ভাবলে অবাকই লাগবে আজ, শঙ্খ ঘোষের দুটি ক্রমিক কবিতাবই — বাবরের প্রার্থনা আর পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ বেরিয়েছিল কার্যত পিঠোপিঠি, সামান্য দু বছরের ব্যবধানে: ১৯৭৬ এবং ১৯৭৮। দুই বইয়ের আঙ্গিকে তফাত ছিল আকাশ পাতাল। এক দিকে ছিল বাবরের প্রার্থনা, যুক্তফ্রন্ট-নকশালবাড়ি-জরুরি অবস্থার ঘোর কালচক্র পেরিয়ে আসা তার শরীরে লেগে ছিল সমসময়ের অনিবার্য জড়ুল। সেই পর্বের কিছু কবিতায় ছিল এমন এক কবিসত্তা, বলা অসঙ্গত হবে না, যিনি এক অর্থে ছিলেন নিছকই নাগরিক। সত্তর দশকের ক্রান্তি মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বাঙালি পাঠক আবিষ্কার করছিল ওই নাগরিক কবিসত্তার ক্রম-উন্মোচন — যিনি কোনও সঙ্ঘের শুদ্ধাচারী সদস্য নন, আবার অংশী নন ষাটের দশক তোলপাড় করা রাগী যৌবনেরও। ‘হাসপাতালে বলির বাজনা’, ‘হাতেমতাই’ কিংবা ‘চাপ সৃষ্টি করুন’ গোত্রের কাব্যভাষা থেকে, আর একটু প্রসারিত করা গেলে ‘রাধাচূড়া’ বা ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ’ পর্যন্ত ফুটে উঠছিল সত্তরের মধ্যবিত্ত নাগরিকতার উপযুক্ত এক কবিভাষ্য। যে কবি সমকালের বিচ্যুতি জরিপ করে প্রায়শই শঙ্কিত হন, কলরব মুখর যৌথতাতেও যিনি সমান সন্দিহান। অথচ, কী আশ্চর্য, ঘোর আকালেও যাঁর কবিতার নিগড়ে তিরতির ব্যাপ্ত থাকে মঙ্গলচিন্তা ও শুভবোধ। ব্যবস্থাকে খতম করতে কোন নৈরাজ্যবাদী দ্রোহের পাঠ দেন না, ধ্বংস চিন্তাও তাঁর অভিপ্রেত নয় আদৌ। এ তথ্য ঠিক যে, ইতিহাসের গা থেকে আশাবাদের অভ্যস্ত পলেস্তারা খসে পড়ছিল ক্রমশ। তবুও শঙ্খ ঘোষের কবিতা সত্তর থেকেই হয়ে উঠছিল অপরাজেয় নাগরিকতার সনদ, এবং হতাশ এককের শ্লীল, শীলিত ও সৌম্য ইস্তেহারবিশেষ।

কিন্তু আদৌ বাবরের প্রার্থনার এই কবিতাগুলি নিয়ে ভাবব না আমি। বরং এই কবিতা-আদর্শের সটান বিপ্রতীপে, উড়াল দেওয়া যাক অব্যবহিত পরের কবিতাবইটিতে: পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ। বহু পরে, ২০০১ সালে চিন্ময় গুহকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ, “লেখাগুলি শুরু হয়েছিল একটা শুকনো জায়গায়। খোলা আকাশ, খোলা মাঠ, অল্প কয়েকখানা বাড়ি — আর এক জায়গায় গুচ্ছ করা এলোমেলো ছোটখাটো পরিত্যক্ত কয়েকটি শিবমন্দির। এরই ওপর কখনও বৃষ্টি নেমে এলে কিংবা কখনও রাত নেমে এলে নিজের ভেতরটা অনেকখানি দেখতে পাওয়া যায়। জায়গাটার নাম ছিল বক্রেশ্বর। বক্রেশ্বরে আমার তিন সপ্তাহের বসবাস ওই বইটার সঙ্গে জড়ানো।” এর পিঠোপিঠি পড়া যাক ৪ নম্বর চতুষ্পদীটি:

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

চোখের পাতায় এসে হাত রাখে শ্লথ বেলপাতা

পাকা ধান নুয়ে পড়ে আদরে ঘিরেছে শরীরীকে

বালির গভীর তলে ঘন হয়ে বসে আছে জল

এখানে ঘুমোনো এত সনাতন, জেগে ওঠা, তাও।

কিংবা

এই চত্বরের পাশে শুকনো খোলস আছে পড়ে,

তৃপ্ত পিচ্ছিলতা নিয়ে চলে গেছে সচ্ছল শরীর।

এই যে ইন্দ্রিয় মুড়ে রাখা বিবশ আচ্ছন্নতার হিম হিম গন্ধ… সংক্ষিপ্ত, মার্জিত রূপকল্প… গণেশ পাইনের ছবির মত, তা শঙ্খ ঘোষের কবিতার নির্বিকল্প চিহ্ন। ঐ ভরা ইন্দ্রিয়ঘোর কখনও লুপ্ত করে দেয় না কবির বোধিকে, বরং হয়ে ওঠে চেতনার অনিবার্য সম্পূরক। কিন্তু প্রথম কবিতায় পাঠকের নজর কাড়বে অন্য এক অমোঘ বিশেষণের স্নিগ্ধ চাতুরিটুকু: ‘সনাতন’। সনাতন? ঘুম ও জাগরণ, উভয়েই সনাতন হল তবে? সমসময় ছিল যে নাগরিকের অনিবার্য এক আয়ুধ, টের পাওয়া যায় দিব্য, সেই শিরস্ত্রাণ তিনি ফেলে এসেছেন বক্রেশ্বরের পরিত্যক্ত মাঠে। এবং কবির যাত্রা ক্রমশ শুরু হচ্ছে বোধ্য এবং স্বচ্ছ বর্তমান-বিন্দু থেকে, অগম্য এক অতীত ঘেরা রহস্যময় জেনানা মহলের দিকে, যে চত্বরে স্নায়বিক রসায়নে খেলা করে কেবল প্রাচীনের কূটাভাস:

ঘরবাড়ি ভিজে যায় অশান্ত ধানের মাঝখানে

রবিউল বসে দেখে। এরকমই মীড় বা গমকে

ভরে ছিল সময়ের স্তরগুলি একদিন, আজ

বাজনা রয়েছে পড়ে, ফিরে গেছে বাজাবার হাত।

মনে পড়ে যায় জার্নাল বইটিতে উস্কে দেওয়া তাঁর স্মিত প্রশ্নটুকু: “এটা কেন হয় যে বৃষ্টিতেই স্মৃতির টান ওড়ে বেশি?” জবাবটাও এসেছিল তাঁর তরফে, যা বলেছিল, বৃষ্টি আসলে অগুনতি ইন্দ্রিয়ের এক মহতী সমবায়। আমাদের সংবেদন-নির্ঝর: যেমন আস্বাদ, দর্শন, স্পর্শ ও সঙ্গীত গলে গলে পড়ে বৃষ্টিবিন্দু ছুঁয়ে। রবিউলের সত্য এবং শঙ্খ ঘোষের সত্য তো এক নয়, সেটুকু জেনেও চকিত মনে পড়ে যায় এই বাক্য: “সমস্ত ইন্দ্রিয় যখন এইভাবে বন্দী করে নিজেকে ফিরিয়ে দেয় ভিতর দিকে, সেই ফিরে আসার প্রবলতায় মনের জড়তা যায় খুলে, গহ্বর থেকে উঠে আসতে থাকে পুরনো সব আমি। দেশকালেরই একটা বদল হয়ে যায় তখন। যে দেশ বা যে স্পেস আমার সামনে ছড়ানো, সেইটের সঙ্গে মিলে যায় এক সময়প্রবাহ।” এই আচম্বিত যোগাযোগেই, শ্রাবণরাত্রি হয়ে উঠবে সঘন, খুলে যাবে নিজেকে দেখার অন্তর্লীন সড়ক। উৎসর্গ কবিতাটি এই সময়বোধের মুসাবিদা।

ভোর এল ভয় নিয়ে, সে স্বপ্ন ভুলিনি এখনো।

স্থির অমাবস্যা, আমি শিয়রে দাঁড়িয়ে আছি দিগন্তের ধারে

আমার মূর্ধা যেন আকাশের মূর্ধা ছুঁয়ে আছে।

বুক থেকে হাতে খুলে নিয়েছি পাঁজর, আর তালে তালে নাচে সেই হাত

গ্রহনক্ষত্রের দল ঝমঝম শব্দে বেজে ওঠে।

স্তূপ হয়ে অন্ধকারে সোনারঙা সুর ওই ওঠে আর উঠে ঝরে পড়ে।

সেই সুরে খুলে যায় নামহারা গহ্বরের মৃতদেহগুলি

পিছনে অলীক হাতে তালি

অবসন্ন ফিরে দেখি ঘাসের উপরে শুয়ে আছে

পুরনো বন্ধুর দল

শিশির মেশানো শান্ত প্রসারিত হাতগুলি বাঁকা।

লাইনগুলির ভেতর রয়েছে আশ্চর্য শারীরিক সংবেদ। বাংলা কবিতায় এ-জাতীয় মনস্ক শরীরের দর্শন নিয়ে বোঝাপড়া করতে গিয়ে, জীবনানন্দ প্রসঙ্গে অরিন্দম চক্রবর্তী বলেছিলেন “অন্তর্মুখ দেহবোধ”। যেমন, জীবনানন্দের “ঘাসের ভেতর ঘাস হয়ে জন্মাই কোনও এক নিবিড়/ ঘাস-মাতার শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে” — এই ধরনের পংক্তিতে উঠে আসে বিচিত্র দ্বিত্বের আভাস, যা এক দিকে শারীরিকতার কথা বলে, অন্য দিকে তুলে ধরে সচেতন অহংবোধ। এই যে শ্লথ বেলপাতা, বালির গভীর তল আর অশান্ত ধানের কথা বললেন শঙ্খ ঘোষ — তা ওই ‘ঘাস’-এ উদ্ধৃত বিমর্শের সাবেক ঐতিহ্যেরই নতুন রণন জাগায়।

এই উষ্ণ ধানখেতে শরীর প্রাসাদ হয়ে যায়

প্রতিটি মুহূর্ত যেন লেগে থাকে প্রাচীন স্ফটিক।

কখনও মিশে যায় একাধিক ইন্দ্রিয়ের উচ্চার,

বসতি ফুরিয়ে গেছে, ঘন হয়ে বসেছি কজন

আমাদের ঘিরে আছে ঘনতর দেড়শো মন্দির

কোনও সমাগম নেই, সবুজ হয়েছে মরা জল

আগল খোলার শব্দে শিবলিঙ্গে বাদুড়ের ছায়া।

বা

সমস্ত রাত্রির প্রেত সঙ্গে নিই আর দেখি

তোমার শরীর নেই, তোমার আত্মাও আজ ঢেকে গেছে ঘাসে।

দেখি আমরা: ইন্দ্রিয়জাত সেই সব চকিত অভিজ্ঞানমালা থেকে ঝরে পড়ে এক-একটা প্রত্নস্মৃতি, যাকে মাপা যাবে না বাঁধা কোনও সময়ের অক্ষ বরাবর। অতীত থেকে ভবিষ্যৎমুখী রৈখিক কোনও সময়বোধ নয়, অভিজ্ঞতা হারিয়ে গেছে স্তব্ধ সময়ের চরাচরে। পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ জুড়ে, এই সময়হীনতার ধরতাই হিসেবে পুনরুত্থাপিত হতে থাকবে আত্মমৃত্যুর প্রচ্ছন্ন স্মৃতি। কখনও:

ঝাঁপ দিয়ে উঠে আসে কয়েক কয়েক বিন্দু জল।

আমার বুকের কাছে, নিশ্চিন্ত শকুন ডানা ঝাড়ে।

সবুজ, সবুজ হয়ে শুয়ে ছিল প্রাকৃত পৃথিবী

ভিতরে ছড়িয়ে আছে খুঁড়ে-নেওয়া হৃৎপিণ্ডগুলি।

আবার কখনও

ধমনী শিথিল জলে ভরে দেয় ঘূর্ণমান তারা

হাজার স্লিপিং পিল মাথার ভিতরে আত্মহারা।

কখনও চিত্রকল্প

শাদা অ্যাপ্রনের গন্ধে ক্লোরোফর্ম খোলে রুদ্ধ ও-টি

কখনও

আমারই নিজের হাতে নষ্ট করে দিয়েছি এ ঘর

হৃৎপিণ্ডে অন্ধকার ঢেলে দুই হাত বাড়িয়ে বলেছি: পান করো।

কালি ও কলম পত্রিকার সঙ্গে বছর কয়েক আগের এক আলাপচারিতায় বলেছিলেন শঙ্খ ঘোষ, “৫২ নম্বর কবিতায়, ঠিক স্বেচ্ছামৃত্যুর কথা না হলেও, একটা মৃত্যুজপের কথা আছে, আছে এমনকি স্লিপিং পিলের কথাও, কিন্তু তাহলেও এ প্রশ্নে উল্লিখিত ওই টুকরোগুলিতে যা আছে তা মূলত এক অবসাদভার, হৃৎপিণ্ডে অন্ধকারের বোধ, শাপগ্রস্ত দিনের ব্যর্থতার বোধ। সে বোধ তো মনে হয় আমার লেখায় আগাগোড়াই ছড়ানো আছে। জীবনের খুব কাছে যেতে গেলে এ-বোধ তো প্রায় অনিবার্য হয়ে ওঠে।”

লক্ষণীয়, জীবন শব্দটির ব্যবহার। কবিতার মানসশহরে থেকে থেকে যখন শূন্যের স্পেস বা মৃত্যুর সময় নির্মিত হয়, শঙ্খ ঘোষের বয়ানে বর্মের দেখা দেবে বিকল্প এক সময়বোধ: যা মৃত্যুর নয় — বরং, অকারণ আলস্যের। থেকে থেকে এই আলস্য শব্দের স্ট্র্যাটেজি ঘুরপাক খায় এই বইতে। বিশেষত, শেষ কবিতায়।

ঘিরে ধরে পাকে পাকে, মুহূর্তে মুহূর্ত ছেড়ে যাই

স্তব্ধ প্রসারিত-মূল এ আমার আলস্যপুরাণ।

তিনি না থাকার অব্যবহিত পরের কদিন, এলোমেলো, তাঁর একটি বই নিয়ে এটুকুই মনে হল।

কবি শঙ্খ ঘোষ – ছবি Wikipedia থেকে।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.