ফোনটা এল যথারীতি, কদিন ধরেই আবার আসতে শুরু করেছে কারো না কারো। আমার রোগীর অ্যাটেন্ডেন্টের ফোন। মাঝে দু মাস হাসপাতালের স্ক্রাব ছেড়ে আবার শার্ট প্যান্ট পরা শুরু করেছিলাম। এই সপ্তাহ থেকে আবার স্ক্রাবে ফিরে গেছি। মাথায় যেটুকু চুল আছে কামিয়েছি, হাসপাতালে চা, জল খাওয়া বন্ধ করেছি আবার গত এক বছরের মত। ফোনগুলো আসতে শুরু করেছে। আমার সব রোগীই ক্যান্সারের রোগী, করোনায় মৃত্যুহার ২% কিন্তু ক্যান্সারে অনেক বেশি। চিকিৎসা না হলে ১০০%। কিন্তু এই মানুষগুলোও নিরুপায়।

“ডাক্তারবাবু, আমার তো সোমবার রেডিয়েশন শুরু করার ডেট, কিন্তু করোনার যা অবস্থা… বুঝতেই তো পারছেন। আমার মেয়ে তো আমেরিকায়, আসতে পারছে না। সঙ্গে তো আমার ভাই যাবে শুধু… আমাদের দুজনেরই ষাটের উপর বয়স… একটা করে ভ্যাক্সিনের ডোজ পেয়েছি। একমাস টানা আসতে হবে… ভাইও ভয় পাচ্ছে… ওরও তো সংসার আছে। জোর করতে পারছি না।”

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

বিপত্নীক বছর সত্তরের ক্যান্সার রোগীর গলায় হতাশা। উনি জানেন চিকিৎসা না হলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু নিরুপায়।

এই ফোন গুলো আমি গত বছরও পেয়েছি অনেক। কেউ ঝাড়সুগুডা থেকে, কেউ করিমনগর, কেউ নেল্লোর, কেউ জলপাইগুড়ি, কেউ বর্ধমান। কেউ আবার রংপুর, কেউ চট্টগ্রাম। কারো অপারেশন, কারো কেমোথেরাপি, কারো রেডিয়েশন। লকডাউন, ট্রেন বন্ধ, ফ্লাইট বন্ধ, সীমান্ত বন্ধ। মহামারীর ভয়, হাসপাতালে আসতে ভয়, অনেক প্রত্যন্ত এলাকা থেকে কাছাকাছি কোন ক্যান্সার হাসপাতালে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। ফোনগুলো আসতে থাকল, ওঁরা জানাতে থাকলেন — রোগীর অবস্থা খারাপ হচ্ছে। ঠিক যেভাবে বিনা চিকিৎসায় ক্যান্সার ছড়ায়, পড়ার বইতে যেমন লেখা আছে, ঠিক তেমনি। ঠিক সেভাবে অনেকেই চলে গেলেন।

এঁদের মধ্যে অনেকেই সুস্থ হয়ে যেতেন, অনেকেই পুরো সুস্থ না হলেও বেশ কয়েক বছর বাঁচতেন। কারো ছেলেমেয়ে একটু বড় হয়ে যেত, কারো সংসারটা একটু সামলে যেত, কোন সন্তান তার মাকে আরো কিছুদিন পেত। হল না। আর সেগুলো আমি শুনলাম ফোনে। শুনলাম অসহায় সন্তানের আর্তি, অসহায় মা-বাবার আর্তনাদ। আমারই রোগী সবাই। শুধু শুনলাম, কিছুই করতে পারলাম না।

আবার ফিরে আসছে সেই সব দিন। ফোন বাজলে ভয় করছে, হাসপাতালের এমার্জেন্সির বিভাগ উপচে পড়ছে, বাইরে উৎকন্ঠিত রাশি রাশি মুখ। এক বছর কেটে গেল, কিছুই বদলাল না, কেউ কোন প্রস্তুতি নিল না। আবার একই ঘটনাক্রম। বেড নেই, ভ্যাক্সিন শেষ, অক্সিজেন শেষ, টেস্ট করার ল্যাব, কিট অপ্রতুল। হা-ক্লান্ত ডাক্তার, নার্স, অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা। প্রয়োজনের তুলনায় সবই অনেক কম। বক্তার পর বক্তা, জনসভার পর জনসভা, গাদা গাদা চার্টার্ড ফ্লাইট এল, কত হেলিকপ্টার উড়ল, কত কত মেলা হল। ভোট উৎসব চলছে চলছে চলছে।

ফোনগুলোও আসতে শুরু করেছে। নিরুপায় রোগী, অসহায় ডাক্তার।

সেভিং প্রাইভেট রায়ান বলে একটা ছবি দেখেছিলাম। প্রবল যুদ্ধে আহত ক্যাপ্টেন মাটিতে বসে একটা ছোট্ট পিস্তল হাতে, আর একটা ট্যাঙ্ক ধেয়ে আসছে। ক্যাপ্টেন গুলি ছুঁড়ছেন, জানেন ট্যাঙ্কের কিছুই হবে না, তাও ছুঁড়ছেন। আবহে কোন শব্দ নেই। গোলাগুলির শব্দ, যুদ্ধের শব্দ আর কানে ঢুকছে না। অবশ অনুভুতি, শ্মশানের নিস্তব্ধতা। আমারও ফোন বাজছে দেখছি। মন অবশ, রিং শুনতে পাচ্ছি না, ফোনগুলো ধরছি আর ঐ পিস্তল থেকে গুলি ছোঁড়ার মত বলছি “চেষ্টা করুন যদি ট্রিটমেন্টের জন্য আসতে পারেন। আমি বুঝতে পারছি, তা-ও চেষ্টা করুন।”

ছবি Wikipedia ও Japan Times এর website থেকে।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

1 মন্তব্য

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.