অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধনের সর্বশেষ প্রকাশিত বই A world of insecurity। সেই বইয়ের মুখবন্ধে ডোনাল্ড ট্রাম্প ভোটে জেতার পর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যানের নিউ ইয়র্ক টাইমস কাগজে প্রকাশিত কলাম থেকে নেওয়া একটা উদ্ধৃতি আছে। “People like me, and probably like most readers of The New York Times, truly didn’t understand the country we live in.” অর্থাৎ শিক্ষিত, ধ্রুপদী গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বাম ঘেঁষা উদারপন্থীদের কাছে তাদের রাজ্য, দেশ, দুনিয়াটা অপরিচিত। তারা ছোটবেলা থেকে যা শিখেছে, বিশ্বাস করেছে তা চোখের সামনে মিথ্যা প্রমাণিত হতে দেখছে। এই মতাদর্শের কানাগলিতে আটকে পড়া মানুষদের গুগল ম্যাপ হয়ে ওঠাই প্রণববাবুর বইয়ের লক্ষ্য।

তিনি প্রথমে বিশ্বজুড়ে ‘পপুলিস্ট নেতা’, অর্থাৎ যারা কোনো তথাকথিত এলিট গ্রুপের বিরুদ্ধে প্রচার করে ক্ষমতায় এসেছে, তাদের উত্থানের কথা বলেছেন। নরেন্দ্র মোদী, ট্রাম্প, রচপ তাইয়িপ এরদোগান, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, জর্জা মেলোনি… তালিকা শেষ হওয়ার নয়। সুইডেনের ভি-ডেম ইনস্টিটিউশনের মতে ২০২১ সালে বিশ্বের ৬৮% মানুষ একনায়কতন্ত্রের অধীনে বাস করেন। আরও এক তৃতীয়াংশ বিশ্ববাসী এমন দেশে বাস করেন, যা একনায়কতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রায় সব দেশেই যখন আর্থিক অসাম্য চরমে, তখন বামপন্থী পপুলিস্টদের উত্থানই তো স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তা হয়নি। মেক্সিকো, চিলি, ব্রাজিলের মতো হাতে গোনা কয়েকটা দেশ বাদ দিলে সব দেশেই দক্ষিণপন্থী নেতাদের জয়জয়কার। আগের দুনিয়ায় এটা সম্ভব ছিল না, কারণ তখন বামেরা ছিল কল্যাণকামী রাষ্ট্রের পক্ষে আর দক্ষিণপন্থীরা তার বিপক্ষে। এখন বিশ্ব উষ্ণায়নের যুগে হাওয়ার গতিপথ পালটে গেছে। আজকের যুগে আমেরিকা বাদে আর কোনো দেশের দক্ষিণপন্থীরা জনকল্যাণমূলক নীতিসমূহ বা welfare বিরোধী নয়। তাই বামপন্থী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে তাদের আর বিশেষ তফাত থাকছে না। আমাদের দেশে মোদীও স্বচ্ছ ভারত, আবাস যোজনা, উজ্জ্বলা যোজনা, বিনামূল্যে রেশন ইত্যাদি প্রকল্পের মাধ্যমে নিজেকে গরিবের উদ্ধারকর্তা হিসাবে তুলে ধরছেন।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

আরেকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন প্রণববাবু। অসাম্যের চেয়ে নিরাপত্তাহীনতা; বিশেষ করে সাংস্কৃতিক, জাতিগত নিরাপত্তাহীনতা মানুষকে অনেক বেশি অস্বস্তিতে ফেলে। তাই চিলি ছাড়া আর কোথাও আর্থিক অসাম্য নিয়ে বড় আন্দোলন গড়ে ওঠেনি, কিন্তু সংস্কৃতি বাঁচানোর আন্দোলন প্রায় সব দেশেই লক্ষ করা যায়। যেমন আমেরিকার লুইজিয়ানার কৃষকরা তাদের জমি নষ্ট করে দেওয়া পেট্রোকেমিকাল কোম্পানির চেয়ে মেক্সিকো থেকে আসা বাদামি চামড়ার মানুষদের উপর বেশি ক্ষিপ্ত। তাই তারা কর্পোরেট ট্যাক্স বাড়াতে চাওয়া ডেমোক্র্যাটদের ছেড়ে দেশের বর্ডারে দেওয়াল তুলতে চাওয়া ট্রাম্পকে সমর্থন করে।

এই নিরাপত্তাহীনতার মূল কারণ হিসাবে প্রণববাবু চিহ্নিত করেছেন community-র পশ্চাদপসরণকে। গত ৪০-৫০ বছরে মূলত নয়া উদারবাদী অর্থনীতির কারণেই যৌথতার অনেকগুলো সুযোগ লুপ্ত হয়ে গেছে। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যাওয়া অনেক বেড়েছে। ফলে সমস্ত এলাকা থেকেই পুরনো লোক বেরিয়ে গেছে, নতুন অচেনা লোক ঢুকেছে, যাদের ভাষা-সংস্কৃতি সম্পূর্ণ আলাদা। অনেকে একত্র হতে পারে এমন গণপরিসর ধ্বংস হয়েছে। বড় বড় উৎপাদন কারখানাগুলোর বেশিরভাগই চীনে চলে গেছে। যেটুকু উৎপাদন অন্য দেশগুলোতে হয়, তার বেশিরভাগই হয় ছোট ব্যবসার মাধ্যমে। সেখানে ইউনিয়ন গড়ে তোলা খুব কঠিন। উৎপাদন ক্ষেত্রের পতনের সঙ্গে সঙ্গে উত্থান হয়েছে পরিষেবা ক্ষেত্রের, যেখানে কারখানার মত এক ছাদের তলায় শ্রমিকরা কাজ করেন না। ফলে তাঁদের কর্মস্থলে সংগঠিত করাও প্রায় অসম্ভব। তাই যৌথ জীবনযাপনের আধুনিকতম সংস্করণ – ট্রেড ইউনিয়নও গত ৪০ বছরে একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। শ্রমিকদের ছেড়ে ভারত ও ইউরোপের ট্রেড ইউনিয়নগুলো হয়ে উঠেছে সাদা কলারের সরকারি কর্মচারীদের সংগঠন। সেই ফাঁকে এক ধরনের যৌথতার ধারণা দিতে এগিয়ে এসেছে দক্ষিণপন্থী জাতি, ধর্মের রাজনীতি। এ ব্যাপারে উদারপন্থী পার্টিগুলো কিছুই করতে পারেনি, কারণ বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ধারণা দাঁড়িয়ে রয়েছে ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর। যৌথতার অবলুপ্তি সেখানে হয় অবজ্ঞা, নয়ত আনন্দের বিষয়।

বাম
প্রণব বর্ধনের বইয়ের প্রচ্ছদ। শিল্পী: গ্রাসিয়েলা গ্যালাপ

গণতন্ত্র ও যৌথতার এই ক্রমাগত পশ্চাদপসরণ ঠেকানোর রাস্তা হিসাবে প্রণববাবু তুলে ধরেছেন প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রকে। যেখানে ভোটে জেতা প্রতিনিধি নয়, নাগরিকই সরাসরি সরকারি নীতি ঠিক করবে। তাইওয়ান, আইসল্যান্ড, ব্রাজিল প্রভৃতি দেশে এই ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে এবং সেগুলো অনেকাংশেই সফল। এতে মানুষের হাতে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ দেওয়া যেতে পারে, যা নিরাপত্তাহীনতা কমাতে সাহায্য করবে। আমাদের দেশে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে এই ধরনের চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু শহরাঞ্চলে সেই চেষ্টাটুকুও নেই। এর বহু খারাপ দিকও আছে। প্রথমত, এমন ব্যবস্থা সরকারি কর্মী, আমলাদের ক্ষমতা অনেকাংশে কমিয়ে দেবে। সরকারি আমলারা তাদের সামাজিক অবস্থানের জন্য বেশ খানিকটা রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী। তারা এই ব্যবস্থা আদৌ মেনে নেবে কিনা তা দেখার বিষয়। এছাড়া গ্রাম বা পাড়া স্তরে আর্থিক অসাম্য কম হলেও সামাজিক, লিঙ্গভিত্তিক অসাম্য প্রবল। সেই অসাম্য নির্মূল না করতে না পারলে গণতন্ত্রের বিকেন্দ্রীকরণ সফল হবে না। পশ্চিমবঙ্গে ভূমি সংস্কার করে গ্রামের জোতদারদের ক্ষমতা হ্রাস না করলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এতটা সফল হত না।

ট্রেড ইউনিয়নগুলোকেও কর্মপদ্ধতি পাল্টানোর প্রস্তাব দিয়েছেন লেখক। ওঁর মতে যেহেতু এখন বড় কারখানার সংখ্যা কম, বেশিরভাগ শ্রমিক ব্যক্তিগতভাবে (freelance) কাজ খোঁজেন এবং করেন, তাই ইউনিয়নগুলোর উচিত শ্রমিক মহল্লায় গিয়ে তাঁদের সংগঠিত করা। অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রভিত্তিক ইউনিয়নের পরিবর্তে এলাকাভিত্তিক ইউনিয়ন। সঙ্গে তারা শ্রমিকদের সন্তানদের বিনামূল্যে টিউশন, স্বাস্থ্য পরিষেবা ইত্যাদি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ খুব নিবিড়ভাবে এসব করে চলেছে গত কয়েক দশক ধরে। বাম নেতাদের মধ্যে শঙ্কর গুহনিয়োগী ছাড়া এ নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ আর কেউ করেননি।

তবে এই বইয়ের মূল এবং মৌলিক দাবি হল সার্বজনীন ন্যূনতম আয় (universal basic income), অর্থাৎ সব নাগরিককে বিনা শর্তে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দেওয়া। এই ধারণার কথা শুনলেই ডান বাম নির্বিশেষে সবাই রে রে করে ওঠেন। লেখক একে একে তাঁদের সব সমালোচনারই জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। দক্ষিণপন্থীদের বক্তব্য, সার্বজনীন ন্যূনতম আয় শ্রমজীবী মানুষকে অলস করে দেবে, কেউ আর কাজ করতে চাইবে না। যদিও বহু গবেষণা এই আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করেছে। কেনিয়া, ফিনল্যান্ড, আলাস্কা, ইরানে এই প্রকল্প মানুষকে অলস তো করেনি বটেই, বরং কিছু ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটিয়ে এবং মহিলাদের আর্থিক স্বাধীনতা বাড়িয়ে কাজ খোঁজার তাগিদ বাড়িয়ে দিয়েছে।

অন্যদিকে বাম মনোভাবাপন্ন মানুষের ভয়, এই প্রকল্পের জন্য টাকার জোগানের নাম করে বাকি সব সরকারি প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হবে। কিন্তু প্রণববাবু হিসাব করে দেখিয়েছেন যে কোনো নতুন কর না বসিয়ে, শুধু কর ছাড় দেওয়া বন্ধ করলে আর কিছু অপ্রয়োজনীয় ভর্তুকি বন্ধ করলেই ভারতে পরিবার পিছু ২০,০০০ টাকা করে দেওয়া সম্ভব। বড়লোকদের উপর বেশি আয়কর, সম্পত্তি কর বসালে অঙ্কটা আরও বাড়বে। ফলে বাম আশঙ্কা অমূলক।

ইউবিআই যে নিরাপত্তাহীনতা কমাবে তা বলাই বাহুল্য। আর এর ‘ইউনিভার্সাল’ অর্থাৎ সার্বজনীন চরিত্র সরকারি সাহায্য নেওয়ার লজ্জাও দূর করবে। ইউবিআই একটা অধিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হলে পিএম কিসান বা কন্যাশ্রীর মতো শর্তাধীন নগদ টাকা হস্তান্তরের ফলে নাগরিক ও সরকারের মধ্যে যে দাতা-গ্রহীতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তা নির্মূল হবে। এছাড়া আরও অনেক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুবিধা আছে, যা এই বই পড়লে বিদ্যায়তনিক অর্থনীতির বাইরের পাঠক জানতে পারবেন।

বইটি অর্থনীতির পাঠে সবে পা দেওয়া মানুষের কথা মাথায় রেখে লেখা। বিষয়ভিত্তিক অধ্যায়গুলোর শিরোনাম এবং সুস্পষ্ট উপ-শিরোনাম রয়েছে, যাতে পাঠক ইচ্ছামত ক্রমে যে কোনো অধ্যায় পড়তে পারেন। তাই প্রত্যেক অধ্যায়েই অনেক কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে, যা পোড় খাওয়া পাঠকের মনে খানিক বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে। তবে বইটার উদ্দেশ্য প্রথম পড়তে শুরু করা, চঞ্চল, অস্থির পাঠককেও নব্য রাজনৈতিক অর্থনীতির দুনিয়ায় একটু উঁকি দিতে সাহায্য করা। সেই উদ্দেশ্য রীতিমত সফল।

আরো পড়ুন আবেনোমিক্স: শিনজো আবের মুখ ও মুখোশ

প্রণববাবু ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। সোভিয়েত ইউনিয়নের উন্নয়ন মডেল পছন্দ করেন না, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র সম্পর্কে সন্দিহান। বাঙালি পাঠকদের বড় অংশের ধ্রুপদী মার্কসবাদ চর্চার ইতিহাস রয়েছে বলে এই বই এবং লেখককে সংশোধনবাদী মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু লেখকের তত্ত্বগুলো তথ্যবর্জিত নয়। ওঁর সব দাবি, বিশ্বাসের পক্ষে এই বইতে প্রমাণ দেওয়া হয়েছে। আমরা এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে আছি, যখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোও পার্টি কংগ্রেসের বাইরে বড় একটা মার্কসের নাম করছে না, বাম দলের সরকারগুলোও বাজারকে অর্থনীতি পরিচালনা করতে দিচ্ছে। অন্যদিকে চরম দক্ষিণপন্থীরা অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের হাত শক্ত করতে চাইছে। এই পরিস্থিতিতে আধুনিক অর্থনীতির তথ্য-প্রমাণকে ভিত্তি করে নতুন পথের খোঁজ করা কিন্তু মন্দ নয়।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.