থাকার সীমানা-টা নিখুঁত বলে দিচ্ছে। অর্থাৎ তিনি মোক্ষম জানতেন তাঁর আয়ুষ্কাল। ভঙ্গুর স্বাস্থ্যে, শেষ অবস্থা জেনেও জীবনের প্রথম এবং একমাত্র অ্যাডফিল্মে কাজ করার চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ সিধে দাঁড়িয়ে থাকাটাও তাঁর পক্ষে তখন দুষ্কর। দিন-কে-দিন অবনতি। আসন্ন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সারা দেশে একটা ঝাঁকুনি দিতে চেয়েছিলেন যেন!
সালটা ১৯৬৫। সিনেমা-প্রযোজকদের সংগঠন ‘ইউনাইটেড প্রোডিউসারস্’ ও ‘ফিল্মফেয়ার’ পত্রিকার যৌথ উদ্যোগে নতুন মুখের খোঁজে এক কনটেস্ট হয়েছিল। সেই পরীক্ষায় দশ হাজারেরও বেশি প্রতিযোগীর মধ্যে রাজেশ খান্না (এবং মেয়েদের মধ্যে ফরিদা জালাল) ছিলেন সর্বশীর্ষে। শর্ত অনুযায়ী ওই প্রযোজকেরা মোট পাঁচটি ফিল্মে সুযোগ দেবেন। প্রথম ছবি ছিল চেতন আনন্দ্-এর ‘আখরি খত’। তারপর জি. পি. সিপ্পি-র ব্যানারে ‘রাজ’। এমনি করেই এসেছিল ব্লকবাস্টার ‘আরাধনা’। মঞ্চ থেকে আসা এই প্রতিযোগীকে বিচারকেরা যখন একটি সংলাপ দিয়ে বলেছিলেন বলতে, কাকা-র (ডাকনাম) পাল্টা প্রশ্ন ছিল, “চরিত্রটা কেমন— গ্রাম্য না শহুরে; গরিব, সচ্ছল না বড়লোক; নিরক্ষর নাকি শিক্ষিত?” ইত্যাদি, ইত্যাদি। “এ-সব না-জেনে সংলাপটা বলি কী ভাবে!” বিচারকেরা শুধোলেন : তুমি নাটক থেকে এসেছ, না?

মৃত্যুর দোরগোড়াতেও সেই দীর্ঘ সংলাপটি ছিল তাঁর আগাগোড়া মুখস্থ। ফ্যান কোম্পানির অ্যাডফিল্মটির পরিচালক বাল্কি (ফিল্মমেকার আর. বালকৃষ্ণন) তাঁর সঙ্গে কাজ করে অভিভূত! “হি ইজ সো শার্প! সিনেমার গ্রামার ১০০% তাঁর আয়ত্তে।” ভারতীয় সিনেমার প্রথম সুপারস্টারের ‘ফেনোমেনাল সেন্স অব হিউমার’-এর কথাও বলেছেন বাল্কি। তার আক্ষেপ— কেন লোকটাকে নিয়ে আগে কাজ করিনি! মৃত্যুর দিকে আগুয়ান মহাতারকার একটাই নাকি কাতর আবেদন ছিল বাল্কিদের কাছে— একটু দেখো, পর্দায় আমায় দেখতে যেন ভালো লাগে!

একটানা সতেরোটি (একক নায়কত্বে পনেরো) সিনেমা হিট! আজও অম্লান সে-রেকর্ড। ষাটের শেষ থেকে সেই অভিযান। মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত ঘরের ছেলে— যে ভালো করে, ভালো ভাবে। আমাদেরই ঘরের বা পাশের ঘরের ছেলে। যে হিংসা এড়াতে চায়। চায় ভালবাসার ফুল ফোটাতে। সেই ফুলের কাঁটাতেই আবার রক্তাক্ত, বিক্ষত হয়ে পড়ে। পেয়েও হারায়। হার-ই যেন তার কাঙ্ক্ষিত। এমন নায়ককে তখন বরণ করে নিয়ছিল গোটা দেশ। তখন সমাজ অস্থির, দিশাহীন। ঘরে-ঘরে বেকার। পাস-করা ইঞ্জিনিয়ররা পর্যন্ত চাকুরি পাচ্ছে না। চালগম, কেরোসিন, বেবিফুডের অমিল। গ্রামে জোতদারদের দাপট। দেশের বিস্তীর্ণ অংশে সামন্তরাজ। তরুণ সমাজের হাতে উঠে এসেছে অস্ত্র। একাত্তরের যুদ্ধ। বাংলাদেশের অভ্যুদয়। সব মিলিয়ে খুব এক অস্হির, বড় রক্তাক্ত সময় সেটা। রাতে যুদ্ধের ব্ল্যাকআউট অথবা সহিংস রাজনীতির মোকাবিলায় সিআরপি-র টহল। বা পুলিশের কুম্বিং অপারেশন। এমন প্রহরেই তো দু-দণ্ড শান্তি দিতে পারে নিহত গোলাপ, টুকরো প্রেম কিংবা বিক্ষিপ্ত চুম্বন! রাজেশ খান্নার বিজয়-অভিযান ঠিক এই সময়কালেই।
এই স্টারডম, এই ফ্যানডম আজতক ইন্ডাস্ট্রি দেখেনি। মানুষ পাগলপারা। মেয়েরা তাঁর ছবির সঙ্গে মালাবদল করে মাথায় সিঁদুর পরে নিচ্ছে, বয়স্ক মহিলারা তাঁকে নিজের ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছেন। তাঁর স্টাইল স্টেটমেন্ট— কলারওয়ালা পাঞ্জাবিকে সারা ভারতের যুব সমাজ আপন করে নিয়েছে। এর নাম হয়ে গেছে ‘গুরু পাঞ্জাবি’। গোটা দেশে নব কংগ্রেসের যুব বাহিনীর কাছে এই পাঞ্জাবির খদ্দর সংস্করণ হয়ে গেল ইউনিফর্মের মতন।

গোড়ার দিকে অভিনয়ে মঞ্চের প্রভাব থাকলেও ক্রমে তা কাটিয়ে উঠে নিজস্ব অভিনয়রীতি তৈরি করে নিয়েছিলেন। তাতে পূর্বসূরিদের প্রভাব ছিল, বিশেষ করে দেব আনন্দের তো বটেই। দুর্দান্ত ক্যামেরা সেন্স, ক্লোজ-আপে চমৎকারিত্ব, সংলাপ নিক্ষেপের কুশলী প্রয়োগ, সঙ্গে কিছু নিজস্ব মুদ্রা বা ম্যানারিজম— সব মিলিয়ে দর্শককুল মাত! শিল্পী, চাকুরে, রোগাক্রান্ত, বেকার, বিলাসী, ভাগ্যহত— বিভিন্ন শেডের চরিত্রে সফল অভিনয়। মনে করুন ‘বাওয়র্চি’। কেন্দ্রীয় চরিত্র। তাঁর একদিকে আইপিটিএ-র সব বাঘা অভিনেতা— হারিন চ্যাটার্জি, এ. কে. হাঙ্গল, কালী ব্যানার্জি, দুর্গা খোটে; অন্য দিকে পুনা ফিল্ম ইন্সটিটিউটের একঝাঁক— জয়া ভাদুড়ী, আসরানি, পেন্টাল। এই সমাহারের মধ্যে নিজের সেরা-টা বের করে এনেছেন। ‘বাওয়ার্চি’র সঙ্গে ‘গল্প হলেও সত্যি’ কিংবা ‘অমর প্রেম’-এর সঙ্গে ‘নিশিপদ্ম’-র তুলনা টানা বৃথা। বম্বের ভার্সনে গ্র্যাঞ্জার থাকবেই। আবার দুই ভার্সনের পরিচালক অভিন্ন হলেও কিছু বলার থাকে না, যেমন রাজেশ খান্নার ক্ষেত্রে অসিত সেনের ‘সফর’ (চলাচল) এবং ‘খামোশি’ (দীপ জ্বেলে যাই)। সত্তরের শুরুতে তখন একটু ‘অন্য কিছু’র জন্যে দর্শক ছটফট করছে। ‘ভুবন সোম’ এই তেষ্টা-টা অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়ে গেছে। ’৭৩-এ ‘গরম হাওয়া’। এই আবহে ’৭৪-এ এল বাসু ভট্টাচার্যের ‘আবিষ্কার’, রাজেশ-শর্মিলা জুটির। মনে পড়ে বেশ হইচই। কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা সব দল বেঁধে দেখতে যাচ্ছেন। দৈনন্দিন দাম্পত্যের রূপকথা। পরবর্তী কালে যাঁরা ‘মুভি মুঘল’ হয়েছেন, যেমন যশ চোপড়া বা মনমোহন দেশাই— এঁদের বিজয়যাত্রার শুরুটা রাজেশ খান্নার হাত ধরেই। দেশাই-এর ‘সাচ্চা ঝুটা’ (১৯৭০) ব্লকবাস্টার। যশ চোপড়া-পরিচালিত ‘ইত্তেফাক’ (১৯৬৯) ছিল বাণিজ্যসফল। (উল্লেখ্য, মিঠুন চক্রবর্তী কিন্তু আজও ভোলেননি এই ছবিতে কাকার অভিনয়)। যশ চোপড়ার নিজস্ব প্রোডাকশন হাউস ‘যশ রাজ ফিল্মস্’-এর প্রথম ফসল ছিল ‘দাগ : আ পোয়েম অব লাভ’। দুই বাঙালি নায়িকা, শর্মিলা-রাখী’কে নিয়ে রাজেশ খান্নার সেই প্রেমগাথা! সুপারডুপার হিট। বম্বেতে রাস্তার এপার-ওপারে দু’টি হল্-এ দাগ চলছে! দু’ পারেই প্রতিটা শো হাউসফুল! যশজি-র হাউসের প্রথম প্রোডাকশন— শোনা যায় কাকা তাঁর পারিশ্রমিকের অনেকটাই নেননি।

অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে ওনার তুলনা করাটা ভুল। দু’জনে সাকুল্যে কাজ করেছেন সওয়া-দু’খানি ছবিতে। এই সওয়া বা সিকি অংশটা হচ্ছে ‘বাওয়র্চি’র ভাষ্যপাঠ, অমিতাভের কণ্ঠে। তখনও অমিতাভ ঠিক নায়ক হয়ে ওঠেননি, তার স্টারডম তৈরি হয়নি। কাকা কিন্তু তখন অবিসংবাদী নায়ক।

রাজেশ খান্নার নায়িকাদের প্রসঙ্গে আসা যাক। তাঁর প্রথম নায়িকা বাঙালি, ইন্দ্রাণী মুখার্জি, ‘আখরি খত’ ছবিতে। আশা পারেখ-নন্দা, ওয়াহিদা রহমান-মালা সিনহা, শর্মিলা ঠাকুর-মমতাজ, হেমা মালিনী-জিনাত আমন, রাখী-রেখা, শ্রীদেবী-জয়াপ্রদা, শাবানা আজমি-স্মিতা পাতিল এবং আরও অনেকেই— লম্বা সে-তালিকা। সবচেয়ে সফল জুটি ছিল শর্মিলা ঠাকুর ও মমতাজের সঙ্গে। আশ্চর্য রসায়ন! এক দিকে সত্যজিৎ রায়ের নায়িকা সংবেদী শর্মিলা; অন্য দিকে প্রয়োজনীয় অভিনেত্রী মমতাজ, এক্সট্রা থেকে ক্রমান্বয়ে হওয়া নায়িকা। দু’জনের সঙ্গে কাকার অভিনয়ের সুর কিন্তু আলাদা। আবার, শাবানা আজমির সঙ্গে তাঁর জুটিও বেশ সফল। প্রত্যেকেই কিন্তু কাকার সম্পর্কে আজও উচ্ছ্বসিত। শর্মিলা ঠাকুর বলে থাকেন : ওয়ান্ডারফুল অ্যাক্টর। এমনটি কেউ ছিলেন না, কেউ হবেনও না। রাখী গুলজার তাঁকে বলেছেন ইন্ডাস্ট্রি-র সাত আশ্চর্যের অন্যতম। তাঁকে নিয়ে শাবানা আজমির আজও মুগ্ধতা। তো, শর্মিলার সঙ্গে জুটিটা শেষমেশ টিকল না। অন্তত তিন ঘন্টা দেরি করে সেটে আসতেন কাকা। শর্মিলার সংসার আছে, ঘরে বাচ্চারা। ঘড়ি ধরে কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরায় নিশ্চিন্তি। কাকার জ্বালায় পরের শিফ্টেও টানতে হত। বাড়ি ফিরতে মধ্যরাত— সাংসারিক যন্ত্রণা। পরিণামে কাকার সঙ্গে কাজ করাটাই বন্ধ করলেন। অভিনয়ে দু’জনের টক্করবাজিটা দেখার বটে! তবে রাখী গুলজার কিঞ্চিৎ সদয়— “আমাদের তো সাজগোজ, মেকআপ করতেই ঘণ্টা দু’-তিনেক লাগত। ও অত আগে এসে করবেটা কী? তা ছাড়া, ও তো তেমন মেকআপ নিত-ই না।”

১৯৭৪-’৭৫। দেশজুড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের আকাল, দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত, মানুষের ক্রমবর্ধমান যন্ত্রণা। দিকে-দিকে বিক্ষোভ। রেল ধর্মঘট। হাতের গোলাপকে তখন ছুড়ে ফেলে দেওয়ার সময়। অ্যাংরি ইয়ং ম্যানের উত্থান ঠিক এই মুহূর্তেই। কাকা নিজের দিকে ফিরে তাকালেন না, আমাদের রোজকার জীবনে যে-নতুন মাত্রা যোগ হয়ে চলেছে সে-সব বোঝার চেষ্টা করলেন না, পড়ে রইলেন সেই ভালোবাসার নিজস্ব জগতে, সময়টা হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, সেটা দেখেও নিজেকে পাল্টাতে পারলেন না। একই ধরণের চরিত্রে অভিনয় তাঁর ফ্যানেদের কাছেও হয়ে উঠল ক্লান্তিকর, তা যেন নিজেরই অতীত গৌরবের ম্যানারিজমে ভরা করুণ অনুকৃতি! তবে অন্য কারণও যে নেই তা নয়। ইতোমধ্যে সেলিম-জাভেদ জুটি রাজেশ খান্নার ছবিতে চিত্রনাট্য লেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। ততদিনে অপরাধ-জগতের অর্থ ভালো ভাবে ঢুকে পড়েছে ইন্ডাস্ট্রিতে, তারাই শাসন করতে শুরু করেছে ফিল্মি সাম্রাজ্য, তাদের সঙ্গে বোঝাপড়াটা কাকা করেননি বা করতে চাননি। সব মিলিয়ে কেরিয়ারে তখন ভাটার টান। ছবি করে যাচ্ছেন কিন্তু ঠিক লাগসই হচ্ছে না। আবার এরই মাঝে নায়কোচিত দ্যুতির বাইরে অন্য ধরণের চরিত্রে যে যাননি, তা-ও নয়। যেমন ‘পলকোঁ কি ছাওঁ মেঁ’ (১৯৭৭) একটু আলাদা রকম ছবি। অভিনয়টা করলেনও দুর্দান্ত। কিন্তু ও-ই, বাজারে লাগল না, জনতা নিল না। (অনেক পরে, ২০০৮-এ শ্যাম বেনেগাল এর রূপান্তর ঘটান ‘ওয়েলকাম টু সজ্জনপুর’-এ)। হিচককের সেই ‘দ্য থার্টি নাইন স্টেপস্’-এর প্রভাবে বাসু চ্যাটার্জি বানালেন ‘চক্রব্যূহ’ (১৯৭৮)। উচ্ছ্বসিত পরিচালক বলেছিলেন : যে-ভাবে কাকা ওর ভূমিকা ফুটিয়ে তুলেছে, তা চমৎকার। এ-ফিল্ম ফ্লপ হলে দায়িত্ব আমার। আমি যা চাই, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই কাকা তা করে দেখিয়েছে। অন্য যে-কেউ আমার চাহিদামতো পারফর্ম করতে গেলে কম-সে-কম আট ঘণ্টা লাগিয়ে দিত। কিন্তু ছবি ফ্লপ করল। (বাসুবাবুর পরের ছবি ছিল ‘মঞ্জিল’, অমিতাভ বচ্চনকে নিয়ে, মৃণাল সেনের ‘আকাশ কসুম’-এর রূপান্তর। সেটিও ফ্লপ করেছিল। প্রসঙ্গান্তর, তবু বলছি, দু’টি ছবিতে নায়ক পাল্টাপাল্টি করে দিলে বোধহয় দু’টোই বাণিজ্যসফল হত)। হৃষীকেশ মুখার্জি তৈরি করলেন ‘নৌকরি’ (১৯৭৮), রাজেশ খান্নাকে নিয়ে শেষ কাজ তাঁর, কাকার সঙ্গে রাজ কাপুুর, রসিকজনের প্রশংসা পেলেও চূড়ান্ত এক ফ্লপ। লাজুক প্রকৃতির সুভদ্র, অন্তর্মুখী এই চরিত্র নিজেকে, নিজস্ব মানুষজনকে নিয়েই থাকতে চেয়েছেন, প্রায়শই ভুল বোঝা হয়েছে তাঁকে। অন্যদের নিয়ে চর্চা বা অন্তরালে থেকে ইন্ডাস্ট্রিতে কলকাঠি নাড়ানো— এ-সবের বাইরেই থাকতেন। কেবল ‘অনুরোধ’ (‘দেয়া নেয়া’-র রূপান্তর) করতে গিয়ে জোরজার করে নিজের শ্যালিকাকে নায়িকা বানিয়েছিলেন। এ-নিয়ে শক্তি সামন্ত আক্ষেপ করে গেছেন যে, ঠিকঠাক নায়িকা পেলে এ-ছবি ব্লকবাস্টার হত-ই হত। নিজের হাতেগোনা ক’জন বন্ধুবান্ধব— তাঁদের সঙ্গ ছিল বিশেষ পছন্দের— রাহুল দেববর্মণ, কিশোরকুমার, আনন্দ্ বকশী প্রমুখ। মোটামুটি আশির দশকের শেষ অবধি ছবি করে গেছেন, বেশ কিছু ছবি চলেওছে, কিন্তু আলোচনায় তিনি আসেননি। ফিল্মি জগতের কেন্দ্রস্থল থেকে নড়ে গিয়েছিলেন। কোনও সমারোহে, চর্চায় তাঁকে বিশেষ ডাকাও হত না। এর পিছনে অন্য কিছু কি ছিল? ১৯৯১-য়ে রাজনীতিতে এলেন— লোকসভা নির্বাচনে নয়া দিল্লি কেন্দ্রে তিনি কংগ্রেস প্রার্থী। লালকৃষ্ণ আদবানির বিরুদ্ধে। অল্প কিছু ভোটে পরাজিত হলেন। আাদবানিজি গান্ধিনগর কেন্দ্রটি রেখে নয়া দিল্লি ছেড়ে দিলেন। ফলে উপনির্বাচন। আবার দাঁড়ালেন। বিজেপি-র প্রতিপক্ষ তাঁরই ফিল্মি সতীর্থ শত্রুঘ্ন সিনহা। তবে এ-বার জয় হাসিল করলেন। ওই একটা টার্মেরই এমপি। এরপর, থাকে শুধু অন্ধকার। ক্রমে সমস্ত খবরের বাইরে। কিশোরকুমার আগেই গেছেন, পঞ্চমও চলে গেলেন। আরও একা হলেন। নিজের পরিবার তো বটেই, বোধহয় গোটা পৃথিবী থেকেই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছেন। শক্তি সামন্তের মতো কিছু শুভানুধ্যায়ী কাকার এই পরিণতি মেনে নিতে পারেননি। রাজেশ খান্নাকে নিয়ে একটি কথাও শেষ দিকে বলতেন না, বিশেষ অনুরোধেও না। মৃত্যুর মাসপাঁচেক আগে শীর্ণ দেহে এক সম্মান-সমারোহে কাকা বললেন — এখানে যশ চোপড়া আছেন, তাঁর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ; আছেন রমেশ সিপ্পি, তাঁর প্রতি-ও, কারণ ওনার বাবা জি. পি. সিপ্পি-কে আমি আমার ‘অন্নদাতা’ মনে করি, কেন-না উনিই আমায় প্রথম ব্রেক-টা দিয়েছিলেন ‘রাজ’ ছবিতে। মুম্বইয়ের পুরোপুরি প্রফেশনাল ও আত্মপর ফিল্মি জগতে এ-হেন ‘সৃষ্টিছাড়া’ কথাটা বলে গেলেন!

রাজেশ খান্নাকে নিয়ে বলতে গেলে যে-কথাটা আসবেই, তা হল গানের সঙ্গে তাঁর সংযোগ। এর আগে দিলীপকুমার, দেব আনন্দ্, রাজ কাপুরের (কাপুরদের সকলেরই) প্রখর মিউজিকাল সেন্স আমরা দেখেছি। সেইসঙ্গে অশোককুমার বা ভরতভূষণের। কিন্তু গানের সঙ্গে এমন একাত্ম হয়ে লিপ দেওয়া বিরল, অবশ্য কাকার ক্ষেত্রে লিপ কথাটা আসবে না কারণ সিনেমায় রাজেশ খান্না গানকে শুধু উপস্থাপন নয়, স্হাপন করে গেছেন। এমন বহু গান অমর, অক্ষয় হয়ে থাকবে। কাকার সোনালি সময়ে এক শিল্পী-চতুষ্টয় তৈরি হয়েছিল— আনন্দ্ বকশী, রাহুল দেববর্মণ, কিশোরকুমার ও রাজেশ খান্না। এ-ছাড়াও অন্যান্য কম্পোজার বা গায়কেও তিনি ছিলেন সমান মনোযোগী, সমান নিবেদিত। লিপ দেওয়া অভিনয়ের একটা অংশ মাত্র! এ-ছাড়া, গানের মেজাজকে ফুটিয়ে তোলা, তার ভাব-কে গানে উত্তীর্ণ করার দায়িত্ব-ও তো অভিনেতারই! ‘কুদরত’ (১৯৮১)-এর “হামেঁ তুমসে প্যার কিতনা…”-র মতো ঢিমে লয়ের গান অন্য কোনও অভিনেতা নিতেন কিনা সন্দেহ। কাকা কিন্তু সেই গানকেই চিরন্তন করে দিয়েছেন। কিংবা ‘অনুরোধ’-এ “আতে যাতে খুবসুরত…”-এ মাইক্রোফোনের সামনে, ফ্রেমের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মুভমেন্ট হবে না। সেই সীমানার মধ্যেই এই গানে রামধনু আঁকলেন! অজস্র উদাহরণ। যেমন, ‘পলকোঁ কি ছাওঁ মেঁ’-র “ডাকিয়া ডাক লায়া…”। ডাকপিওনের ভূমিকায় কাউকে চিঠির লেখা পড়ে শোনাতে হচ্ছে, কারও জন্যে খোশখবর, কারও বা বিষাদ, সবই চলছে গানের মধ্যে, কিশোরকুমারের কণ্ঠে চিঠির পাঠ ইত্যাদি সবই হয়ে চলেছে— আলাদা এক মজা, যা কেবল কিশোরকুমারের পক্ষেই সম্ভব ছিল— সেই গান পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে গেলেও প্রতি মুহূর্তে ইম্প্রোভাইজেশান ও সাংগীতিক বোধের দরকার পড়ে। অভিনয়ের শিক্ষার্থীদের, এ-সব ফুটেজ থেকে অনেক কিছু শেখার থাকে। রাজেশ খান্না শত ব্যস্ততার মধ্যেও সংগীত-পরিচালকদের সঙ্গে স্কোরিং রুমে বসে সুর শুনতেন, মতামত দিতেন, কী করলে পর্দায় সে-সব গান উতরোবে, তা নিয়ে তিনি ছিলেন রীতিমতো সিরিয়াস। বাওয়র্চি-তে একটি গানের সঙ্গে বাঁশি বাজাচ্ছেন— একেবারে ন্যাচারাল অভিব্যক্তি— ক্লোজআপেও ত্রুটিহীন। মেহবুবা-য় গিটারে স্ট্রামিং হচ্ছে, ওঁর আঙ্গুলগুলোও পড়ছে নিখুঁত। আরও মনে পড়ছে, দাগ-এ সেই গান— “জব ভি জী চাহে নয়ি দুনিয়া…”— লতা মঙ্গেশকরের গানটিতে শর্মিলা-রাজেশ জুটির অবিস্মরণীয় চিত্রায়ণ। পরিত্যক্ত এক দয়িতার হাহাকার, সেইসঙ্গে নায়কের অনুতাপ-জড়ানো আপাত-নিষ্ক্রিয়তা। রাতের অন্ধকারে নীলচে আলোর মাখামাখি। ভগ্নপ্রেমের কান্না-জড়ানো এমন হাড়-হিম-করা গানের সিক্যুয়েন্স বাণিজ্যিক সিনেমায় মনে হয় বিরলতম।

মান্না দে-র সংগীত-জীবনের মস্ত এক ট্র্যাজেডি এ-ই যে, তিনি নায়ক পাননি। যতটা সম্মান তাঁর প্রাপ্য ছিল তা তিনি পাননি প্রধানত এই কারণেই। যেমন, কিশোরকুমার মানেই দেব আনন্দ্ কিংবা রাজেশ খান্না, মহম্মদ রফি মানে দিলীপকুমার অথবা শাম্মি কাপুর আর মুকেশ মানে রাজ কাপুর বা মনোজকুমার। বহু জবরদস্ত্ গান গাইলেও মান্না দে ছিলেন এমত পরিচিতির বাইরে। কিন্তু তাঁকে কিছুটা হলেও সেই পরিচিতি দিয়েছিলেন একমাত্র রাজেশ খান্না। আনন্দ্, বাওয়র্চি, আবিষ্কার, মেহবুবা প্রভৃতি ছবিতে জনপ্রিয় অথচ দুরূহ সব গানে দু’জনের কী অসামান্য যুগলবন্দি! রাজেশ খান্নার মৃত্যুতে মান্না দে বলেছিলেন : ওনার হয়ে গান করতে পেরে আমি নিজেকে সম্মানিত বোধ করি। ওঁর মতো অভিনেতা বিরল। আমাদের প্রতিটা গানই হিট হয়েছিল। ফিল্মে কোনও গানের সাফল্য নির্ভর করে অভিনেতার চিত্রায়ণের ওপর। গানের চিত্রায়ণে উনিই সেরা। আমি ওনার কাছে চিরঋণী।

ইন্ডাস্ট্রিতে বাঙালি পরিমণ্ডলেই উনি লালিত হয়েছেন সন্দেহ নেই। শক্তি সামন্ত, হৃষীকেশ মুখার্জি, অসিত সেন, দুলাল গুহ, শচীন ভৌমিক, অশোককুমার, কিশোরকুমার প্রমুখ এবং দেববর্মণ পরিবার। কলকাতা তাঁকে টানত। বিএফজেএ-র অনুষ্ঠানে বেশ ক’বার এসেছেন। উত্তমকুমার আর উনি, একে অপরের গুণগ্রাহী। হাওড়া ব্রিজকে দৃশ্যমান রেখে দু’টি চিরন্তন গানে তাঁর স্মরণীয় চিত্রায়ণ— ‘উয়োহ্ শাম কুছ আজিব থি…’ (খামোশি) এবং ‘চিংগারি…’ (অমর প্রেম)। ধুতি-পাঞ্জাবিতেও বেশ মানিয়ে যেত, বাঙালিই মনে হত। অনেক ছবিতেই এই পরিচ্ছদে তাঁকে দেখা গেছে।

‘অমর প্রেম’-এর ‘চিংগারি…’ গানটির শেষ স্তবকে আনন্দ্ বকশী লিখেছিলেন—
‘মাঝধার মেঁ নইয়া ডোলে, তো মাঝি পার লগায়ে মাঝি জো নাও ডুবোয়ে, উসে কৌন বচায়ে...’
মাঝদরিয়ায় যখন নৌকা দোলে, মাঝি পাড়ে এনে নোঙর করে,
কিন্তু মাঝি নিজেই যখন নৌকা ডোবায়, তখন সে-নৌকাকে কে বাঁচায়!
রাজেশ খান্না নিজের নৌকা নিজেই ডুবিয়েছেন।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
প্রিয় পাঠক,
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
রেজিস্টার করুন আমাদের ওয়েবসাইটে
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
রাজেশ খান্নাকে নিয়ে বিশদে এত গুণগ্রাহী রচনা, রাজেশ খান্নার বিরল অমর অভিনয় শিল্পকর্মর মতই বিরল।লেখাটি রাজকাপুর-দেবানন্দ পরবর্তী ও অমিতাভ-বিনোদ খান্না যুগের পূর্ববর্তী সময়ের হিন্দী সিনেমার জগতের ঘটনা প্রবাহের ইতিহাসের এক সুন্দর দলিল।
প্রবীর শ্রীমানী।
অতুলনীয় লেখা।অনেক ধন্যবাদ আমার প্রিয় নায়ককে নিয়ে এই অনবদ্য তথ্যসমৃদ্ধ লেখার জন্য।