আধুনিক বাংলা রহস্য কাহিনি বলতে মূলত যা বাজারে পাওয়া যায়, তা বিশেষ মন ভরায় না। একেই এই বঙ্গভূমে রহস্য কাহিনির সঙ্গে কৈশোরের একটা প্রবল যোগ, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লেখা রহস্য কাহিনি তুলনায় কম। যেটুকু আছে, তারও বেশিরভাগ কৃত্রিম প্লট আর কৃত্রিম প্যাটার্নের চর্বিতচর্বণ। আর সব কিছু ছেড়ে দিলেও, আজকের বাঙালি মধ্যবিত্তের দুনিয়ায়, কজন ব্যক্তি-বাঙালি হাতি থেকে হীরে হারালে বা অন্য কোনো অপরাধ ঘটলে বেসরকারি গোয়েন্দার কাছে ছোটেন? গড়পড়তা বাঙালির হারানোর মত হাতিও নেই, হীরেও নেই। সেই অর্থে তেমন ব্যক্তির আওতার মধ্যে বিশেষ বুদ্ধিদীপ্ত একক অপরাধও নেই। তাই সিনেমার পর্দায় ছাড়া, বাস্তবে বাঙালির দুনিয়ায় মগজাস্ত্রওয়ালা গোয়েন্দাও প্রায় নেই। অথচ বাংলা রহস্য কাহিনিতে, কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও, আজও সেই মান্ধাতার আমলের গোয়েন্দার দল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এখনো বিরাট সংখ্যক কাহিনিতে রহস্য গজিয়ে ওঠে আর তারপর মক্কেল পায়ে পায়ে হেঁটে এসে হাজির হয় গোয়েন্দার দোরগোড়ায়। ফলে লেখকের কলমের তুমুল জোর না থাকলে শুরুতেই কেমন যেন একটা অবাস্তব, অবিশ্বাস্য ঠেকে। তার উপর আজকের অপরাধ অনেকটাই সরে গেছে ফিজিকাল স্পেস থেকে সাইবার স্পেসে, ব্যক্তির সীমা ছাড়িয়ে সমষ্টির জগতে। সেখানকার নিত্য ঘটমান অপরাধের খুব কম ছায়া পড়ে বাংলার রহস্য কাহিনিতে।

অথচ অপরাধ, বিশেষ করে হত্যাপরাধ, যাকে রেমন্ড শ্যান্ডলার বলেছেন, “frustration of the individual and hence a frustration of the race”, আসলে একটা অন্তর্লীন সমস্যার ফুটে ওঠা রূপ। ঘোর বাস্তব। তাকে অবাস্তব হতে হবে কেন? এদিকে অন্যরা যতই খাটো নজরে দেখুন না কেন, যতই বলুন যে রহস্য কাহিনি আদতে বাস্তব থেকে পালানোর উপায়, রহস্য কাহিনির ভক্তরা কিন্তু মোটেই সে কথা মানেন না। তাঁদের কাছে রহস্য কাহিনি একটা দর্পণ। সেই দর্পণে প্রতিফলিত হয় সমাজ, সংসারের ত্রুটি। এই ত্রুটি যদি ঠিকমত ফুটিয়ে তোলা যায়, তাহলে সৎ সাহিত্যের থেকে কোন অংশে ন্যূন থাকে না রহস্য কাহিনি। তার সঙ্গে সঙ্গে থাকে সমাধানের আনন্দ – বিশুদ্ধ মগজের খেলা।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

রহস্য কাহিনির এইরকম একনিষ্ঠ ভক্তদের মনে হয় ২০২২ সালে প্রকাশিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের শেষ মৃত পাখি বইটা পড়তে ভালই লাগবে। শাক্যজিতের কাহিনি আজকের সময়ের হলেও কাহিনির কেন্দ্রে থাকা অপরাধটি আজকের নয়। নেহাতই কর্মসূত্রে সেই পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে বসেছেন এক পত্রিকার ফিচার-লিখিয়ে – ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট তনয়া ভট্টাচার্য। ভারতের অনুদ্ঘাটিত অপরাধগুলো নিয়ে এক পত্রিকায় সিরিজ লিখছেন তিনি। সেই প্রেক্ষিতে তাঁর আগ্রহের কেন্দ্রে আছে ১৯৭৫ সালে দার্জিলিং জেলায় ঘটে যাওয়া এক খুন। যে খুনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলেন এক রহস্য কাহিনির লেখক অরুণ চৌধুরী, আর খুন হয়েছিলেন প্রতিশ্রুতিমান কবি অমিতাভ মিত্র। তনয়া এসেছেন অরুণ চৌধুরীর নিজের বক্তব্য শুনতে। সেইসঙ্গে আরও সব প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান ও সাধারণ মানুষের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তিনি লিখবেন তাঁর সিরিজের শেষ ফিচার। তনয়ার অমিতাভ মিত্র হত্যা রহস্য নিয়ে আগ্রহ অনেক দিনের। বাবার সঙ্গে বসে এই রহস্যের পুনর্নির্মাণ করার স্মৃতি থেকে শুরু করে, কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের দোকান থেকে কেনা অমিতাভের নাম লেখা জীর্ণ বইয়ের সদাসঙ্গ তাঁর আগ্রহে মরচে পড়তে দেয়নি। তাই তিনি লিখতে চান অরুণের গল্প, সেই সঙ্গে অমিতাভর গল্পও।

প্রথমেই বাহবা দিতে হয় লেখককে। প্লটের মুনশিয়ানায় তিনি রহস্য আর গোয়েন্দার যোগসূত্রটি বাস্তবে প্রোথিত করে দিলেন। অরুণ চৌধুরী তনয়াকে একটি সূত্র দেন – অমিতাভর লেখা একটি অপ্রকাশিত, অসমাপ্ত উপন্যাস আর কিছু চিঠিপত্র। বলেন, সেই উপন্যাসের মধ্যে লুকিয়ে আছে সমাধান সূত্র। তনয়াকে সেটা পড়ে রহস্যের সম্পূর্ণ সমাধান বার করতে হবে। সেই পাণ্ডুলিপির এক চরিত্র বলে,

“খুন হল একটা শিল্প। আর গোয়েন্দা হল সেই শিল্পের ক্রিটিক। সমালোচক যেমন শিল্পকর্মের ভেতর থেকে লুকানো নানা চিহ্ন খুঁজে খুঁজে ব্যাখ্যা করেন, গোয়েন্দাও একটা হত্যার মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিভিন্ন ক্লু খুঁজে খুঁজে হত্যার ব্যাখ্যা দেয়। শুদ্ধতম শিল্প কী? ব্যাখ্যার অতীত। কবির কথায়, অবাঙ্মনসগোচর। ব্রহ্ম থেকে উৎপন্ন যে নাদ, অথবা ভ্যান গঘের ছবিতে একপাশ থেকে এসে ঠিকরে পড়া এক অপার্থিব আলো। শুদ্ধতম খুন কী? একইরকম। ব্যাখ্যার অতীত।”

এইটে পড়ার পর আর জমে যেতে দেরি হয় না। বুদ্ধিদীপ্ত, টানটান কাহিনীর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে শাক্যজিতের গদ্যের টান। শাক্যজিতের ‘অনুষ্ঠান প্রচারে বিঘ্ন ঘটায় দুঃখিত’, ‘কুরবানি অথবা কার্নিভ্যাল’ থেকে সাম্প্রতিককালে নির্মুখোশ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘পিতৃপক্ষ’, বাংলালাইভে প্রকাশিত ‘সার্কাস, ট্রেটর ও দ্রোহকাল’ ইত্যাদি পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়, তিনি নতুন আধেয়র জন্য নতুন আধারের প্রয়োজনে বিশ্বাসী। এক নতুনরকমের বিষয়ানুগ স্বাদু গদ্যভাষা প্রতিটি বইতেই পাঠকের জন্য অপেক্ষায় থাকে। এই বইতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এখানে গদ্য ছন্দময়, সামান্য মেদুর অথচ আতিশয্যহীন। তাকে জড়িয়ে থাকে অল্প কথায় ছবি তৈরি করে দেওয়ার সংযমী নিপুণতা। সবটা মিলিয়ে এক আশ্চর্য নাগরিক স্মার্টনেস। অনায়াসে তরতরিয়ে গল্পের অন্দরমহলে টেনে নিয়ে যায়।

আর তখনই সন্দেহ ঘনীভূত হয়। তবে কি কেন্দ্রীয় রহস্যটি আসলে খোলস মাত্র? আসল উদ্দেশ্য কি সাতের দশকের বাংলা কবিতার অনবনত দ্রোহের শরিক করা আজকের অদীক্ষিত পাঠককে? এ কি আসলে বাণিজ্যিক পত্রিকার মাৎস্যন্যায়ের বিরুদ্ধে বাংলাজোড়া লিটল ম্যাগাজিনের স্বল্পজীবী গোলিয়াথ-আস্ফালনের ইতিহাসকে আজকের উত্তরাধুনিক পণ্যায়িত দুনিয়ায় সন্তানদের ভুলে যেতে না দেওয়ার প্রকল্প? সে যদি হয়েও থাকে, শাক্যজিৎকে অনেক ধন্যবাদ। অর্বাচীন পাঠককুলকেও তিনি মজিয়ে দিতে পেরেছেন সেই সময়ের কবিতার সচেতন আখরে। কোথাও কোথাও যদিও সামান্য সন্দর্ভসুলভ প্রবণতা অনুভূত হয়, ইশারা-বধির, কাঠামোসর্বস্ব হু-ডান-ইট পাজলের মায়ায় আচ্ছন্ন পাঠকের যদি বা ধূসর পাতার বাণ্ডিল থেকে তুলে আনা উক্তি সকলকে অপ্রয়োজনীয় মেদ বলেই মনে হয়, তবু অজস্র কবিতার মগজ-নিষিক্ত পংক্তি নিশ্চিতভাবে কিছুজনের হৃদয়কে বিদ্ধ করবে, প্রত্নতাত্ত্বিক নৈপুণ্যে সময় খুঁড়ে পুরনো কবিতার কঙ্কাল পুনরুদ্ধারে উৎসাহ দেবে।

আরো পড়ুন সময় ও স্বপ্নবোধ: শঙ্খ ঘোষের একটি বই

রহস্যে ফিরে আসা যাক। রহস্য কাহিনির সমস্যা এই, যে তার প্রথাগত গঠন বহু ব্যবহারে জীর্ণ। এই কাহিনিতেও সেরকম কিছু সমস্যা আছে বলে মনে হয়েছে। কিন্তু কাহিনির আভাস না দিয়ে সেসব নিয়ে আলোচনা করা যাবে না। আর রহস্যকাহিনির আভাস দেওয়া মানেই স্পয়লার। তাই আপাতত সেই চেষ্টায় বিরত থাকা যাক। শুধু এই অনুযোগটি বলা থাক, বিনয়েন্দ্র মুস্তাফির সঙ্গে ফোনালাপ কাহিনির চূড়ান্ত পর্বে আসায় ক্লু-পাজল স্ট্রাকচারের প্রতি মনোযোগী পাঠক এই রহস্যোদ্ঘাটনের খেলায় ‘ফেয়ারনেস’ নিয়ে সামান্য আপত্তি তুলতেই পারেন। তবে অনুযোগ নয়, মুগ্ধতাই শেষ কথা। তাই বরং এই পাঠ-প্রতিক্রিয়ার সমাপ্তি হোক তনয়ার করা অরুণ চৌধুরীর লেখার আলোচনায়।

“অরুণ চৌধুরী সেই বিরল বাঙালিদের একজন যারা মেধায়, মননে ও স্বীকৃতিতে আন্তর্জাতিক। সবথেকে বড়ো ব্যাপার তাঁর উপন্যাসের সাহিত্যগুণ উৎকৃষ্ট মানের, গদ্যভাষা সমৃদ্ধ, শৈলী অভিনব, এবং সামগ্রিকভাবে সিরিয়াস সাহিত্যের সারিতে স্থান পাবার যোগ্য। এমনকি মাঝে মাঝে সমালোচকেরা এই অভিযোগও এনেছেন যে অরুণ চৌধুরী নিজের সিরিয়াস লেখকের তকমা ধরে রাখতে এতই উদ্বিগ্ন যে সাহিত্যিক স্টাইলের বাড়াবাড়িতে গোয়েন্দা কাহিনীর রোমাঞ্চকে বিসর্জন দিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্লট, মোটিভ এবং মনস্তত্ত্ব বয়নের ক্ষেত্রে অরুণ কোনো কোনো বইতে আন্তর্জাতিক ক্রাইম কাহিনীর মানে পৌঁছে গিয়েছেন বলে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছিল।”

শেষ মৃত পাখি উপন্যাসের লেখকের যদিও এটি প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র রহস্যোপন্যাস, তবু তাঁর প্রতিও কী আশ্চর্য সুপ্রযুক্ত এই কথাগুলোর সারমর্ম!

শেষ মৃত পাখি
লেখক: শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
প্রচ্ছদ: সৌজন্য চক্রবর্তী
প্রকাশক: সুপ্রকাশ
দাম: ৫২০ টাকা

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.