কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট নিয়ে সবথেকে বেশি উচ্ছ্বাস থাকে মধ্যবিত্তের মধ্যে, গরিব লোকে বেশি বোঝেও না। তাই তাদের জন্য অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, এই বাজেট সমৃদ্ধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভারত গড়বে। উন্নয়নের ফল সমস্ত নাগরিকের কাছে এবং সমস্ত অঞ্চলে পৌঁছে যাবে। বিশেষ করে যুবা, মহিলা কৃষক, অনগ্রসর শ্রেণী, তফসিলী জাতি ও উপজাতি বিশেষভাবে উপকৃত হবে – এটুকুই যথেষ্ট। ধনীদের বিশেষ চিন্তা নেই, কারণ গত তিন দশক ধরে বাজেটে তাদের ভাল বৈ মন্দ হয়নি। তবে বড় ব্যবসায়ীরা কিন্তু বেশ চিন্তায় থাকে, কারণ কোনো দ্রব্যের উপর আমদানি শুল্কের বা অন্যান্য কেন্দ্রীয় শুল্কের এক শতাংশ হ্রাস, বৃদ্ধিও অনেক ফারাক গড়ে দিতে পারে। আর এই প্রতিযোগিতার বাজারে কে কোথায় টেক্কা মেরে বেরিয়ে যাবে কে জানে!

মধ্যবিত্তদের অনেকেই চাতক পাখির মত অর্থমন্ত্রীর বাজেট ভাষণ শুনতে থাকে – কখন আয়কর ছাড় নিয়ে একটা ঘোষণা হবে। গত কয়েক বছর ধরে হতাশ হওয়ার পর এবার তারা একটু খুশিই হয়েছিল। অবশ্য সবাই নয়, যারা একটু খুঁটিনাটি বোঝে তাদের অনেকেই নয়। আর হবে না-ই কেন! অর্থমন্ত্রী আয়কর ছাড়ের পরিমাণ এক ধাক্কায় দু লক্ষ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন যে। কিন্তু একটু সময় কাটতেই ভুল ভাঙল। নতুন ট্যাক্স রেজিম আর পুরনো ট্যাক্স রেজিম নিয়ে এখনো কেউ কেউ ধন্দে থাকলেও অনেকেই বুঝে গেছে, যে যাদের গৃহঋণ আছে বা যারা জাতীয় পেনশন স্কিমের মত প্রকল্পে বিনিয়োগ করে থাকে তাদের জন্য কিছুই বদলায়নি। আর গতবছর পর্যন্ত খুব বেশি লোক নতুন রেজিমের আওতায় আয়কর দেয়নি। সুতরাং ধরেই নেওয়া যায়, এদের বেশিরভাগেরই হয়ত এবারও বাজেট থেকে কোনো সুবিধা হবে না। তবে গতিপ্রকৃতি দেখে মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে, সরকার সম্ভবত গৃহঋণে ছাড়ের মত ব্যাপার তুলেই দেবে। এর প্রভাব পড়বে গৃহনির্মাণ শিল্পের উপরেও। কারণ গৃহঋণে কর ছাড়ের আশায় আর কেউ ঋণ নিয়ে বাড়ি কিনবে না। আবার ব্যাঙ্কগুলোর ক্ষেত্রেও গৃহঋণ হচ্ছে সবথেকে ঝুঁকিহীন ব্যবসা। তাই তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

তবে মধ্যবিত্ত যতই ধন্দে থাক, ধনী ব্যক্তিদের কিন্তু কোনো সংশয় নেই। মানে যাদের বার্ষিক আয় পাঁচ কোটির উপরে, তাদের জন্য বেশ বড়রকমের ছাড়ের ব্যবস্থা হয়েছে। এখানে কোনো কিন্তু পরন্তু নেই। বলা হচ্ছে, কর ছাড় দিয়ে মানুষের হাতে টাকা বেশি রাখলে নাকি বাজারে চাহিদা বাড়বে আর তার ফলে অর্থনীতি তরতরিয়ে এগিয়ে যাবে। কিন্তু সরকারের তো টাকা নিয়ে বসে থাকার কথা নয়। বরং যাদের হাতে টাকা ছাড়া হচ্ছে, তারা পুরোটা খরচ না করলেও, সরকার তো পুরোটাই খরচ করে দেয়। আর যদি মানুষের হাতে টাকা ছাড়তেই হয়, তাহলে গরিবদের হাতে নয় কেন? কারণ খরচ করার প্রবণতা তো তাদেরই বেশি। তাছাড়া গরিবরা যে সমস্ত জিনিসপত্র কেনে তাতে বিদেশি দ্রব্য বা পরিষেবার পরিমাণ কম হয়, কারণ তাদের বিদেশি মদ না খেলে বা বিদেশ ভ্রমণ না করলেও চলে। অর্থাৎ তাদের হাতে টাকা ছাড়লে বোধহয় আত্মনির্ভর ভারত গড়তে বেশি সুবিধা হত। কিন্তু আয়করের মত প্রত্যক্ষ করে ছাড় দেওয়ার ফলে সরকারকে পরোক্ষ করের উপর বেশি নির্ভর করতে হবে। পরোক্ষ করের ভার যেহেতু সবাইকে বহন করতে হয় আর প্রত্যক্ষ কর শুধুমাত্র ধনীরাই বহন করে, তাই এর ফলে যে শুধু গরিবরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাই নয়, আত্মনির্ভর ভারত গড়ার কাজও কিছুটা ধাক্কা খাবে। আর বেশ কিছুকাল যাবৎ দেশে আর্থিক অসাম্য বাড়তে বাড়তে যে চরম আকার ধারণ করেছে, তারও সুরাহা হওয়ার বদলে আরও বাড়বে।

 

একটা ভাল দিক হল, এই বাজেটে পরিবেশের ব্যাপারটাকে একটু বেশি
গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ব্যাটারিচালিত গাড়ি পরিবেশের জন্য সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত
না হলেও, শহর এলাকায় দূষণ কমবে এবং তেল আমদানি যদি একটুও
কমে, তাহলে দেশের অর্থনীতি লাভবান হবে।

 

তাছাড়া সরকার যখন আর্থিক ঘাটতি নিয়ে বারবার দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে এবং ওটা সামলাতে সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে খরচে কার্পণ্য করে, তখন এই ধরণের কর ছাড় কতটা যুক্তিযুক্ত? এর আগে যখন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের উপর কর অনেকটাই কমিয়ে দেওয়া হয়, তখন যুক্তি দেওয়া হয়েছিল, এর ফলে তাদের হাতে অনেক বেশি টাকা থাকবে এবং তারা আরও বেশি করে বিনিয়োগ করতে পারবে। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলছে সেরকম কিছুই হয়নি।

এবার বাজেটে প্রস্তাবিত বিভিন্ন খাতে খরচের দিকে আলোকপাত করা যাক।

কৃষি খাতে চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে প্রায় ১০%। তবে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ মূল বাজেটের তুলনায় প্রায় ৯% কমেছে। এছাড়া গত বছরেও বরাদ্দের তুলনায় খরচ হয়েছিল প্রায় ৩% কম। অর্থাৎ গত বছরের (২০২১-২২) তুলনায় আগামী বছরের বরাদ্দ প্রায় ২% কমেছে। দুবছরের মূল্যস্ফীতি যদি ১২% ধরা হয় তাহলে প্রকৃত বরাদ্দ কমেছে প্রায় ১৪%। তাছাড়া এই খাতে বরাদ্দের প্রায় অর্ধেকই খরচ হয় পিএম কিসান প্রকল্পে কৃষকদের হাতে সরাসরি টাকা পৌঁছতে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব কৃষি উন্নয়নে পড়ার কথা নয়। ভারতের কৃষিব্যবস্থার বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা একেবারেই কাম্য নয়। সংশোধিত বাজেটের তুলনায় সারে ভর্তুকি কমানো হয়েছে প্রায় ২২%।

 

কৃষি খাতে চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় বাজেট বরাদ্দ
বেড়েছে প্রায় ১০%। তবে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ মূল বাজেটের
তুলনায় প্রায় ৯% কমেছে।

 

তবে এটা মনে রাখা দরকার, যে মূল বাজেটের তুলনায় সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে ১০০%-এরও বেশি। সেটা করতে হয়েছিল ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম ভীষণভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে। সরকার হয়ত ভাবছে, ইউক্রেন যুদ্ধ অচিরেই থেমে যাবে আর তার ফলে সারে ভর্তুকি কমাতে কোনো অসুবিধা হবে না। সরকার অবশ্য বিকল্প জৈব সার ব্যবহারের কথাও বলে থাকে। তবে সেদিকে অগ্রগতি যথেষ্ট নয় এবং আগামী বছরে বিশেষ অগ্রগতি হওয়ারও কোন কারণ নেই। রাসায়নিক সার ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক কারো অজানা নয়। তবে জৈব সারে অগ্রগতি ছাড়াই সারে ভর্তুকি কমলে কৃষিক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। সরকার ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটাতে চায়, অথচ অতীত অভিজ্ঞতা বলছে গত পাঁচ দশকে এরকম চেষ্টা খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি।

এটা কারো অজানা নয়, যে অতিমারী পরবর্তী পরিস্থিতিতে দেশের কর্মসংস্থানের অবস্থা ভাল নয়। তাই গত দুবছরে গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনা গরিব মানুষের খুব উপকারে এসেছে। কিন্তু এই বাজেটে এই যোজনায় বরাদ্দ অনেকটাই কমানো হয়েছে, যা চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটের প্রায় ৩৩% এবং গত বছরের খরচের প্রায় ৪০%। দু বছরের মূল্যস্ফীতিকে ধরলে বরাদ্দ প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। অথচ তাৎপর্যপূর্ণভাবে, সরকার এই যোজনাকে কাজে লাগিয়েই সুন্দরবনের মত উপকূলবর্তী এলাকায় আরও ম্যানগ্রোভ সৃষ্টি করতে চাইছে। ঠিক যেমন অন্তত পঞ্চাশটা পর্যটন কেন্দ্রকে উন্নত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও পর্যটন বিভাগের বরাদ্দ এক পয়সাও বাড়ানো হয়নি। সবটাই নাকি হবে রাজ্যগুলোকে ঋণ নিতে উৎসাহদানের মাধ্যমে।

শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের মত সামাজিক ক্ষেত্রে বরাদ্দও উৎসাহব্যঞ্জক নয়। গত বছর স্বাস্থ্যখাতে প্রকৃত খরচ বরাদ্দের প্রায় ১৩% কম হলেও পুরোটাই এসেছিল শিক্ষাক্ষেত্রে খরচ কমিয়ে। গত বছর শিক্ষাখাতে বরাদ্দের তুলনায় খরচ কমানো হয়েছিল প্রায় ১৪%। চলতি বছরে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ সামান্য বাড়ানো হলেও সংশোধিত বাজেটে অনেকটাই কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগামী বছরের বরাদ্দ সামান্য বেশি হলেও মূল্যস্ফীতিকে হিসাবের মধ্যে রাখলে প্রকৃত বরাদ্দ আসলে কমে গেছে। শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কিছুটা ভাল হলেও গত তিন বছরে শিক্ষা যেভাবে অবহেলিত হয়েছে তার ক্ষতিপূরণের জন্য যথেষ্ট নয়।

 

শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের মত সামাজিক ক্ষেত্রে বরাদ্দও উৎসাহব্যঞ্জক নয়।
গত বছর স্বাস্থ্যখাতে প্রকৃত খরচ বরাদ্দের প্রায় ১৩% কম হলেও
পুরোটাই এসেছিল শিক্ষাক্ষেত্রে খরচ কমিয়ে। গত বছর শিক্ষাখাতে বরাদ্দের তুলনায় খরচ কমানো হয়েছিল প্রায় ১৪%।

 

তবে কি এই বাজেটের ভাল দিক বলে কিছুই নেই? অবশ্যই আছে। এই বাজেটে মূলধনী খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির একটা চেষ্টা হয়েছে। তবে এরপরেও রাজস্ব খাতে ঘাটতি অনেকটাই বেশি। এমন কি শিক্ষাখাতে বরাদ্দকেও যদি মূলধনী বরাদ্দ বলে ধরে নেওয়া যায়, তবুও অনেক ঘাটতি থেকে যাবে। শিক্ষায় খরচকে মূলধনী খরচ হিসেবে গণ্য করাই যায়, কারণ দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে শিক্ষা দেশের সামগ্রিক কর্মদক্ষতা বাড়ায় । এমনকি কর্মসংস্থান যোজনায় বরাদ্দকেও মূলধনী ব্যয় হিসাবে ধরা যেতেই পারে। এই যোজনার ফলে গ্রামীণ পরিকাঠামোর যেমন উন্নয়ন হয়, তেমনি জলসম্পদ তথা পরিবেশের জন্যও সহায়ক হয়। সরকারের এটা অজানা নয়, তবুও যেভাবে বরাদ্দ ছাঁটাই হচ্ছে সেটা সত্যিই চিন্তাজনক। যা-ই হোক, রেলের পরিকাঠামো উন্নয়নে বরাদ্দ বৃদ্ধিও একটা ভাল দিক। তবে সরকার বন্দে ভারত আর বুলেট প্রকল্পে বেশি খরচ না করে মৌলিক পরিকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্ব দিয়ে রেল পরিবহনের সামগ্রিক উন্নয়নে জোর দিলে তা অর্থনীতির পক্ষে বেশি লাভজনক হবে।

আরো পড়ুন মূল্যবৃদ্ধি, টাকার অবমূল্যায়ন: অর্থব্যবস্থা কোন পথে?

আর একটা ভাল দিক হল, এই বাজেটে পরিবেশের ব্যাপারটাকে একটু বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ব্যাটারিচালিত গাড়ি পরিবেশের জন্য সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত না হলেও, শহর এলাকায় দূষণ কমবে এবং তেল আমদানি যদি একটুও কমে, তাহলে দেশের অর্থনীতি লাভবান হবে। সেই কারণে দেশের মধ্যে লিথিয়াম ব্যাটারি তৈরিতে উৎসাহদানও স্বাগত। তবে মোবাইল ফোন উৎপাদনে দেশীয় মূল্য সংযোজনে গভীরতা বাড়াতে আমদানি শুল্কে ছাঁটাইয়ের ব্যবস্থার ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য নয়।

আর একটা উল্লেখযোগ্য ভাল দিক হল উপজাতি বিষয়ক (Tribal Affairs) মন্ত্রকের বরাদ্দ বাড়ানো। তবে যেভাবে সামাজিক ক্ষেত্রে এবং কর্মসংস্থান যোজনায় বরাদ্দ কমানো হয়েছে এবং এই বাজেট থেকে সামগ্রিকভাবে অসাম্য বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাতে শেষ পর্যন্ত উপজাতিভুক্ত মানুষ কতটা লাভবান হতে পারবে সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.