নির্বাচনী জ্বরে আক্রান্ত পশ্চিমবঙ্গ। চলছে ভিডিও নিয়ে উত্তেজনা, সুপ্রিম কোর্টে এসএসসি মামলা নিয়ে উদ্বেগ, প্রতি সন্ধ্যায় জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেলে বিতর্কের নামে চিৎকৃত কোলাহল। এরই মাঝে পঁচিশে বৈশাখ। এই সার্বিক ক্যাকোফোনিতে কী হবে পঁচিশে বৈশাখের? পঁচিশে বৈশাখ কি নাক গলাবে নির্বাচনী উত্তাপে? নাকি নির্বাচনী জ্বরাক্রান্তরা একটু জলপট্টি নিয়ে নেবেন রবীন্দ্রগানে একটা দিন? হতেই পারে। ‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই, মরতে হবে’ গেয়ে ভোটের দিন বুথে বুথে প্রতিরোধের আহ্বান যেতে পারে। কিংবা নীল-সাদা উত্তরীয় গায়ে দিয়ে প্রভাত ফেরি হতে পারে ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি, তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী’ গেয়ে। গেরুয়া রঙের উচ্চারণে ‘ওরে নূতন যুগের ভোরে’ শোনা তো হয়েই গেছে আমাদের।
রসিকতা ছেড়ে প্রশ্ন তোলাই যায়, বৃহৎ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান যেমন তাদের পণ্যের বিক্রয়যোগ্যতা বাড়াতে মোহময়ী বিজ্ঞাপন দিতে রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা গান থেকে উদ্ধৃতি দেয়, রাজনৈতিক দলগুলিও কি নির্বাচনের মরশুমে তেমনই ‘পিক অ্যান্ড চুজ’ পদ্ধতিতে পঁচিশে বৈশাখ আর তাদের নির্বাচনী প্রচারকে সাজাবে? কিংবা প্রার্থীকে নিয়ে রাবীন্দ্রিক পদযাত্রা, রবীন্দ্রমূর্তিতে মাল্যদান বা সারাদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজিয়ে ভোটের প্রচার? এই যে সাংস্কৃতিক উপলক্ষ বা প্রতীকের অগভীর ব্যবহার – এটা সাধারণত দক্ষিণপন্থী দলগুলির মধ্যে যাদের উদার দক্ষিণপন্থী (যদিও দক্ষিণপন্থা মূলগতভাবে উদার হতে পারে কিনা তা নিয়ে তর্ক হতে পারে) বলা হয়, তাদের সাংস্কৃতিক রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। চরম দক্ষিণপন্থীরা এই পথে হাঁটে না। তারা হয় সাংস্কৃতিক যে উপলক্ষ বা প্রতীক তাদের রাজনীতির সঙ্গে সংঘর্ষে অবতীর্ণ তাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে, নয় তাকে গ্রাস করে নিজেদের রাজনীতির মত করে নতুন চেহারা দিয়ে দেয়। বামপন্থী রাজনীতি এক অর্থে একটি সাংস্কৃতিক প্রকল্পও। ফলে তার কাছে সংস্কৃতি আরও গভীরতর অনুধ্যান প্রত্যাশা করে। অনেকদিন ধরেই একটি বিতর্ক চলে আসছে – সংস্কৃতি কি বামপন্থার জন্যে শুধুমাত্র একটি ব্যবহার্য বিষয়? নাকি বিচরণক্ষেত্রও? মানে সংস্কৃতি কি শুধুই লড়াইয়ের হাতিয়ার? না নিজেও একটি যুদ্ধক্ষেত্র যেখানে প্রগতি ও প্রতিক্রিয়া নিরন্তর সংঘর্ষরত?
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
চরম দক্ষিণপন্থীরা কিন্তু সংস্কৃতিকে যুদ্ধক্ষেত্র হিসাবেই দেখে এসেছে দেশে দেশে। আমাদের দেশেও। এই মুহূর্তেও ভারতে চরম দক্ষিণপন্থীরা যে রাজনীতিকে এদেশের উপর চাপিয়ে দিয়েছে তাকে রাজনীতির সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করানোর আগে তারা সংস্কৃতির খিড়কি পথেই লোকসমাজের অন্দরমহলে চালান করেছে। ভারতের প্রাচীন ইতিহাস – মধ্যযুগ হয়ে আধুনিক যুগে ধর্মসঙ্গীত, ধর্ম আন্দোলন থেকে শুরু করে লোকসাহিত্য হয়ে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য, রাজারাজড়াদের যুদ্ধবিগ্রহ থেকে শুরু করে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও দেশভাগ – সমস্ত বিষয়েই তাদের এক সুস্পষ্ট বয়ান রয়েছে। সুপরিকল্পিতভাবে, চতুর কৌশলে তারা রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করার বহু আগেই সাংস্কৃতিক হস্তক্ষেপ ও অন্তর্ঘাতের মাধ্যমে সমাজের দেহে সেটা চারিয়ে দিয়েছে। পঁচিশে বৈশাখে যদি নজর কেন্দ্রীভূত করি, তাহলে বলতে হবে, ভারতের শাসক চরম দক্ষিপন্থীদেরও একটি নিজস্ব রবীন্দ্রনাথ রয়েছে। তারা অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে গত দশ বছরে সরকারি ক্ষমতার ব্যবহার করে সেই রবীন্দ্রনাথকে তাদের নানা সংগঠনের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছে।
সুনির্দিষ্ট দৃষ্টান্ত দেওয়ার আগে একটি কথা উল্লেখ করা উচিত। রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনা সারা জীবন তো একই স্রোতে প্রবাহিত ছিল না, সারাজীবন ধরে নানা ভাঙাগড়া, গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ যখন বালক তখন তাঁদের বাসস্থান ঠাকুরবাড়িতে হিন্দুমেলা আরম্ভ হয়, যা হিন্দুধর্মভিত্তিক পুনরুত্থানবাদী চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত ছিল। কৈশোর থেকে যৌবনের এক সুনির্দিষ্ট সময় অবধি রবীন্দ্রনাথ নানাভাবে এক ধরনের পুনরুত্থানবাদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তাঁর লেখা ‘জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ’ থেকে শুরু ‘জাতীয় সঙ্গীত’ শীর্ষক তাঁর দেশাত্মবোধক গানগুলির মধ্যে সেই পুনরুত্থানবাদী ভাবনার প্রতিফলন পাওয়া যায়। ঋত্বিক ঘটকের যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৪) ছবির সূত্রে জনপ্রিয় গান ‘কেন চেয়ে আছ, গো মা’ গানেও সেই ছায়া রয়েছে। ওই পর্বের নানা লেখালিখিতেও আছে সেই চিন্তার ছাপ। ভারতের চরম দক্ষিণপন্থীরা সুচতুরভাবে রবীন্দ্রনাথের জীবনের ওই পর্বের লেখাপত্রই তুলে ধরে। আরএসএস মুখপত্রে প্রতিনিয়ত ওই কালপর্বের নানা লেখার অংশ উদ্ধৃতি হিসাবে প্রকাশিত হয়। বছর দুয়েক আগে পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র আয়োজিত রবীন্দ্র জয়ন্তীতে বিজেপি নেতাদের উপস্থিতিতে সমবেত নৃত্য হয় জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ গানটিকে ব্যবহার করে। রাজপুত রমণীদের জহর ব্রত এবং যবনদের প্রতি বিদ্বেষ ভরা পংক্তিগুলিকে ওরা খুঁজে পেয়েছে নিজ রাজনীতির প্রতি সমর্থন হিসাবে।
আরো পড়ুন মুক্তধারা: বৌদ্ধ তত্ত্বের আলোকে প্রকৃতি রক্ষার লড়াইয়ের রাজনীতিকরণ
গতবছর পশ্চিমবঙ্গের এক জেলা শহরে সমবেত রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রতিযোগিতায় উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে এক প্রতিযোগী দলের নারী, পুরুষ সকলে কপালে লাল তিলক এঁকে যে গানটি গেয়েছিল তা সাধারণভাবে অশ্রুত। ওই গানে রবীন্দ্রনাথের পুনরুত্থানবাদী চিন্তায় আর্য অহংকারের প্রকাশ রয়েছে। গানের দলটির পরিবেশন দেখে মনে হয়েছিল তারা এই গানটি নিয়মিত গেয়ে থাকেন। একইভাবে রাম ও রামায়ণ নিয়ে আলোচনায় রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতার পংক্তি ‘কবি, তব মনোভূমি/রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো’ এড়িয়ে গিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে তুলে আনা যোগীন্দ্রনাথ বসুর রামায়ণ বইয়ের রবীন্দ্রনাথ লিখিত ভূমিকার কয়েকটি বাক্যকে। আরএসএসের নির্দেশনায় গড়ে ওঠা ভারতীয় ইতিহাস সংকলন সমিতি এবং তাদের শিক্ষা বিষয়ক সংগঠন রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি লেখাকে দেশের পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেওয়ার কথাও বলেছে।
এর বিপরীতে বামপন্থীদের রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত ভাষ্যেও প্রথম যুগে ছিল ভারসাম্যহীনতা। একটা পক্ষ অতিসরলীকরণের বালখিল্যতায় আক্রান্ত হয়ে বুর্জোয়া কবি বলতে গেছে। অপর একটি পক্ষ দৃঢ়ভাবে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সৃষ্টি থেকে নিজেদের পথ করে নেওয়ার রসদ খুঁজে পেয়েছে। কালক্রমে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে গোড়ার যুগের গোঁড়ামি কেটে গেলেও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির অনেকের মধ্যে এখনো পুরনো রোগের লক্ষণ রয়ে গেছে। কেউ রবীন্দ্রনাথের চেয়ে শরৎচন্দ্রকে মহত্তর ভাবেন, কেউ আবার সুকান্তকে এগিয়ে রাখতে চান। কিন্তু তারপরও রোজকার রাজনীতির গতিপথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সৃষ্টির সংলাপ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এখনো অসম্পূর্ণতা রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এবারের নির্বাচন যে কেন্দ্রীয় বিষয়কে সামনে রেখে ভারতীয় গণতন্ত্রের অগ্নিপরীক্ষার পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে, সেই নির্বাচনে রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র যুদ্ধের সুনির্বাচিত একটি হাতিয়ার হতে পারেন না। রবীন্দ্রনাথের জীবনের যে পর্বান্তর, যা ফুটে উঠেছে গোরা উপন্যাসে কিংবা উগ্র জাতীয় দম্ভের বিরুদ্ধে ঘরে বাইরে উপন্যাসে তিনি যে লড়াইয়ের বয়ান রেখে গেছেন, তাও হয়ে উঠতে পারত আজকের ভারতের চরম দক্ষিণপন্থাবিরোধী সংগ্রামের ভাষা। রবীন্দ্রনাথের সংগ্রাম আর আজকের ভারতের সংগ্রাম একাকার হয়ে যেতে পারত, যদি আমাদের বামপন্থী রাজনীতি প্রকৃত অর্থে একটি সাংস্কৃতিক রাজনীতির চেহারা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সৃষ্টির আরও সক্রিয় সহযাত্রী হয়ে উঠতে পারত।
আমার শুধু মনে হয়, এবারের নির্বাচন শুধু ভারতের সাংবিধানিক গণতন্ত্রকে রক্ষার সংগ্রামই নয়, গভীরভাবে ভাবলে গোরা থেকে ঘরে বাইরে হয়ে ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধের রবীন্দ্রনাথকে রক্ষা করারও সংগ্রাম। সেই সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথ নিজেই অবতীর্ণ হয়েছেন কণ্ঠে ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে’ গানটি ধারণ করে, তাঁরই আগেকার সৃষ্টি ‘জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ’-এর বিরুদ্ধে। ঠিক যেমন রক্তকরবী নাটকের শেষে কারিগরদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে স্বয়ং রাজাই নিজের বন্দিশালা ভাঙতে বেরিয়ে এসেছিল।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।