অদ্রীশ দাস

অভিযোগ অনেক, কানাঘুষো জানতে পারা কঠিন নয়। কিন্তু হিন্ডেনবার্গের গৌতম আদানির বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ শেয়ার বাজারে জালিয়াতির, বেআইনি উপায়ে নিজের শেয়ারের দাম বাড়ানোর। তাতে দুটো অপরাধ হয়ে যাচ্ছে – ১) শেয়ার যাদের বিক্রি করেছেন তাদের ঠকানো, ২) যাদের কাছে শেয়ার বন্ধক রেখেছেন, অর্থাৎ ব্যাঙ্ক, এলআইসি ইত্যাদি, তাদের ঠকানো।

শেয়ার বাজার অন্য যে কোনো পাইকারি বাজারের মতই। মানে ফলের, মাছের বা হার্ডওয়্যারের পাইকারি বাজারের মত। ক্রেতা, বিক্রেতারা দরাদরি করে শেয়ারে দাম ঠিক করে। যারা বেচবে, তারা যতটা সম্ভব বেশি দাম চায়। যারা কিনবে, তারা যতটা সম্ভব কম দর দেয়। তারপর যে সবথেকে কম দামে দিতে রাজি আছে আর যে সব থেকে বেশি দামে নিতে রাজি আছে, তাদের দর মিলে গেলে লেনদেন পাকা হয়। আর সেই দরটাই সেই মুহূর্তে সেই শেয়ারের দাম হয়ে যায়।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

আদানির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বেনামে ভারতের শেয়ার বাজারে অনেক ক্রেতা দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। এরা সাধারণ ক্রেতার মধ্যে মিশে থেকে আদানির কোম্পানির শেয়ারের উঁচু দর হাঁকে, কেনে। আবার ওরকমই আরেকজন বেনামি ক্রেতা আরও বেশি দাম হাঁকে, তাকে সেই শেয়ার বেচে দেয়। বাজারে হল্লা হয়, দাম বাড়তে থাকে। সবাই আদানির লোক। তাই আদানির জিনিস আদানির হাতেই থেকে যায়, টাকাও কিছু যায় না, শুধু দশ হাত ঘুরে দাম বেড়ে যায়। এটা বেআইনি। মিথ্যা পরিচয় দিয়ে যে কোনো লেনদেনই তো অপরাধ। তার উপর কোম্পানির মালিক নিজের কোম্পানির শেয়ার সাধারণ গ্রাহকের মত কেনাবেচা করতে পারেন না।

যে কোনো জায়গাতেই দেখবেন, কিছু কিছু বাজারের সুনাম থাকে ঠিক জিনিস ঠিক দামে পাওয়া যায় বলে। কিছু বাজারের লোকমুখে দুর্নাম রটে যায়, যে সেখানে ঠকিয়ে উল্টোপাল্টা বেশি দাম নেওয়া হয়। আপনি ক্রেতা হলে কোন বাজারে যাবেন? একবার দুর্নাম রটে গেলে বাজারের সমস্ত ব্যবসায়ীর ক্ষতি, লোক না এলে সবার ব্যবসা নষ্ট। ফলে বাজারের সুনামের জন্যই এই কেনাবেচা, দরাদরি সৎভাবে হওয়া দরকার। সেটা যে ন্যায্য, সবার সেই বিশ্বাসটা থাকা দরকার, নাহলে ক্রেতারা আর আসবেন না।

আজকাল তো কোটি কোটি সাধারণ লোক শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড ইত্যাদিতে টাকা রাখে। সরকারি ব্যাঙ্ক শেয়ার বন্ধক রেখে শিল্পপতিদের কোটি কোটি টাকা ধার দেয়। দেশের শেয়ার বাজারের উপর লোকের ভরসা বজায় রাখতে, গ্রাহকদের ঠগবাজি থেকে বাঁচাতে, সব দেশের মত ভারতেও কিছু আইন আছে।

প্রথমত, শেয়ার বা মিউচুয়াল ফান্ড কেনার আগে প্রত্যেকের পরিচয় (KYC) যাচাই করা হয়, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট লিঙ্ক করা হয়। বেনামে কেনাবেচা করা আইনত অপরাধ।

দ্বিতীয়ত, উপরে বর্ণিত জালিয়াতি করে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে সাধারণ ক্রেতাকে ঠকানো আটকাতে আইন করা আছে। কোম্পানির মালিককে নিজের কোম্পানির শেয়ার কিনতে বা বিক্রি করতে হলে শুধুমাত্র বাজারের সবাইকে আগে থেকে জানিয়ে দিতে হয়। তাকেই বলে পাবলিক অফারিং। মালিকের পক্ষে আগে থেকে না জানিয়ে, সাধারণ ক্রেতা সেজে নিজের শেয়ার কেনাবেচা করা বেআইনি। সে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকেই হোক আর পরিচিত কারোর অ্যাকাউন্ট থেকেই হোক।

তৃতীয়ত, ফল বাজারে কোনো ফল মাত্র একজন ব্যবসায়ীর হাতে থাকলে কি তার ন্যায্য দরাদরি হওয়া সম্ভব? সে একশো টাকার জিনিসে দশ হাজার টাকা চাইলেও কারোর দরকার হলে তাকে সেই দামেই কিনতে হবে। এরকম হওয়া আটকাতে, শেয়ার বাজারে মালিক কতখানি শেয়ার নিজের হাতে রাখতে পারবেন তা আইনে বেঁধে দেওয়া আছে। এই বেনামি অ্যাকাউন্টগুলোর শেয়ার ধরলে আদানি নিজের হাতে ঊর্ধ্বসীমার চেয়ে অনেক বেশি শেয়ার রেখেছেন – এরকমই অভিযোগ।

আরো পড়ুন আদানির বন্দর নির্মাণ: কমিউনিস্ট উন্নয়ন-ভাবনার সংকট

হিন্ডেনবার্গ দুবছর ধরে এক বিস্তারিত তালিকা তৈরি করেছেন। মরিশাস ইত্যাদি জায়গায় একগুচ্ছ ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে শেয়ার কেনাবেচার ব্যবসা দেখিয়ে। একেকটা অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় হাজার কোটি টাকা বাজারে খাটছে। কিন্তু বাজারের হাজার হাজার শেয়ারের মধ্যে অদ্ভুতভাবে এরা শুধু আদানির শেয়ারই কেনাবেচা করে। এদের উচুঁ পদের ম্যানেজাররা আদানি পরিবারের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যুক্ত। গৌতম আদানির যে ভাই দুবাইতে থাকেন, তার কোম্পানির ম্যানেজার এর মধ্যে আছেন, কিছু কিছু আত্মীয়ও আছে। সুতরাং ওই অ্যাকাউন্টগুলো যে আদানির বেনামি অ্যাকাউন্ট – এমন সন্দেহ করার কারণ আছে।

অতএব আদানি সম্বন্ধে অভিযোগ বহুমুখী। একে তো শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়ানো বেআইনি। তার উপর ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, এলআইসির মত সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ধার নেওয়ার সময়ে শেয়ার বন্ধক রেখেছেন। ঋণ নেওয়ার সময়ে বন্ধক হিসাবে জাল সোনা জমা দেওয়ার মতই শেয়ারের দাম বাড়ানোয় নিজে জড়িত থাকা মানে ব্যাঙ্কের সঙ্গে জালিয়াতিও করা হয়।

আদানির এত লক্ষ কোটি টাকা ধার নেওয়ার দরকার পড়ল কেন আর তার বন্ধক জোগাড় করতে শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়াতেই বা হল কেন, সে কথা আরেকদিন হবে।

লেখক বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.