মহানগরী কলকাতা থেকে ট্রাম পরিষেবা আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দিতে চলেছে রাজ্য সরকার। যদিও নানা অজুহাতে একের পর এক ট্রাম রুট বহুদিন ধরেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এবার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পালা। সম্প্রতি রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছে, এখন থেকে মাত্র চারটি রুটে ট্রাম চালানো হবে। ধর্মতলা-গড়িয়াহাট, বালিগঞ্জ-টালিগঞ্জ – এই দুটি রুটে এখনো ট্রাম চালু আছে। এছাড়া, ধর্মতলা-খিদিরপুর ও ধর্মতলা-শ্যামবাজার – এই দুটি রুটে ট্রাম চলবে। বাকি রুটের ট্রাম লাইন পিচ ঢেলে বুজিয়ে দেওয়া হবে। সরকারের যুক্তি, শ্লথ গতির ট্রাম যানজটের বড় কারণ। শুধু তাই নয়, ট্রাম লাইন নাকি দুর্ঘটনারও কারণ।
অধিকাংশ রুটে ট্রাম ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যানজট কিন্তু কমেনি। দুর্ঘটনাও কমেনি। ট্রাম লাইন ছাড়া মহানগরীর বাকি রাস্তা মসৃণ, গতিবান্ধব – এমন দাবি সরকারও করবে না। কিন্তু, গতির যুগে ‘শ্লথ গতির যান’ শাসকের দৃষ্টিতে একেবারে বেমানান। আর পুরনোকে বিদেয় করে নতুন কিছু করাই এখন উন্নয়নের মাপকাঠি। তাই বোধহয় নিকট ভবিষ্যতে ট্রামমুক্ত হতে চলেছে কলকাতা। আজকের চারটে রুট যে অচিরেই বন্ধ হয়ে যাবে তা বলবার অপেক্ষা রাখে না।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
মহানগরীর সাহিত্য, চলচ্চিত্র, রাজনীতি, আড্ডার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ট্রাম। ১৮৭৩ সালে কলকাতায় চালু হয় ঘোড়ায় টানা ট্রাম। পরবর্তীকালে তা বিদ্যুতে চালানোর ব্যবস্থা হয়। ট্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর স্মৃতি, আবার গণআন্দোলনের গৌরবও। বিগত শতাব্দীর পাঁচের দশকে এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে উত্তাল হয়েছিল কলকাতা। তখন দেশ স্বাধীন, কিন্তু কলকাতা ট্রাম কোম্পানি ছিল ব্রিটিশ মালিকানাধীন। ভাড়া বৃদ্ধির বিরোধিতার পাশাপাশি সে আন্দোলন ছিল অনেকখানি ব্রিটিশ মালিকানাধীন ট্রাম কোম্পানির বিরুদ্ধে ক্ষোভেরও বহিঃপ্রকাশ। বামপন্থী দলগুলি ট্রাম ভাড়া বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। উদ্বাস্তু আন্দোলন, শিক্ষক আন্দোলন, ট্রাম ভাড়া বিরোধী আন্দোলন, আরও পরে খাদ্য আন্দোলন – একের পর এক গণআন্দোলনই গড়ে তুলেছিল বাম ঐক্য। আজকের মত নির্বাচনে আসন সমঝোতা আর বাম জোট সমার্থক ছিল না। ব্রিটিশ শাসনকাল থেকে স্বাধীন ভারতে ট্রাম শ্রমিকদের আন্দোলন, দাঙ্গা রোধে ট্রাম শ্রমিকদের জীবন বাজি রেখে রাস্তায় নামার ইতিহাস আজ বিস্মৃতপ্রায়। বঙ্গ জীবনের অঙ্গ ট্রাম তাই বিদায় নিতে চলেছে প্রায় বিনা প্রতিবাদে। হয়ত এই গণপরিবহন কেবল স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে।
বিদ্যুৎচালিত ট্রাম পরিবেশবান্ধব। বায়ুদূষণ রোধে এই পরিবহনের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবেশবান্ধব বলে একদিকে ব্যাটারিচালিত বাসের কথা বলা হচ্ছে, আরেক দিকে ট্রাম তুলে দেওয়া হচ্ছে। কম ভাড়ার জন্য গরিব, নিম্নবিত্ত বহু মানুষের কাছে ট্রামের উপযোগিতা অস্বীকার করা যায় না। এমন করেই তুলে দেওয়া হয়েছে দোতলা বাস, নন-এসি বাসের সংখ্যা কমিয়ে এসি বাসের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। খাতায় কলমে সরকারি বাসের ভাড়া বাড়েনি। কিন্তু বাস্তবে বেড়ে যাচ্ছে যাতায়াতের খরচ। আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের যান্ত্রিক ব্যবস্থা যে পরিবেশের ক্ষতি করে সে প্রশ্ন তোলা তো মহাপাপ।
বিরোধী দল, বিশেষত বামেরাও সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব নয়। ভাবখানা এমন, আজ না হোক কাল এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল। পরিবেশ ভাবনা রাজ্যের বাম মহলে এখনও গুরুত্ব পায়নি। পরিবেশ আন্দোলন করতে গিয়ে উন্নয়নবিরোধী তকমা পাওয়ার ভয়ে বামেদের অধিকাংশ এখনো সন্ত্রস্ত। অথচ উন্নত বলে পরিচিত বহু দেশেই এখন পরিবেশবান্ধব পরিবহনকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। গুরুত্ব পাচ্ছে ট্রাম, সাইকেল। এদিকে এখনো আমরা প্রাইভেট গাড়ি বিক্রির হিসাব দিয়ে আর্থিক বিকাশের পরিমাপ করি।
আজকের উন্নয়ন ভাবনা একমাত্রিক, একচোখা। নগরায়ন মানে ঝাঁ চকচকে বাড়ি, চওড়া রাস্তা, নিত্যনতুন মডেলের গাড়ি। তার জন্য জলাভূমি ও সবুজ ধ্বংস, গাছ কাটা – এসব ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’। আধুনিক নগরে এরা ব্রাত্য। এভাবেই উন্নয়নের বুলডোজারে উচ্ছেদ হয় গরিব মানুষ, বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানের সফরে বস্তি ঢেকে দেওয়া হয়, ফুটপাথ ছোট ছোট হতে বিলুপ্তপ্রায় হয়। আমাদের গেলানো হয় হকারদের দোষেই নাকি ফুটপাথ নেই। তাই চলে হকার উচ্ছেদ। হকার কমিয়ে মলের সংখ্যা বাড়ানোই আজকের উন্নয়ন। নগরের জীবনযাত্রাকে ব্যয়বহুল করাতেই তার আনন্দ।
উন্নয়নের এই গোলোকধাঁধায় আমরা ভুলে যেতে বসি, নগর কেবল ধনী বা উচ্চবিত্তদের জন্য হতে পারে না। নগরায়ন মানে গরিব, নিম্নবিত্তেরও জীবনযাত্রার উন্নয়ন। শহরের রাজপথ মানে প্রাইভেট গাড়ির গতি বৃদ্ধি নয়, গণপরিবহন ব্যবস্থারও উন্নয়ন। বড়লোকি উন্নয়ন ভাবনায় মজেই শাসক দল কলকাতাকে ঔপনিবেশিক প্রভুদের রাজধানী শহরের সমকক্ষ করার প্রতিশ্রুতি দেয়। আমরাও সেই প্রতিশ্রুতিতে আহ্লাদিত হই। বিরোধী দলের ব্যঙ্গবিদ্রূপেও কিন্তু এই উন্নয়ন ভাবনার বিরোধিতা থাকে না, রাজ্য সরকার যে কলকাতাকে লন্ডন করতে পারবে না তা প্রমাণের চেষ্টা থাকে। যেন লন্ডন হলেই আমাদের উন্নয়নের রথ গড়গড়িয়ে এগোত। ব্রিটিশ কোম্পানির বিরুদ্ধে আন্দোলনের ইতিহাস তাঁরা ভুলেই যান।
উন্নয়নের এই অভিমুখ নিয়ে প্রশ্ন করতেও আমরা অনেকেই ভুলে গেছি। সরকারের নির্মিত ভাষ্যেই বিশ্বাস করে আমরা ভাবি, ট্রাম মানেই গতিবিরোধী। অথচ একবারও ভেবে দেখি না, ক্রমবর্ধমান প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা নগরের যানজট বা বায়ুদূষণের জন্য কতখানি দায়ী। সাম্প্রতিক অতীতেই দিল্লির দূষণ কমাতে প্রাইভেট গাড়ির রাস্তায় বেরনো নিয়ে জোড়-বিজোড় নম্বরভিত্তিক বিধিনিষেধের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে আর গণপরিবহন ব্যবস্থার অবনতি হচ্ছে। মহানগরীর বহু জায়গায় সন্ধ্যার পর বা ছুটির দিনে বাস পাওয়া দায়। প্রাইভেট গাড়ির বদলে গণপরিবহনের উন্নতি কিন্তু যানজট কমাতে পারে।
আরো পড়ুন ভর্তুকি উন্নয়নের পরিপন্থী: বাজার মৌলবাদীদের কুসংস্কার
রাজপথ কেবল প্রাইভেট গাড়ির নয়, পথচারীর, সাইকেল আরোহীরও। মেট্রো রেলের পাশাপাশি ট্রাম চললে নগরীর গৌরবই বাড়ে। পরিকল্পনামাফিক লাইন করলে, লাইনের উপর যাতে গাড়ি না আসে তার ব্যবস্থা করলে ট্রামেরও গতি বাড়ে। আসলে খানাখন্দে ভরা ভাঙাচোরা রাস্তা, দায়িত্বজ্ঞানহীন গাড়ি চালানো, গতির প্রতিযোগিতাতেই অধিকাংশ পথ দুর্ঘটনা ঘটে। গাড়ি পার্কিংয়ের সুবন্দোবস্ত করলেও যানজট অনেকখানি কমে। সর্বোপরি বড়লোকি উন্নয়নের মূল্য গরিব, নিম্নবিত্তকে চোকাতে হলে তাকে উন্নয়ন বলা যায় না।
পুঁজি নির্দেশিত উন্নয়ন ভাবনাই আসলে ধনীর দৃষ্টিতে নগরায়নের পরিকল্পনা করে। এই উন্নয়ন ভাবনায় মোহাবিষ্ট হলে পরিবেশ বাঁচবে না, নগর সকলের বসবাসযোগ্য থাকবে না। ট্রাম বন্ধের বিরুদ্ধে মৃদু হলেও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হচ্ছে। সাইকেল চালানোর অধিকার আদায়ে নাগরিকদের একাংশ সরব। জলাভূমি, খাল বুজিয়ে নগরায়নের বিরুদ্ধেও পরিবেশকর্মীরা আন্দোলন করছেন। কিন্তু বাম রাজনীতিতে সেসবের গুরুত্ব কতটা? শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচারের ক্ষমতা চলে গেলে পুঁজি নির্দেশিত উন্নয়নে মজে যেতে হয়। অথচ এই উন্নয়ন মডেলকে প্রশ্ন করা, বিকল্প সর্বজনীন উন্নয়নের দিশা দেখানোই বাম রাজনীতির কর্তব্য। সেই পথেই নগরের গরিব, নিম্নবিত্ত, প্রগতিশীল মানুষের আস্থা ফিরে পাওয়া সম্ভব।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।