কয়েকদিন আগে সংসদে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। বহুজন সমাজ পার্টির সাংসদ দানিশ আলি সংসদে দাঁড়িয়ে এমন কিছু কথা বলেছেন, যা থেকে কারো কারো হয়তো মনে হবে, সিদ্ধার্থ মালহোত্রা আর কিয়ারা আদবানির বিয়ের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু এই দেশে রোজ ঘটছে। কিন্তু মূলধারার সংবাদমাধ্যম কি আদৌ সেই ঘটনাগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে? এই সংশয় অত্যন্ত স্বাভাবিক। দানিশ যেমন একজন সাধুর কথা বলছিলেন, যিনি ভারতের রাজধানীর বুকে দাঁড়িয়ে অল্প কিছুদিন আগেই সগর্বে নিজের কৃতিত্বের কথা জানিয়েছেন। কী সেই কৃতিত্ব? কোনোরকম রাখঢাক না করে সেই তথাকথিত সাধু দাবি করেছেন, ৮৩ বছরের জীবনে তিনি মোট ৮০ জনকে খুন করেছেন। এই ৮০ জন নিহত ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের তা বলার জন্য অবশ্য যোগী আদিত্যনাথের দেশে কোনো পুরস্কার নেই। বিএসপির সাংসদ প্রশ্ন করেছেন, এই দেশে কি আদৌ আইনের শাসন রয়েছে?

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

থাকলে এমন ভয়ঙ্কর মন্তব্য করার পর একজন ব্যক্তি কী করে নিশ্চিন্তে হেঁটে চলে বেড়ান? মাননীয় সাংসদ হয়ত জানেন না, কিন্তু এ দেশের সংখ্যালঘুরা জানেন, নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহের ভারতবর্ষে এটাই স্বাভাবিক। তাঁরা জানেন, আরএসএস-বিজেপির অঘোষিত জরুরি অবস্থায় তাঁদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়েই থাকতে হয়।

দানিশ তাঁর ভাষণে মুসলিমদের উপর সাম্প্রতিক অতীতে ঘটা অনেকগুলো অত্যাচারের ঘটনা তুলে ধরেছেন। শুনতে শুনতে কেমন যেন বিভ্রম তৈরি হচ্ছিল। দেশটার চেহারা তাহলে আসলে এইরকম! সেলিব্রিটিদের বিয়ে, পাঠান ছবির টিকিট বিক্রির হিসাব বা ‘কাউ হাগ ডে’ পালনের ঘোষণা ও তা নিয়ে বিদ্রুপের বাইরেও একটা ভারতবর্ষ আছে! কিন্তু মূলধারার সংবাদমাধ্যমে তো এই অন্য ভারতের কথা নেই। কেন নেই? তাহলে কি ঝাঁ চকচকে খবরগুলোর আড়ালে কিছু ধামাচাপা দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে? কী ঢাকতে চাইছে চ্যানেলগুলো? কী ঢাকতে চাইছে আঞ্চলিক ও জাতীয় সংবাদপত্রগুলোর অধিকাংশ? সংখ্যালঘুদের গণহত্যার প্রস্তুতি?

প্রিয় পাঠক, আপনার হাজার রকমের ব্যস্ততা সামলে একটু যদি বিগত এক সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো লক্ষ করেন, তাহলে হয়ত আপনিও কয়েক মিনিট থমকে দাঁড়িয়ে ভাবতে বাধ্য হবেন। আপনার মনে হবে, এই আক্রমণ সত্যি সত্যি নেমে এলে প্রাথমিক বলি মুসলমানরা হলেও, শেষপর্যন্ত আপনিও বাঁচবেন না। বাঁচবে না এই দেশটা, দেশের সংবিধান।

কাশ্মীরে রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রা শেষ হতে না হতেই কাশ্মীরি মুসলমানদের উপর বুলডোজার চালানো শুরু হয়েছে। জীবনের যাবতীয় উপার্জন দিয়ে তৈরি ভিটেমাটির ধ্বংসাবশেষের সামনে দাঁড়িয়ে যেভাবে ভূস্বর্গের মানুষ চিৎকার করছেন যন্ত্রণায়, তাতে কারো কারো মনে হতে পারে, গোটা ভারতবর্ষের আকাশটা এখুনি ভেঙে পড়বে। হঠাৎ কেন এই আক্রমণ? তাও যখন এই মানুষগুলোর প্রায় সকলের কাছে আইনি কাগজপত্র রয়েছে? রাহুল গান্ধীর সমর্থনে কাশ্মীরের বিপুল সংখ্যক মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন। সেই কারণেই কি এই প্রতিশোধ? নাকি কাশ্মীরে সদ্য যে বিপুল লিথিয়াম ভান্ডার পাওয়া গেছে তা কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার নতুন পরিকল্পনা? হয়ত দুটোই।

কাশ্মীর থেকে মানচিত্র বেয়ে একটু নীচের দিকে আসা যাক। একবার যদি রাজধানী দিল্লির দিকে তাকান, তাহলে দেখবেন গত কয়েক মাসে রাজধানী হয়ে উঠেছে ঘৃণার কেন্দ্রবিন্দু। সংসদ ভবন থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে রোজ ঘৃণা ভাষণ বা চলছে, কোনো লুকোছাপা নেই। সকলেই সব দেখছেন এবং চুপ করে আছেন। কখনও অশ্বিনী উপাধ্যায় দিল্লিতে দাঁড়িয়ে স্লোগান দেন “যব মুল্লে কাটে যায়েঙ্গে রাম রাম চিল্লায়েঙ্গে”। কখনো আবার প্রাক্তন সেনা অফিসার মুসলিম মহিলাদের ভোগ করার নিদান দিচ্ছেন

তিরাশি বছরের সাধুর মাইক হাতে ৮০ জনকে খুন করার আস্ফালনের কথা তো আগেই বলেছি। তিনি আরও বলেছেন, মৃত্যুর আগে আরও ২০ জন মুসলমান ও খ্রিস্টানকে খুন করে সেঞ্চুরি করতে চান। ছোট ছোট বাচ্চাদের অবধি এইসব ঘৃণা ভাষণের মঞ্চের নিচে এনে জড়ো করা হচ্ছে। তাদের শেখানো হচ্ছে, মুসলিম এবং খ্রিস্টানদের রক্তে তোমার তলোয়ার লাল না হওয়া অবধি তুমি কাপুরুষ। অদ্ভুতভাবে দিল্লি পুলিশ চুপ, বরঞ্চ মলটিক্স নামের এক স্বাধীন টুইটার নিউজ পোর্টাল এই ঘৃণা ভাষণের ভিডিও সবার সামনে এনেছে বলে তাদেরই দিল্লি পুলিশ নোটিস দিয়েছে। কী অদ্ভুত পরিস্থিতি! পাঠক, আপনার কি নাজি জার্মানির কথা মনে পড়ছে?

আরো পড়ুন মিঞা মিউজিয়াম বন্ধ: কোথায় শুরু, কোথায় শেষ?

মানচিত্রের আরেকটু নিচে এসে পূর্ব দিকে যাওয়া যাক। আসামে ঢুকলে দেখবেন চিত্রটা আরও ভয়াবহ। শেষ চারদিনে আড়াই হাজারের বেশি মুসলমান যুবককে, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান যুবককে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, এরা নাকি আজ থেকে ১০ বা ১৫ বছর আগে বাল্যবিবাহ করেছে, অর্থাৎ যখন এরা বিয়ে করেছে তখন এদের স্ত্রীদের বয়স ছিল ১৮ বছরের কম।

অথচ দেশের প্রধান সেবক নরেন্দ্র মোদীজি যখন যশোদাবেনকে বিয়ে করেছিলেন, তখনো তাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন না। মোদীজিকে গ্রেপ্তার করবে কে?

যদি স্রেফ তথ্যের দিকে তাকান, তাহলে দেখবেন ভারতবর্ষে হিন্দুদের মধ্যে বাল্য বিবাহের পরিমাণ ৩১% আর মুসলমানদের মধ্যে ২৯%। অথচ বেছে বেছে মুসলমান যুবকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এদের বেশিরভাগ দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ, ইতিমধ্যেই পুলিশের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে দুজন বিবাহিত মুসলমান মহিলা আত্মহত্যা করেছেন। জেলের বাইরের গেটগুলোতে বিবাহিত মহিলাদের আর্তনাদ ও চিৎকারের ভয়ংকর দৃশ্য গোপন নেই।

চারপাশ দেখে মনে হয়, হিমন্ত বিশ্বশর্মা, যোগী আদিত্যনাথ আর মনোহরলাল খট্টরের মধ্যে মুসলমান পীড়নের প্রতিযোগিতা চলছে। যে যত বেশি মুসলমানকে শায়েস্তা করতে পারবেন এবং গণহত্যা ত্বরান্বিত করতে পারবেন তিনি যেন তত বেশি পয়েন্ট পাবেন মোহন ভাগবতের কাছ থেকে।

এসব নিয়ে খুব একটা আলোচনা চোখে পড়ছে কি? কেন পড়ছে না? যাঁরা ‘প্রগতিশীল’, তাঁরাও কি যথেষ্ট সরব? না হলে কেন নন? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্যেই হয়ত লুকিয়ে আছে বর্তমান ভারতবর্ষকে বোঝার একমাত্র পথ।

~মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.