১৯৮৫ সালে তৎকালীন রাজীব গান্ধী সরকার ইন্দিরা আবাস যোজনা আরম্ভ করে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীণ ভারতের গৃহহীন নাগরিকদের জন্য বাড়ির ব্যবস্থা করা। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নামে এই প্রকল্প নয়ের দশকে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। তফসিলী জাতি, উপজাতি ও অনগ্রসর শ্রেণির আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগণকে শস্তায় বাড়ি করিয়ে দেওয়াই ছিল এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। পশ্চিমবঙ্গে তখন বামফ্রন্ট সরকার। প্রকল্পের উপভোক্তা নির্বাচন হত গ্রাম সংসদের সভায়। উপযুক্ত উপভোক্তার অভাব ছিল না, কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা ছিল সীমিত। ফলে অনেকসময় উপযুক্ত প্রাপক প্রকল্পের বাইরে থেকে যেত রাজনৈতিক কারণে।
খুব সামান্য হলেও গ্রাম্য রাজনীতি, বিশেষ করে পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় দুর্নীতি প্রবেশ করে এই প্রকল্পের হাত ধরে। প্রকল্পে নাম তুলে দেওয়ার বিনিময়ে অনেক জায়গায় পঞ্চায়েত প্রতিনিধিরা দু হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ নিতেন। অধিকাংশ গ্রাম পঞ্চায়েত ছিল বামপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত। তাই দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধেই আসে। অবশ্য তখন দুর্নীতির সঙ্গে কোনো গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য যুক্ত হলে দলের তরফে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেওয়া হত। ফলে কিছু দুর্নীতি হয়ে থাকলেও, সামগ্রিকভাবে ইন্দিরা আবাস প্রকল্প ছিল ফলপ্রসূ এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুর্নীতিমুক্ত। বহু পঞ্চায়েত সদস্য পরবর্তী পঞ্চায়েত নির্বাচনে পরাজিত হতেন ইন্দিরা আবাস যোজনা থেকে বঞ্চিত মানুষের ক্ষোভের কারণে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
পরবর্তীকালে উপভোক্তা নির্বাচনের পদ্ধতি পরিবর্তিত হয়। বিপিএল তালিকা থেকে উপভোক্তা নির্বাচন করা হত। আরও পরে আসে প্রতি দশ বছর অন্তর অর্থনৈতিক জনগণনা। তখন তা থেকেই উপভোক্তা নির্বাচন করা হত। উপভোক্তা নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতির মাত্রাও বাড়তে থাকে। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামেদের ভরাডুবির পিছনে ইন্দিরা আবাস যোজনায় দুর্নীতি অবশ্যই আলোচনাযোগ্য কারণ। ২০১১ সালে সরকার বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চায়েত হয়ে ওঠে দুর্নীতির মুক্তাঞ্চল। নিয়ন্ত্রণহীন দুর্নীতি, ৭৫:২৫ অনুপাতে কাটমানি। ততদিন আবাস যোজনায় বরাদ্দ বৃদ্ধি হয়েছে। পঞ্চায়েত সদস্যরা প্রকৃত উপভোক্তা বাদ দিয়ে নিজেরাই আবাস যোজনার সুযোগ নিয়েছে। বহু ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে, প্রকল্পের অর্ধেক টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে পঞ্চায়েত সদস্যকে।
কেন্দ্রে সরকার পরিবর্তনের পর প্রকল্পের নাম বদলে যায়। বিজেপি সরকার ইন্দিরা আবাস যোজনার নাম পরিবর্তন করে। নতুন নাম হয় প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা। একইসঙ্গে পদ্ধতিগত পরিবর্তন হয়, বরাদ্দ বৃদ্ধি হয়। অর্থাৎ আবাস যোজনায় একজন উপভোক্তা গৃহ নির্মাণের জন্য পাবেন ৭০ হাজার টাকার বদলে পরিবর্তে এক লক্ষ ২০ হাজার টাকা। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করে, গ্রামীণ ভারতে গৃহহীন কেউ থাকবে না। গৃহহীন সমস্ত নাগরিককে এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আবাস প্লাস নামে একটি নতুন মোবাইল অ্যাপ চালু করে সরকার। ব্লক উন্নয়ন আধিকারিকদের (বিডিও) বলা হয় গ্রামে গ্রামে ঘুরে তাঁদেরই গৃহহীনদের তালিকা তৈরি করতে হবে। একজন বিডিওর পক্ষে একা এ কাজ করা সম্ভব নয় বলে তালিকা তৈরির কাজে পঞ্চায়েত চুক্তিভিত্তিক ভিলেজ রিসোর্স পার্সন (ভিআরপি)-দের নিযুক্ত করে। সেখান থেকেই আরম্ভ হয় আবাস যোজনায় চরম দুর্নীতি।
ভিআরপিরা গ্রামে গ্রামে পয়সার বিনিময়ে নাম তুলতে থাকে। প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মানদণ্ডগুলোর তোয়াক্কা না করেই ঘুষের বিনিময়ে আবাস যোজনায় নাম অর্ন্তভুক্ত করে। ভিআরপিদের সঙ্গে সমান তালে পঞ্চায়ত সদস্যরা একই কাজ করতে থাকে। ঘুষের বিনিময়ে সচ্ছল লোকেদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে নির্লজ্জভাবে নিজেদের আত্মীয় পরিজনের নামও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। অনেক জায়গায় এমনও দেখা গেছে, দোতলা বা তিনতলা বাড়ির মালিকের নাম তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। এমন বেলাগাম দুর্নীতি অতীতে কখনো হয়নি। ২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ৫৬ লক্ষ উপভোক্তার নাম কেন্দ্রের কাছে যায়। এত নাম দেখে কেন্দ্রীয় সরকার নতুন করে সমীক্ষার নির্দেশ দেয়। নতুন নির্দেশিকায় ১৪টি জিনিসের কথা বলা হয়, যা থাকলে আবাস যোজনার সুবিধা পাওয়ার উপযুক্ত বলে বিবেচনা করা যাবে না।
১) পাকা দেওয়াল ও ছাদওলা বাড়ি এবং দুয়ের বেশি ঘর
২) যাদের মোটরবাইক এবং চার চাকার গাড়ি আছে
৩) কৃষিকাজের জন্য তিন চাকা অথবা চার চাকার ট্রাক্টর আছে
৪) পঞ্চাশ হাজার টাকার উপরে কিষান ক্রেডিট কার্ড আছে
৫) সরকারি চাকরি করে
৬) কৃষির সাথে যুক্ত নয় এমন কেউ
৭) পরিবারের কেউ মাসিক দশ হাজার টাকা উপার্জন করে
৮) আয়কর দেয়
৯) প্রফেশনাল ট্যাক্স দেয়
১০) বাড়িতে রেফ্রিজারেটর আছে
১১) ল্যান্ডলাইন ফোন আছে
১২) আড়াই একরের বেশি কৃষিজমি আছে
১৩) পাঁচ একরের বেশি সেচযোগ্য দুই ফসলি জমি আছে
১৪) সাড়ে সাত একরের বেশি জমি, চাষের যন্ত্র আছে
এই সমীক্ষার পরেই ২০২২ সালে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে উপভোক্তার সংখ্যা ৫৬ লক্ষ থেকে ৩৯ লক্ষে নেমে আসে। সতেরো লক্ষের মত নাম বাদ যায়। অনেকের নাম বাদ যায় আধার লিঙ্ক করার সময়ে, অনেকের নাম বাদ যায় জব কার্ড লিঙ্ক করার সময়ে। প্রায় ৩০% নাম বাদ যায়। টিকে যাওয়া ৩৯ লক্ষ নামের মধ্যে জায়গা পাননি আরজুনা বিবিরা। সেই তালিকাতেও সত্যিকারের উপযুক্তদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কম। বরং যাদের সবকিছু আছে তাদের নামই টিকে গেছে। কেউ হয়ত পঞ্চায়েত প্রধান, বাড়ি আছে, গাড়ি আছে। তার নাম রয়েছে তালিকায়। শাসক দলের মাতব্বর – দোতলা বাড়ি, তার নামও আছে।
এতটাই দুর্নীতি হয়েছে যে মুর্শিদাবাদের একটি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানসহ সমস্ত সদস্য পদত্যাগ করেছেন। রাজ্যের এমন একটি জেলা, এমন একটি গ্রাম পঞ্চায়েত নেই যেখানে আবাস যোজনা নিয়ে বিক্ষোভ হয়নি। রাজ্যের সর্বত্র শাসকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন সাধারণ বঞ্চিত জনগণ। আবাস যোজনা নিয়ে গ্রামবাংলা কী পরিমাণ রেগে আছে তা বোঝা যাচ্ছে সরকারি দলের দিদির দূত কর্মসূচিতে নেতা, মন্ত্রীদের সামনে পেয়ে গ্রামের মানুষের ক্ষোভ উগরে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে। স্মরণকালে গ্রামবাংলার মানুষকে এতটা বিক্ষুব্ধ হতে দেখা যায়নি।
এখন প্রশ্ন হল, শাসকবিরোধী এই ক্ষোভকে বিরোধীরা কতটা কাজে লাগাতে পারবে? প্রধান বিরোধী দল বিজেপি আবাস যোজনা নিয়ে খুব বেশি আন্দোলনমুখী নয়। কারণ প্রাপক তালিকায় ৩৯ লক্ষ নামের তালিকার মধ্যে অধিকাংশ সংখ্যাগুরু হিন্দু। আবাস যোজনা প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত সংখ্যালঘুরা। আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকলেও তালিকায় তাদের নাম নেই। কারণ সংরক্ষণের কারণে তালিকায় তফসিলী জাতি উপজাতির আধিক্য বেশি। একটি গ্রাম পঞ্চায়েতে জনসংখ্যার ৫০% সংখ্যাগুরু, ৫০% সংখ্যালঘু। সেই গ্রাম পঞ্চায়েতের উপভোক্তাদের ৯৭৫ জনের তালিকায় সংখ্যালঘু নাম আছে ৩০০ জনের মত। বিজেপি গ্রামে গ্রামে এই প্রকল্পকে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প বলে দলীয় প্রচারের কাজ করছে। এছাড়া কিছু গ্রাম পঞ্চায়েতে বিজেপি বিরোধী আসনে রয়েছে। ফলে বিজেপি পঞ্চায়েত সদস্যরাও সমানভাবে তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্যদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুর্নীতি করেছে। স্বাভাবিকভাবেই তারা আবাস যোজনা দুর্নীতি নিয়ে গণআন্দোলন সংগঠিত করেনি, করার অবস্থায় নেই।
বামপন্থীরা, বিশেষ করে সিপিএম, আবাস যোজনা নিয়ে জেলায় জেলায় আন্দোলন সংগঠিত করেছে। এই ইস্যুকে হাতিয়ার করে পায়ের তলার মাটিও কিছুটা ফিরে পেয়েছে। আবাস যোজনা দুর্নীতি নিয়ে বুথে বুথে পদযাত্রা সংগঠিত করেছে। পার্টি সংগঠন সচল হয়েছে, জেলায় জনসভায় উপচে পড়া জমায়েতও হচ্ছে। মুর্শিদাবাদ, মালদার মত সংখ্যালঘুপ্রধান জেলা এবং দক্ষিণবঙ্গে – বিশেষ করে পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, এমনকি বীরভূমেও বিক্ষোভ সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু আন্দোলনকে গণবিক্ষোভে পরিণত করা যায়নি। বিক্ষুব্ধ বাংলাকে গণআন্দোলনের দিশা দেখাতে পারেনি সিপিএমও। তাই নন্দকুমারে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সম্পাদক নিরঞ্জন সিহি, পার্টি নেতা পরিতোষ পট্টনায়েক, আরজুনা বিবিদের উপর পুলিস বর্বরোচিত আক্রমণ চালালেও তার বিরুদ্ধে কোনো সংগঠিত জঙ্গি আন্দোলন করতে পারেনি পার্টি।
আরো পড়ুন জঙ্গলমহল আর দলের শাসন মানতে চাইছে না
কেন পারেনি এই প্রশ্নের উত্তরে মনে হয় আরও গভীরে যেতে হবে। দুর্নীতি এখন আমাদের মজ্জাগত হয়ে গেছে। সরকারি বদান্যতায় প্রতিটি নাগরিক এখন বিশ্বাস করেন, দুর্নীতি পশ্চিমবঙ্গে খুবই স্বাভাবিক। তাই দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন মানুষকে তেমনভাবে স্পর্শ করে না।
এছাড়া নাছোড়বান্দা, মতাদর্শে অবিচল নেতৃত্বের অভাবে সিপিএম জেলায় জেলায় এখন পর্যন্ত ফলপ্রসূ আন্দোলন সংগঠিত করতে পারেনি। আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে কি আবাস যোজনা শাসক দলকে বেকায়দায় ফেলবে? বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে পারবে? রাজনৈতিকভাবে কে কতটা লাভবান হবে তার তুল্যমূল্য বিচারে না গিয়েও বলা যায়, আবাস যোজনায় বঞ্চিত আরজুনা বিবিরা শাসক তৃণমূলের জন্য অশনি সংকেত। নিঃশব্দ বিপ্লবের মত ফিরে আসতে পারে ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন। মনে রাখতে হবে, এ রাজ্যের বর্তমান শাসক দল কোনো মতাদর্শের উপর দাঁড়িয়ে নেই, টিকে আছে মানুষকে সামান্য কিছু সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার উপর ভর দিয়ে। সেটুকুও না পেলে খাস তৃণমূলীও তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে দুবার ভাববে না।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।