সুবিমল মিশ্র চলে গেলেন ভরা কলকাতা বইমেলার মাঝে। কদিন আগেও যখন তাঁকে মেডিকাল কলেজে দেখতে গেছিলাম, তখন ভাবছিলাম, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা ঋত্বিক ঘটকের পরিণতি যেন এঁর না হয়। যে গোদারকে বাংলা ভাষায় এনেছিলেন সুবিমল, তাঁর পরিণতিও যেন না হয় সুবিমলের। একটা অজানা আশঙ্কাই ভেতরে উঁকি দিচ্ছিল আসলে। কলকাতা বইমেলার মাঝে তাঁর প্রয়াণ অন্তত লিটল ম্যাগ্যাজিনের শেষ এই প্রিন্সের প্রয়াণকে আলোচনার বিষয় করে তুলল জনপরিসরে। বইমেলা তথা সমাজ তথা সংবাদমাধ্যম বাধ্য হল নতজানু হতে, এতদিনের সুড়ঙ্গ যাপনে থাকা শেষ জীবিত ঈশ্বরের সামনে।

মেডিকাল কলেজে যখন তিনি ভর্তি ছিলেন কিছুদিন আগেও, সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থা তাঁর পাশে ছিল না৷ স্রেফ হাতেগোনা কজন শুভানুধ্যায়ী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে সবার আগে নাম করব লালাদা, প্রচেতা ঘোষ, রামাস্বামী, তাপস ঘোষের। এঁদের গড় বয়স প্রায় ৬০ বা তার বেশি। মেডিকাল কলেজে তাঁকে দেখে আসার পর থেকে অদ্ভুত একটা অস্বস্তির মধ্যে ছিলাম। একটা পবিত্র রাগও বলতে পারা যায়। একটা গোটা শহর চুপ অথচ সুবিমল মিশ্র গুরুতর অসুস্থ। বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠানবিরোধী কাল্ট লেখক? নাকি বাংলা সাহিত্যের ঋত্বিক ঘটক? নাকি বাংলা সংস্কৃতির গোদার? কোনটা বলা ঠিক হবে তাঁকে? আর আমরা সবাই বার্ষিক ফুর্তির ঘোরে স্রেফ ভুলে গেলাম – কে সুবিমল?

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

লালাদা বললেন, “গিয়ে একবার দেখে এসো মেল ওয়ার্ডে।” আমি দেখতে চাইছিলাম না। অসুস্থ বাঘকে কী দেখব? তার চেয়ে সমস্ত স্মৃতি জুড়ে যে সুবিমল বেঁচে আছেন, যিনি আজীবন আনন্দবাজার বা সরকারকে তুলোধোনা করলেন, যিনি হয়ত বাংলার শেষ নাম যিনি শেষপর্যন্ত আপোস করলেন না। আর সব মূর্তি যখন পড়ে গেল, যখন সবাই বিক্রি হল বাবুর হাতে দু টাকা চার টাকায়, সুবিমল বেছে নিলেন এভাবে চলে যাওয়াকেই। গোদারের মত, ঋত্বিকের মত। সুবিমলের বিরুদ্ধে সুবিমল। নিজের পরিবার, নিজের সমাজ – সবকিছুকে আঘাত করার ফল পাচ্ছেন তিনি এখন। ওই তো আমার সামনের বেডে শুয়ে, হাতে স্যালাইন, বুকে পেসমেকার। ডাক্তার বলছেন, সুগার ফল করে যাচ্ছে, পেসমেকার খারাপ। সুবিমল এখনো শ্বাস নিচ্ছেন, তাঁর প্রত্যেকটা প্রশ্বাসে আমি টের পাচ্ছি শেষবার সবকিছুকে অস্বীকার করার দম।

বেরিয়ে সিগারেট ধরিয়ে লালাদাকে বলছিলাম, সুবিমলদের মত মানুষ আর হবে না যেমন, তেমনই আপনাদের মত মানুষও আর হবে না। যারা এরকম একজন মানুষের জন্য ৬৬ বছরেও মাঝরাতে নিঃস্বার্থে ছুটতে পারে। লালাদা হাসছিলেন, বলছিলেন নানা মানুষ সুবিমলের জন্য ফোন করছেন, কয়েকজন তরুণ এসে জানতে চেয়েছেন সুবিমলের কথা। লালাদারা আজীবন জারি বোবাযুদ্ধ পত্রিকায় সুবিমলের লেখা ছাপলেন। সুবিমল বলতেন, ছাত্রদের অল্প টাকায় কাগজটা দিতে। কতবার এভাবে আমাকে অল্প টাকায় এই কাগজ দিয়েছেন তিনি। বলছিলাম, ডাক্তার অন্তত জানে তো, কে সুবিমল? লালাদা মাথা নিচু করেই হ্যাঁ বললেন। লজ্জার হ্যাঁ। কিছু খাবার কিনে দিতে গেলেন ভেতরে, তারপর আমি আবার তাকালাম আমার শহরের দিকে। কী অদ্ভুত এই নীরবতা আজ শহরের, কী নির্লজ্জ মনে হচ্ছে আজ বছর শুরুর দিনটাকে। সুবিমল মিশ্র, যিনি বাংলা সংস্কৃতিতে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কাল্ট ফিগার, আনন্দবাজারকে ধাক্কা মারলেন একা হাতে, আজীবন আরাধ্য গোদার আর ঋত্বিকের মতই কোথাও আপোস করলেন না, তাঁকে নিয়ে একটা মানুষের হেলদোল নেই আজ, কী অদ্ভুত কবন্ধের নীরবতা সন্ধ্যার শহর জুড়ে।

লালাদা আর আমি ফেরার পথে নানা কথা বলছিলাম। একজন অ্যাটেনডেন্ট পাওয়া গেছে, চিকিৎসার টাকাপয়সাও উঠে এসেছে মোটামুটি। কিছুটা স্বস্তি পেলাম এসব শুনে। কিন্তু অস্বস্তি থেকেও কিছুতে মুক্তি পেলাম না।

সুবিমল আজীবন যাপনে ও শিল্পে যে মার্গে পৌঁছে গিয়েছিলেন তা গড় বাঙালির আয়ত্তের বাইরে ছিল। যেমন আয়ত্তের বাইরে ছিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা সতীনাথ ভাদুড়ী, কমলকুমার মজুমদার বা ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, অনন্য রায় বা উদয়ন ঘোষ, দীপক মজুমদার বা নবারুণ ভট্টাচার্য। তাঁর গোটা জীবন দিয়ে সুবিমল আজ একটা ধর্ম, একটা যাপন, একটা নিরুচ্চার আদর্শবাদে পৌঁছে গেছেন। বারবার নিজের দাঁড়াবার মাটি তাঁর মত করে আর কেউ নিজের জীবনে, নিজের সময়কালে, লেখায় এতটা আপোসহীনভাবে, এতটা সাহসিকতায় পরীক্ষা করেনি। করতে পারেনি। কালচার ইন্ডাস্ট্রির বিপক্ষে একা তিনি গভীর নির্জন পথ বেছে নিয়েছেন। এই নিশ্বাস নিতে না পারা গুলাগ সমাজে আজও একটা বিকল্প নাভি বা জল জমা রাস্তার দৈব নালা সুবিমল, যার মুখে কোনও পলিব্যাগ আটকে নেই। তাই আজীবন বলে গেলেন, টাকা নয়। শেষ কথা বলবে তোমার দর্শন, সততা, বিশ্বাস।

তাই সুবিমলের বইগুলো আসলে একেকটা আলাদা ফিল্মই, স্রেফ বই নয়। সুবিমল সবমিলিয়ে একজন কাউন্টারকালচার কাল্ট। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তাই তিনি বারবার বলতেন, বইগুলো যত্ন করে রাখতে। কারণ বইগুলোই পণ্যসাহিত্য বিরোধিতার একেকটা আস্ত বোমা। আজ যখন দক্ষিণপন্থা জিতে গেল, আজ যখন বইমেলা সেলফি আর মেহেন্দির সমাহার, আজ যখন টাকা দিয়েই সব কেনা যাচ্ছে, তখন আমাদের কাছে বিশ্বাসের শেষ প্রতিশব্দ ছিলেন তিনি। তাই বড় অসহায় বোধ করছি এই মুহূর্তে। অবশ্য, এ সমাজ আর সুবিমলের ছিলও না। সেদিক দিয়ে দেখলে সুবিমল মরে বাঁচলেন।

বইমেলা আর সুবিমল দিয়েই এই লেখা শুরু হয়েছিল। শেষে আরেকবার ফিরে যাই অবান্তর স্মৃতির ভেতরের এক অতীত বইমেলায়। সেখানে মুখে চুরুট, সদম্ভে নিজের বই মর্জিমাফিক যোগ্য পাঠককে ঝালিয়ে বিনিময় করছেন তিনি। পাঠক যদি ছাত্র হন, দাম কিছু কমিয়েও দিচ্ছেন। অথবা “সুবিমল মিশ্রের গ্রাহক হলে যা হওয়া মনে করেন”। কারণ কোথাও পাওয়া যায় না তাঁর বই। বাজার ও ক্রেতা কিছুতেই ধরতে পারবে না তাঁকে। সুবিমল আসলে বিরাট একটা ‘না’। দালালি/আপোস/মানিয়ে গুছিয়ে চলা বামনরা এই ২০২৩ সালেও তাঁকে বাগে আনতে পারল না।

আরো পড়ুন ঋত্বিক কুমার ঘটক, তাঁর যুক্তি তক্কো আর গপ্পো

আমাদের বিশ্বায়িত লারেলাপ্পা, নব্য মধ্যবিত্ত বা ভদ্রবিত্ত সমাজ, নেকুপুষু কবিতা আর হাত কচলানো এঁটোকাটা, ফিচার, পেজ থ্রি, পিতলের গান্ধীমূর্তি, ফেসবুকের লেখক আর ফিল্মমেকারদের মাঝেও সুবিমল থাকবেন। থাকবে তাঁর আন্ডারগ্রাউন্ড। লালাদাদের পত্রিকায় তাঁর আগামী লেখার জন্যে আমরা উন্মুখ হয়ে বসে থাকব আবার। সুবিমল এক আস্ত দানব, এক আস্ত মস্তান, এক আস্ত সভ্যতা। সে সভ্যতার অদূরে আজ ইন্টারন্যাশনাল বাজছে। আমরা মিছিলে এগিয়ে চলেছি যে যার মত। কান্না চেপে, রাগ চেপে, হাতে হাত ধরে। সুবিমল শেষ আস্ত কাউন্টারকালচার বই-মানুষ।

বুলেট-ফুলেট পরোয়া না করে আমরা মাটির নিচে পুঁতে রাখব তাঁর স্মরণে মাইন, বোমা, পিস্তল অর্থাৎ পাতা-পাতা সুবিমল।

ধুপাধুপধুপাধুপধুপ! ফাটল বলে…

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.