আসামের খবর, সরকার বন্ধ করে দিয়েছে মিঞা মিউজিয়াম। মিঞা মানে? মুসলমান? হ্যাঁ, তবে আসামের সব মুসলমান এই অভিধায় অন্তর্ভুক্ত নন। তবে কারা? তাঁদের নাম মিঞা কেন? গোটা বিষয়টার গভীরে যেতে হলে শুধুমাত্র বিজেপির রাজনীতি বুঝলেই চলবে না। আসামের ইতিহাসও জানতে হবে। সেখানকার ভাঙাগড়া। নানা ভাষা, জাতি ও ধর্মের মানুষের আগমন, নির্গমন, নিষ্কাশন। সেখানকার রাজনীতির প্যাঁচ পয়জার।
গত দুশো বছরে আসামের রাজনীতির বেশিরভাগটা ছিল ভাষার রাজনীতি, তাতে ধর্মেরও মিশেল ছিল। তবে ভাষাই প্রধান। এখন রাজনীতিতে ধর্ম প্রবল, যদিও অন্তরালে ভাষার প্রশ্নও আছে। রাজনীতির এই জটিলতা আসামের স্থানীয় বাসিন্দারাই সবসময় বুঝে উঠতে পারেন না, বাইরের মানুষের জন্যে প্রায় পুরোটাই দুর্বোধ্য। এমনিতে আসাম সর্বভারতীয় রাজনীতিতে কখনোই নির্ধারকের স্থান নিতে পারেনি। স্বাধীনতার আগেও না, পরেও না। তার প্রান্তিক স্বর কখনোই জাতীয় রাজধানীতে ততটা শ্রুতিগ্রাহ্য হয়নি, যতটা হয়েছে গুজরাট বা হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলির। তবে সাধারণ মানুষ জানে না ভারতের ইতিহাসের অন্তত দুটি প্রধান ঘটনা ঘটেছে আসামের রাজনীতির প্রভাবে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
প্রথমটি দেশভাগ। হ্যাঁ, দেশভাগ। দেশভাগের সিদ্ধান্তে আসামের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাকমুহূর্তে ভারতের অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্যে ব্রিটিশ শাসকদের দেওয়া যে ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাব প্রায় সব পক্ষেরই সম্মতি অর্জন করে ফেলেছিল, তা ভেস্তে যায় প্রধানত আসামের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রবল আপত্তিতে। আসামের রাজনৈতিক নেতৃত্বের আশঙ্কা ছিল, গ্রুপিং পদ্ধতির ক্ষমতা হস্তান্তর পরিকল্পনায় আসাম ও বাংলা অভিন্ন গ্রুপিংয়ে থাকলে আসাম বাংলা ও বাঙালির অধীনস্থ হয়ে যাবে এবং বিপুলসংখ্যক বাঙালি দলে দলে আসামে চলে আসবে। দ্বিতীয়টা সত্যিই ঘটল, তবে তার জন্যে দায়ী দেশভাগই। দেশভাগ না হলে লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে আসামে যেতে হত না। আসলে রাজ্য ও গ্রুপিংয়ের তফাত তখনকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব বোঝেননি। তাই অপরিণামদর্শী দেশভাগের জন্যে যে অভূতপূর্ব রক্তক্ষয়, ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা, নারী ধর্ষণ, অপহরণ, বাধ্যতামূলক দেশত্যাগ — তার সমস্ত দায় কিছুটা হলেও আসামের রাজনীতিকেও নিতে হবে।
দ্বিতীয় ঘটনা দেশের নাগরিকত্ব আইনের বারবার পরিবর্তন এবং তার ফলে তৈরি হওয়া নাগরিকত্বের সমস্যা। এর নেপথ্যেও আসামের রাজনীতি। আর এই দুটি প্রতিক্রিয়ারই অন্তরালে রয়েছে আসামের ভাষা-রাজনীতি। ১৯৫০ সালের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নিষ্কাশন আইন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালের এনআরসি-সিএএ জটিলতারও জনক আসামের ভাষা-রাজনীতিই। এর নেপথ্যে রয়েছে অসমিয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভাষা সংস্কৃতি হারানোর আতঙ্ক। আতঙ্কের এই রাজনীতি বৈরিতা ও ঘৃণার অপরত্বে নিক্ষেপ করেছে একটি ভাষাগোষ্ঠীকেই। তারা বাংলাভাষী। এই ঘৃণার রাজনীতির বিরোধিতা এসেছে কখনো মৌলানা ভাসানীর নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন, কখনো তৎকালীন কাছাড় বা আজকের বরাক উপত্যকার গণতান্ত্রিক ভাষা আন্দোলনের তরফ থেকে। মুশকিলটা হল, স্বাধীনতাপূর্ব কৃষক আন্দোলন বা স্বাধীনতা পরবর্তী ভাষা আন্দোলন কখনোই নিজেদের অভিন্ন পক্ষ হিসাবে দেখেনি। দেখেছে প্রতিপক্ষ হিসাবে। আসামের রাজনীতির এও একটি দিক।
মৃত অতীত ছেড়ে সজীব বর্তমানে আসি। এই মিঞা মিউজিয়ামের মিঞা কারা? উত্তর ভারতে মিঞা শব্দটি একটি সসম্মান সম্বোধন হলেও আসামে তা তুচ্ছতায় বা অপমানার্থে ব্যবহৃত। আগেই বলেছি আসামে মিঞা যাঁদের বলা হয় তাঁরা সবাই মুসলমান হলেও আসামের সব মুসলমানকে মিঞা বলা হয় না। আসামের ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের নানা ভাগে ভাগ করা যায়। সেখানে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার আগে থেকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় যে অসমিয়াভাষী মুসলমানরা রয়েছেন তাঁদের দুটি অংশ — একটি গরিয়া, আরেকটি মরিয়া মুসলমান। তৃতীয় ভাগ হল বরাক উপত্যকার আদি বাসিন্দা বাংলাভাষী মুসলিমরা, যাঁদের একটি অংশ ব্রিটিশ আমলে আসামের নানা অংশে ছড়িয়ে পড়েছেন। চতুর্থ ভাগকে ব্রিটিশ আমলে পূর্ববঙ্গের মূলত ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে সরকারি উদ্যোগে নিয়ে গিয়ে আজকের আসামের ব্রহ্মপুত্রের চর অঞ্চলে বসতি প্রদান করা হয়েছিল আসামে ধান ও পাট চাষের জন্যে। এই চতুর্থ অংশই ভাগ্যপীড়িত মিঞা জনগোষ্ঠী।
স্বাধীনতার পর ১৯৫১ সালের জনগণনায় সরকারি উদ্যোগে, মূলত পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে যাঁদের অসমিয়াভাষী হিসাবে নথিভুক্ত হতে বাধ্য করা হয়। এঁরা নিজেদের অসমিয়া হিসাবে নথিভুক্ত করার ফলেই আসামে অসমিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। বগত ৭০ বছরে এঁরা অসমিয়া ভাষা সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, বিগত শতকের ছয়ের দশক ও সাতের দশকের ‘বঙ্গাল খেদা’ নামের বাঙালিবিরোধী হিংসাত্মক ঘটনাবলীর সময়ে এঁরা অসমীয়াদের পক্ষেই দাঁড়িয়েছিলেন। মাতৃভাষা ত্যাগ করা থেকে শুরু করে জীবনে যাপনে অসমিয়া হয়ে যাওয়ার পরেও তুচ্ছার্থে এঁদের নামকরণ করা হয়েছে ‘মিঞা’। আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয় ‘ন-অসমিয়া’ বা ‘নতুন-অসমিয়া।’ গরিয়া ও মরিয়াদের নিয়ে আসামের বিজেপির কোনো আপত্তি নেই। যেহেতু তারা মূলগতভাবেই অসমিয়াভাষী তাই তাদের আসামের আদি বাসিন্দা হিসাবে ঘোষণা করেছে বিজেপি সরকার। এতে প্রলুব্ধ হয়ে গরিয়া, মরিয়ারাও এখন তথাকথিত মিঞাদের বিপক্ষে। এ এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনাই, কারণ গত শতকের ছয় ও সাতের দশকে অসমিয়া উগ্র জাতীয়তাবাদীদের হয়ে বাঙালিবিরোধী অবস্থান নেওয়ার পরও পূর্ববঙ্গাগত ‘ন-অসমিয়া’রা আটের দশক থেকে ধীরে ধীরে অপরত্বে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। নেলী, গহপুর, মোকালমুয়ার গণহত্যার বলি হয়েছে এই জনগোষ্ঠীর হাজার হাজার মানুষ। তখন থেকেই বাংলাদেশি বলে অভিহিত করার শুরু। পূর্ববঙ্গাগত এই মুসলমান জনগোষ্ঠীকে আসামে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অভিবাসী মুসলমান বা ইমিগ্র্যান্ট মুসলিম বলেন, অসমিয়া ভাষায় বলা হয় পমুয়া মুসলিম। পমুয়া মানে বহিরাগত। এর বিপরীতার্থক শব্দ থলুয়া, মানে ভূমিসন্তান। আসামের রাজনীতি জুড়ে এখন শুধু পমুয়া আর থলুয়া বিতর্ক। এই বিতর্কে কুযুক্তি ও অনৈতিহাসিকতার গরু সর্বক্ষণ গাছে চড়ছে।
ছয় বা সাতের দশকের অসমিয়া উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির লক্ষ্যবস্তু ছিল বাঙালি হিন্দুরা। বাঙালি বা বাঙালি মূলের মুসলমানদের কাছে টেনে নিয়ে সমস্ত আক্রোশ কেন্দ্রীভূত করা হয়েছিল বাঙালি হিন্দুদের প্রতি। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি মূলের মুসলমানরা উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদের সাথে একজোট হলেও বরাক উপত্যকার বাঙালি মুসলমানরা সাড়া দেননি। যদিও ভাষার প্রশ্নে বরাকের বাঙালি হিন্দু, মুসলমান অভিন্ন অবস্থানে (মুষ্টিমেয় ব্যতিক্রম বাদ দিলে) থাকলেও বাঙালি হিন্দু, মুসলমানের মধ্যে কোনো পোক্ত সামাজিক বা রাজনৈতিক বন্ধন ছিল না।
বরাকের রাজনীতির এই দিকটিরও কোনো সহজ ব্যাখ্যা নেই। এখানেও নানা জটিলতা রয়েছে। স্থানীয়-বহিরাগত প্রশ্ন বরাকের বাঙালিদের মধ্যেও ক্রিয়াশীল থেকেছে। আটের দশকের বিদেশি বিতাড়ন আন্দোলন থেকে সমীকরণ পাল্টে যেতে থাকে। অসমিয়া উগ্র জাতীয়তাবাদী অংশের মধ্যে জনতা পার্টির শাসনের সুযোগ নিয়ে আরএসএসের অনুপ্রবেশ ঘটে। এর সরাসরি প্রতিক্রিয়ায় আসামের উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদ ধীরে ধীরে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার দিকে মোড় নিতে শুরু করে। বাঙালি বিরোধিতা যত বাংলাদেশি বিরোধিতার রূপ নিতে থাকে, ততই অভিবাসী মুসলমানদের বাংলাদেশি হিসাবে চিহ্নিত করার প্রবণতা বাড়তে থাকে। অসমিয়া পরিচিতির প্রতি নিজেদের দায়বদ্ধতার নানাবিধ আনুষ্ঠানিক ঘোষণা সত্ত্বেও অসমিয়া সমাজে বাঙালি বিদ্বেষের চেহারা স্পষ্টত অভিবাসী মুসলমান বিদ্বেষের রূপ নেয়। এই সময়ে বরাক উপত্যকার বাংলাভাষী মুসলমান সমাজকেও বাংলাদেশি হিসাবে অভিহিত করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
ঘটমান রাজনীতির এই পরিমণ্ডলেই অভিবাসী মুসলমান সমাজের মধ্যে নানা ধরনের প্রবাহ চালু হয়। আসামের বিদেশি বিতাড়ন আন্দোলনের সময়ে উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদী ছাত্র সংগঠন অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু)-র বিরুদ্ধে সারা আসাম সংখ্যালঘু ছাত্র ইউনিয়ন (আমসু) নামে সংগঠনের আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা হয়। কিন্তু আক্রান্ত অন্যান্য অংশ, অর্থাৎ আসামের বাঙালি হিন্দু বা বরাক উপত্যকার বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে আমসুর আহ্বান তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। ফলে প্রাথমিকভাবে আসামের সমগ্র সংখ্যালঘু সমাজকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে গঠিত হয়েও আমসু শেষপর্যন্ত অভিবাসী মুসলমানদের সংগঠন হিসাবেই পরিচিতি পায়। পরবর্তীকালে নাগরিক অধিকার রক্ষা সমিতির পতাকা নিয়ে গোটা আসামের সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকারের সপক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা হয়। এই উদ্যোগে ব্রহ্মপুত্র ও বরাক উপত্যকার বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যুক্ত হয়েছিল। যুক্ত হয়েছিলেন নানা স্তরের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও। আসাম চুক্তির পর ১৯৮৫ সালের নির্বাচনে এই সংগঠনের কার্যক্রমের ধারাবাহিকতাতেই সংযুক্ত সংখ্যালঘু মোর্চা বা ইউএমএফ নামে একটি রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করে। সংসদীয় রাজনীতির আয়ারাম গয়ারামের খেলায় এই দলের নির্বাচিত বিধায়ক ও সাংসদদের মুহুর্মুহু দলবদলে এই আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ে।
আসামে আরএসএস-বিজেপির কর্মকাণ্ডের প্রভাবে ক্রমেই স্থানে স্থানে বাংলাদেশি চিহ্নিতকরণ ও একঘরে করার নামে অভিবাসী মুসলমানদের উপর আক্রমণ ও হেনস্থার ঘটনা ঘটতে থাকে। বরাক ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে রাম জন্মভূমি আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে বাঙালিত্বের চেয়ে হিন্দুত্ব প্রবল হয়ে ওঠে। মুসলমান বিদ্বেষের অভিন্ন অবস্থান থেকে অসমিয়া উগ্র জাতীয়তাবাদের সাথেও এক ধরনের আঁতাত গড়ে উঠতে থাকে বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্তের রাজনীতির। বদরুদ্দীন আজমলের নেতৃত্বে জমিয়ত উলেমার একটি অংশ অভিবাসী মুসলমানদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিতে গঠন করে আসাম ইউনাউটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এইউডিএফ) নামে রাজনৈতিক দল। এই দলের প্রধান ভিত্তি অভিবাসী মুসলমান সমাজ। অভিবাসী মুসলমান সমাজের অসমিয়া পরিচিতিকে সামনে রেখেই সংখ্যালঘুদের অধিকারের দাবিতে নির্বাচনী রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এইউডিএফ। এনআরসির পাইলট প্রকল্প রূপায়নের সময় এনআরসি বিরোধিতায় পথে নেমে পুলিশের গুলিতে প্রাণও হারিয়েছেন কয়েকজন অভিবাসী মুসলমান। পরবর্তীকালে এনআরসি বিরোধিতার অবস্থান থেকে সরে এসে সার্বিকভাবে এনআরসির সঙ্গে সহযোগিতার পথেই গিয়েছেন তাঁরা। এই সময় থেকেই অভিবাসী মুসলমান সমাজের মধ্যে ভাষিক পরিচিতি নিয়ে নানারকম ভাবনার স্রোত বইতে থাকে। একটি ছোট অংশ মনে করল, অসমিয়া ভাষা সংস্কৃতিকে গ্রহণ করার পরও যখন লাঞ্ছনার শেষ হল না, তখন আমাদের মূল পরিচিতি বাঙালিত্বে ফিরে যাওয়াই শ্রেয়। এদের সঙ্গে একমত হল না সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় অসমিয়া ভাষাকে তাঁরা এতটাই আপন করে নিয়েছেন যে বাড়িতে যে পূর্ববঙ্গীয় উপভাষার ধরনে কথা বলেন সেখানেও অসমিয়ার মিশ্রণ ঘটেছে। অসমিয়া ভাষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যচর্চাতেও সমানভাবে অংশ নিয়েছে অভিবাসী মুসলিম সমাজ।
এই টানাপোড়েনের মধ্যেই অন্য একটি অংশ বলতে থাকেন মিঞা পরিচিতির কথা। বিদেশি নাগরিক বাছাই পর্বে অভিবাসী মুসলমান সমাজের উপর যে অত্যাচার, নির্যাতন ও বন্দীদশা নেমে আসে, মূলত এই দুঃখ যন্ত্রণাকে ভাষা দিতেই তাঁদের কথ্যভাষায় রচিত হতে থাকে এক নতুন ধরনের কবিতা। এই কবিতাগুলির নাম দেওয়া হয় মিঞা কবিতা। তাঁরা বলতে থাকেন অপমানার্থে যে অভিধা তাঁদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে সেই তাকেই ভূষণ হিসাবে, পরিচিতি হিসাবে তাঁরা তুলে ধরবেন। অসমিয়া পরিচিতির অভ্যন্তরেই নিজেদের মিঞা পরিচিতি তুলে ধরতে এই মানুষগুলি উদ্যোগী হন। উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদ একে ভাল চোখে দেখেনি। তাদের কাছে এ হল অসমিয়া পরিচিতি সত্তায় ভাঙন ধরার বিপদ। কেউ কেউ বলেছেন, এই মিঞা সত্তা নিয়ে তাঁরা আবার ফিরে যাবেন বাঙালিত্বে। আসামে সংখ্যালঘু হয়ে যাবে অসমিয়ারা। হিন্দুত্ববাদীদের প্রতিক্রিয়া আরও তীব্র। তারা বলেছে, এই মিঞা পরিচিতি সত্তা আসামকে ইসলামিক রাষ্ট্র বাংলাদেশের অঙ্গীভূত করে নেবে। তখন ভাষাও যাবে, ধর্মও যাবে।
নিজেদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে বৃহত্তর অসমিয়া সমাজের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অভিন্ন অংশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়ে কংগ্রেসের প্রাক্তন বিধায়ক অভিবাসী মুসলমান নেতা শেরমান আলি আহমেদ রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন, গৌহাটির শংকরদেব কলাক্ষেত্রের সরকারি মিউজিয়ামে মিঞা মিউজিয়ামও অন্তর্ভুক্ত করা হোক। হিমন্ত বিশ্বশর্মা তীব্র আপত্তিকর ভাষায় সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। সরকারি সাড়া না পেয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অসম মিঞা পরিষদ নামের একটি সংগঠনের সভাপতি মোহর আলির উদ্যোগে গোয়ালপাড়া জেলায় গত ২৩ অক্টোবর মিয়া মিউজিয়াম খোলা হয়েছিল। এই উদ্যোগ বানচাল করতে কেউ অসমিয়া সমাজের বিরুদ্ধে চক্রান্ত, কেউ হিন্দুদের বিরুদ্ধে জেহাদি চক্রান্ত, কেউ সরকারি অনুদানে পাওয়া আবাসে ব্যক্তিগত মিউজিয়াম খোলার বেনিয়মের অভিযোগ আনে। মিউজিয়াম বন্ধ করার দাবিতে শোরগোল শুরু হয়ে যায়। দুদিন যেতে না যেতেই ২৫ তারিখে সরকার এই মিউজিয়াম বন্ধ করে দেয়।
কী কারণে এই মিউজিয়াম বন্ধ করে দেওয়া হল তা নিয়ে সরকারের বক্তব্যও নানারকম। প্রথমে বলা হয়েছিল সরকারি নিয়মভঙ্গ। পরে তিনজনকে গ্রেপ্তার করার পর দাবি করা হয়, এই মিউজিয়ামের সাথে জেহাদিদের যোগাযোগ রয়েছে। আবার মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেন, অসমিয়াদের লাঙল, হালকে নিজেদের সংস্কৃতি হিসাবে উপস্থাপিত করে মিঞা মিউজিয়াম অসমিয়া ভাষা সংস্কৃতির অবমাননা করেছে। সর্বশেষ অভিযোগে বলা হয়েছে, আল কায়দা ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম থেকে অর্থসাহায্য নেওয়া হয়েছে। সাহায্যের পরিমাণ বলা হয়েছে ১০,০০০ টাকা। এত কম টাকা কেন তারা দেবে এবং এত কম টাকার জন্যে কেন আল কায়দার কাছে হাত পাততে হবে — বলা বাহুল্য সে প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই।
আরো পড়ুন মইনুল ও ফরিদ: ফ্যাসিবাদী শাসনের সাম্প্রতিকতম শিকার
সরকারি দমননীতিকে সমর্থন না করলেও মিঞা মিউজিয়ামের পক্ষে দাঁড়াননি আজমলের দল বা কংগ্রেসের অভিবাসী মুসলমান নেতারাও। তাঁদের মতে এ এক অপ্রয়োজনীয় উদ্যোগ। তবে চমকপ্রদ অভিযোগ এনেছে অভিবাসী মুসলমান সমাজের আরেকটি অংশ। তাদের মতে এই মিউজিয়াম স্থাপন এবং তাকে বন্ধ করে দেওয়া সবটাই বিজেপির ছক। কারণ এই সংগ্রহশালার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের অনেকেই অভিবাসী মুসলিম নন, বরং স্থানীয় বাসিন্দা হিসাবে ঘোষিত মুসলমান সমাজের লোক। উদ্বোধন করেছেন যিনি, তিনিও অহম জনগোষ্ঠীর। তাদের মতে সংগ্রহশালা খোলা এবং বন্ধ নিয়ে এই বিতর্ক আসলে বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতির ছকেই তৈরি করা হয়েছে।
আসামের ভাষা সংস্কৃতিকেন্দ্রিক রাজনীতি খুবই জটিল একটি বিষয়। এখানকার ভাষিক বৈচিত্রের ধরন এবং তার পরিবর্তনের নানা রূপ আছে। একদিকে যেমন আছে জোর করে পরিচিতি পরিবর্তনের রাজনীতি, অন্যদিকে আছে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানদের, বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার, এক উল্লেখযোগ্য অংশের অসমিয়া পরিচিতিতে মিশে যাওয়ার দৃষ্টান্তও। যাঁরা জোর করে পরিচিতি পরিবর্তনের বিরোধিতা করেন তাঁদের অনেকেই এই স্বাভাবিক পরিবর্তনগুলিকেও ভাষিক আগ্রাসন মনে করে আপত্তির চোখে দেখেন। আবার যাঁরা ভাষিক পরিচিতির স্বাভাবিক মিশ্রণের বিষয়ে উৎসাহী, তাঁরা অনেকসময়েই ভাষিক আগ্রাসনকে স্বীকার করেন না।
আইডেন্টিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স বইতে অমর্ত্য সেন বলেছেন, পরিচিতি সত্তাকে ব্যক্তিস্বাধীনতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত। কে কোন পরিচিতি সত্তায় নিজেকে রাখবে তা সম্পূর্ণত ব্যক্তির গণতান্ত্রিক অধিকারের বিষয়। এতে রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না। বহু ভাষা, বহু ধর্ম এবং বহু সংস্কৃতির আসামে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের দৃষ্টি থেকে যদি পরিচিতি সত্তাকে দেখা হয় তবেই আসামের সংঘাতমূলক ভাষিক রাজনীতির অবসান হয়ে এক বহুসাংস্কৃতিকতার জন্ম হতে পারে।বহুসাংস্কৃতিকতার গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রেক্ষিত থেকেই গরিয়া, মরিয়া, দেশি, মিঞা, বাঙালি, অসমিয়া — এই নানা নামের পরিচিতি সত্তা নিয়ে তৈরি হওয়া বিভ্রান্তি এবং বিভ্রান্তি থেকে জন্ম নেওয়া বিদ্বেষের রাজনীতির অবসান হতে পারে।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
[…] আরো পড়ুন মিঞা মিউজিয়াম বন্ধ: কোথায় শুরু, কোথায়… […]