গত ২১ জানুয়ারি থেকে জেলবন্দি ভাঙড়ের বিধায়ক তথা ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ) নেতা নওশাদ সিদ্দিকি এবং তাঁর সঙ্গীরা। রাস্তার আন্দোলন থেকে একজন বিধায়ককে টেনে হিঁচড়ে গ্রেপ্তার করে প্রায় মাসখানেক জেলে আটকে রাখা হচ্ছে – এমন ঘটনা সাম্প্রতিককালে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি দেখেনি। বিরোধী বিধায়কদের কয়েকজন জেলে ছিলেন বটে, কিন্তু সেসবই পুরনো মামলায়। রাস্তা অবরোধ করে সমাবেশ, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ এবং এলাকাভিত্তিক রাজনৈতিক সংঘর্ষের কারণে বিধায়ককে সপ্তাহের পর সপ্তাহ জেলে থাকতে হচ্ছে – এমন উদাহরণ সহজলভ্য নয়।
একটি সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, নওশাদ সিদ্দিকির বিরুদ্ধে ইউএপিএ আইনে মামলা করার প্রস্তুতিও নাকি নেওয়া হচ্ছে। সংবাদটির সত্যতা যাচাই করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় ঠিকই, তবে যেভাবে বারবার সরকার পক্ষ নওশাদের জামিনের বিরোধিতা করছে, তাতে খবরটিকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া মুশকিল। রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা বারবার সাংবাদিক বৈঠক করে নওশাদ এবং তাঁর দল আইএসএফকে আক্রমণ করছেন। আর্থিক অস্বচ্ছতা এবং বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগ তুলছেন।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
সব দেখে শুনে এমন সন্দেহ তৈরি হওয়া অমূলক নয়, যে রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার নওশাদ এবং তাঁর দল আইএসএফকে খানিকটা ভয় পাচ্ছে। ‘ভয়’ শব্দটি যদি একটু অস্বস্তিকর হয়, তাহলে নরম করে বলা যায়, তৃণমূল নওশাদদের নিয়ে বেশ চিন্তিত। না হলে রাস্তা অবরোধের মত আপাত নিরীহ কর্মসূচি থেকে একজন বিধায়ককে টেনে হিঁচড়ে গ্রেপ্তার করা হবে কেন? এর আগেও বিরোধী দলগুলি বহু বিক্ষোভ কর্মসূচি সংগঠিত করেছে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনাও খুব বিরল নয়৷ কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, বিরোধী দলগুলির জনপ্রতিনিধিদের আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ঠিকই, তারপর রাত্রে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিরোধী দলগুলির শীর্ষনেতাদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা প্রায় একইরকম। সিপিএমের মীনাক্ষী মুখার্জি এবং আভাস রায়চৌধুরী বেশ কিছুদিন জেলে ছিলেন৷ তবে তাঁরা কেউই জনপ্রতিনিধি নন, দলের রাজ্য স্তরের শীর্ষনেতাও নন৷
নওশাদের ক্ষেত্রে সরকার এতখানি আগ্রাসী কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। কেবল আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রেক্ষিতেই নয়, আইএসএফের গণভিত্তির নিবিড় পাঠ হয়ত আমাদের নির্বাচনী রাজনীতি পেরিয়েও বিভক্ত বাংলার রাজনীতির অন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যকে চিনতে সাহায্য করবে।
স্বাধীনতার আগে অবিভক্ত বাংলায় কৃষক প্রজা পার্টির মত দল ছিল, যে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ছিলেন মুসলমান। এছাড়া বঙ্গ রাজনীতির অন্যতম প্রধান শক্তি ছিল মুসলিম লীগ। দেশভাগের পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে মুসলিমরা ক্রমশ প্রান্তিক হতে শুরু করলেন। আমরা যদি একটু খুঁটিয়ে দেখি, তাহলে ১৯৪৭ থেকে আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের প্রধান সংসদীয় দলগুলির সর্বোচ্চ নেতৃত্বে প্রায় কোনো মুসলমানের নাম দেখতে পাব না। কালেভদ্রে একজন আবু বরকত আলি গনি খান চৌধুরী বা মহম্মদ সেলিমকে পাওয়া যায়।
মুসলিম লীগের সংগঠন পশ্চিমবঙ্গে সক্রিয় ছিল। কিছু কিছু জায়গায় তাদের খুব শক্ত সংগঠন ছিল, নির্বাচনেও জিতত। তাছাড়া মুসলিম লীগ ছিল সম্পূর্ণত মুসলমানদের দল। কৃষক প্রজা পার্টিতে যেমন মুসলমানদের পাশাপাশি হিন্দুদের, বিশেষ করে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের জায়গা ছিল, মুসলিম লীগে তা ছিল না।
বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনে হিন্দু উচ্চবর্ণের প্রাধান্য নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। আব্দুল হালিম, মুজফফর আহমেদদের দল কীভাবে বর্ণহিন্দু নেতাদের জায়গিরে পরিণত হল, তার পিছনে দেশভাগের কতখানি দায়, সে আলোচনা এই নিবন্ধের পরিসরে আঁটবে না। তবে বসু-দাশগুপ্ত-লাহিড়ী-মজুমদারদের দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বে মুসলমানরা খুব একটা জায়গা পাননি। ভাবলে খানিকটা অবাকই হতে হয়, যে বিপুল সংখ্যক মুসলমান জনসংখ্যার জেলা মুর্শিদাবাদে রাজ্যের সবচেয়ে বড় বামপন্থী দলটি দশকের পর দশক কোনো মুসলমানকে জেলা সম্পাদক করতে পারেনি। হালে তেমন একজন জেলা সম্পাদক হয়েছেন। এই প্রথম। ওই জেলার অন্য গুরুত্বপূর্ণ বামপন্থী দলটিরও অবস্থা একইরকম। চৌধুরী-বন্দ্যোপাধ্যায় গোছের পদবির প্রাধান্য পেরিয়ে খুব একটা এগোতে পারেননি তাঁরাও।
বাঙালি মুসলমান নেতা হিসাবে রাজ্য রাজনীতিতে দাপট দেখিয়েছেন গনি খান চৌধুরী। কিন্তু তাঁর প্রভাবও একটি এলাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব কার্যত দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দাদের দখলে। ফিরহাদ হাকিম বাদে সকলেই হিন্দু উচ্চবর্ণ।
রাজ্য রাজনীতিতে মুসলিমদের এমন প্রান্তিক অবস্থানের কারণ বিশ্লেষণ এই নিবন্ধের বিষয় নয়। কিন্তু নিঃসন্দেহে বলা চলে আইএসএফ বাংলার রাজনীতিতে বহু দশক ধরে চলে আসা একটি বৃত্ত ভাঙতে চেষ্টা করছে। চেষ্টাটি সচেতন কিনা সে প্রশ্ন ভিন্ন। তবে বহু দশক পরে এই প্রথম একটি সংসদীয় রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব মুসলমান সমাজ থেকে উঠে আসা নেতাদেরই হাতে রয়েছে। যদিও ঘোষিতভাবেই আইএসএফ মোটেই কেবলমাত্র সংখ্যালঘুদের সংগঠন নয়, এই দলের নেতৃত্বের এক বড় অংশ আদিবাসী এবং দলিত।
আরো পড়ুন দুর্নীতির সুযোগ বিজেপি যেন নিতে না পারে: নওশাদ
নওশাদ সিদ্দিকি একজন পীরজাদা। কিন্তু তিনি সচেতনভাবেই সেই পরিচয়ের ঊর্ধ্বে ওঠার চেষ্টা করছেন। এই চেষ্টা না করে তাঁর উপায়ও নেই। ভাগীরথী নদীর ওপারে, যেখানে রাজ্যের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা ও জেলা রয়েছে, সেখান ফুরফুরা শরীফের প্রভাব অত্যন্ত সীমিত। নওশাদ জানেন, ওইসব অঞ্চলে আইএসএফের সংগঠনকে নিজের পায়েই দাঁড়াতে হবে। তাঁর পীরজাদা পরিচয় খুব একটা কাজে দেবে না। এছাড়াও নওশাদের বক্তৃতা যদি আমরা খেয়াল করি, তাহলে দেখব, তিনি একেবারেই ধর্মীয় প্রসঙ্গ আনেন না। তাঁর আক্রমণের নিশানায় থাকে ব্রাহ্মণ্যবাদ, আরএসএস-বিজেপি এবং রাজ্যের শাসক দলের লুঠপাটতন্ত্র। রাজ্যের বিরাট অংশের শিক্ষিত মুসলমান যুবসমাজের মধ্যে এর প্রভাব ক্রমবর্ধমান। বছরের পর বছর তাঁদের ‘বাধ্যতার ভোট’ দিতে হয়েছে। বিজেপিকে আটকাতে চোখ বন্ধ করে তৃণমূলের যাবতীয় অপকর্ম সত্ত্বেও জোড়াফুলের বোতাম টিপেছেন তাঁরা। নওশাদ এবং আইএসএফের উত্থান রাজ্যের সংখ্যালঘু মানুষের কাছে অন্য একটি বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। বহু দশক পর এই প্রথম এমন কোনো রাজনৈতিক শক্তি মাথা তুলছে, যার সঙ্গে তাঁদের একাংশ একাত্ম হতে পারছেন। বর্ণহিন্দু নেতৃত্বের দখলে থাকা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দলের তুলনায় অনেকের কাছেই তাই আইএসএফ বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে।
আইএসএফের রাজনীতির ভাষা বাংলার মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলির চেয়ে আলাদা। তাদের কর্মীবাহিনীও একরোখা। তার উপর মুসলমানদের পাশাপাশি দলিত এবং আদিবাসীরাও এই দলের নেতৃত্বে থাকায় আইএসএফের গ্রহণযোগ্যতা ক্রমশ বাড়ছে। ফলে চিন্তা বাড়ছে তৃণমূলের। মুসলমানরা যে কেবলমাত্র ‘দুধ দেওয়া গরু’ হয়ে থাকতে চান না, কোনো শক্ত বিকল্প পেলে তাঁরা যে শিবির বদল করতে পারেন, রাজ্যের শাসক দলের তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। পাশাপাশি এতদিন পর্যন্ত রাজ্যের সংখ্যালঘু সমাজের প্রভাবশালী নেতাদের যে পদ্ধতিতে সামলাতে পেরেছে তৃণমূল, নওশাদের ক্ষেত্রে তা কাজ করছে না৷ ভাঙড়ের তরুণ বিধায়ক অন্তত এখন পর্যন্ত মাথা নোয়াননি। তিনি যে সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী হতে চান না, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। ফলে তৃণমূলের জন্য চ্যালেঞ্জটা খুব সহজ নয়।
আরও একটি বিষয় নিয়ে কথা বলা জরুরি, যা মূলধারার সংবাদমাধ্যমে সেভাবে আসছে না। আইএসএফের মধ্যে একটি ছোট কিন্তু সুসংগঠিত বামপন্থী গোষ্ঠী সক্রিয়। আইএসএফের প্রচারপত্র থেকে শুরু করে কৌশলগত ও সাংগঠনিক বিষয়গুলিতে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। নওশাদের জেলবন্দি সঙ্গীদের মধ্যে তাঁরাও রয়েছেন। এই ছাত্র-যুবদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ বিকল্প বাম ধারার সংগঠনে, মানবাধিকার ও বন্দিমুক্তি আন্দোলনে। নিঃসন্দেহে তাঁদের উপস্থিতি আইএসএফকে শক্তি জোগাচ্ছে।
সাংগঠনিক বিচারে আইএসএফ এখনো তৃণমূলের তুলনায় নগণ্য, কিন্তু দলটি অতীব সম্ভাবনাময়। নওশাদের উপর দল বদল করার জন্য চাপ রয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তিনি সে চাপের কাছে মাথা নত করেননি। ধীরে ধীরে তাঁর এবং আইএসএফের প্রভাব বাড়ছে। বেশকিছু জেলায় তাঁরা কিছু কিছু অঞ্চলে প্রভাব তৈরি করছেন। সবচেয়ে বড় কথা, রাজ্যের সংখ্যালঘুদের সামনে বিকল্প হিসাবে উঠে আসছেন। তাই নতুন ধরনের দল আইএসএফকে হালকাভাবে নেওয়ার বিলাসিতা করা তৃণমূলের পক্ষে সম্ভব নয়। অন্য বিরোধীদের ভরসা যখন তৃণমূলবিরোধী ক্ষোভ, তখন আইএসএফ তার নিজস্ব রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করার চেষ্টা করছে। ফলে শাসক দলকে আগ্রাসী হতেই হচ্ছে।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।