কাবেরী কর গুপ্ত
গত ২৬ ডিসেম্বর চলে গেল বিশিষ্ট প্রাণীবিদ ডঃ ডায়ান ফসির ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী। রোয়ান্ডার ভিরুঙ্গা পর্বতে তাঁর যে ফিল্ড স্টেশন ছিল, সেই কারিসোকের কেবিনেই ১৯৮৫ সালে নৃশংসভাবে খুন করা হয় এই বিখ্যাত গোরিলা বিশেষজ্ঞকে। আজকের মত সে যুগে ইন্টারনেট ছিল না, কিন্তু পশ্চিমি দুনিয়ায় এ খুনের খবর ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয়নি। প্রায় রাতারাতি তাঁর নামের পাশে বসে গেল ‘শহিদ’ তকমা। প্রচার করা হল, সাহসিনী বিজ্ঞানী আফ্রিকার পার্বত্য গোরিলাদের চোরাশিকারের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন।
এখনকার ভাষার যাকে ‘গ্লোবাল সাউথ’ বলা হয়, সে অঞ্চলের মানুষ আমি। অনেকের মতই আমারও তখন ডায়ান ফসিকে নিয়ে তেমন পরিষ্কার ধারণা ছিল না। মনে আছে, যখন ওয়াইল্ডলাইফ ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়ায় এমএসসি করতে গিয়েছি, তখন ওঁর সম্পর্কে ভালো করে জানলাম। আফ্রিকায় গোরিলাদের নিয়ে কাজ করতে করতে খুন হয়েছেন – এই ব্যাপারটা আমার কাছে মোটেই খুব ইতিবাচক বার্তা নিয়ে আসেনি। গবেষণার কাজ করতে গিয়ে একজন খুন হয়ে যাচ্ছেন, এ তো ভাবলেই ভয় লাগে! ফিল্ড বায়োলজি এমনিই যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে এরকম একটা খবরে আফ্রিকা, এপ প্রজাতি, সংরক্ষণ – সবকিছুর প্রতিই তখন একটা ভয় তৈরি হয়।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান
প্রিয় পাঠক,
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
পরে যখন পিএইচডি গবেষণার কাজে আমেরিকা গেলাম, ফসি আমার কাছে অন্য রূপে ধরা দিলেন। তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন বা তাঁকে সামনে থেকে দেখেছেন, এমন অনেকের সঙ্গেই দেখা হল। তাঁর গবেষণাপত্রগুলো পড়লাম। হাতে এল তাঁর বিখ্যাত স্মৃতিকথা গোরিলাজ ইন দ্য মিস্ট। ততদিনে এ ধারণা মোটামুটি সুপ্রতিষ্ঠিত যে, পার্বত্য গোরিলাদের বাঁচাতে গিয়ে শহিদ হয়েছেন ডায়ান ফসি, তাঁকে খুন করেছে চোরাশিকারীরাই। ১৯৮৮ সালে ওই বই থেকে সিনেমাও হয়ে গিয়েছে। তাঁর জীবন ও কাজ নিয়ে গল্প। চিত্রনাট্য বেশ শক্তিশালী, যদিও ছবিতে দেখানো বহু ঘটনাই কাল্পনিক।
ভারতে থাকাকালীন তাঁর মৃত্যুর ঘটনা আমাকে ভাবিয়েছিল। আর পশ্চিম দুনিয়ায় গিয়ে দেখি – তিনি সেখানে রীতিমত কিংবদন্তি। এই দুরকম অভিজ্ঞতার মাঝে পড়ে ডায়ান ফসিকে নিয়ে আমার কেমন যেন অস্বস্তি হত, একথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই।
ডায়ান ফসি কে? আফ্রিকা আর পার্বত্য গোরিলাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগটা ঠিক কীরকম?
পেশাগত জীবনের প্রথম দিকে মার্কিনী ডায়ান ফসি ছিলেন ‘অকুপেশনাল থেরাপিস্ট’, কাজ করতেন হাসপাতালের শিশু রোগীদের সঙ্গে, প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন ওই বিষয়েই। বরং যে বিষয়গুলোয় কাজ করে পরবর্তীকালে বিখ্যাত হলেন, সেই জীববিদ্যা, পরিবেশবিদ্যা বা প্রাইমেট বিজ্ঞানে কোনো প্রথাগত প্রশিক্ষণ তাঁর ছিল না। তাঁর প্রজন্মের বহু আমেরিকানের মতই তাঁরও আফ্রিকা সম্পর্কে কৌতূহল তৈরি হয় গণমাধ্যম আর সাহিত্যের সৌজন্যে। বিস্তীর্ণ জঙ্গল, সেখানে অদ্ভুতদর্শন সব জানোয়ার, আর সে জঙ্গলের ত্রিসীমানায় মানুষের বসতি নেই – পাশ্চাত্যের কাছে এই ছিল আফ্রিকার চিরায়ত ছবি।
১৯৬৩ সালের প্রথম দিকে ফসি একবার আফ্রিকায় গিয়েছিলেন। সেই সময়েই এক আলোকচিত্রী দম্পতির সঙ্গে জাইরে (আজকের কঙ্গো) বেড়াতে গিয়ে প্রথমবার পার্বত্য গোরিলাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ। তবে তার চেয়েও জরুরি সাক্ষাৎটা ঘটল লুই লিকির সঙ্গে। নৃতত্ত্ববিদ ও পুরানৃতত্ত্ববিদ লিকি তখন শিম্পাঞ্জি, গোরিলার মত এপ প্রজাতির উপর ফিল্ড স্টাডির বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করছেন। তাঁর মতে, মানব বিবর্তনকে বুঝতে গেলে এই ধরনের পর্যবেক্ষণ জরুরি। এ কাজের জন্য লিকির ‘স্বাভাবিক’ পছন্দ ছিলেন সাদা চামড়ার মহিলারাই। প্রথাগত বিদ্যায়তনিক ডিগ্রি থাকুক বা না থাকুক, অদ্বিতীয় লুই লিকির পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে ফিল্ড সাইটে কাজ করা আটকায় কে?
ফসির কিছুটা আগে, লিকির পরামর্শে শিম্পাঞ্জিদের নিয়ে কাজ করা শুরু করেন জেন গুডঅল (যিনি কিছুদিন আগেই প্রয়াত হলেন)। গুডঅলের মতই ফসিও লিকির সুপারিশ পেয়ে গেলেন। ১৯৬৭ সালে পাড়ি দিলেন জাইরে। ভিরুঙ্গা ন্যাশনাল পার্কের ভিতরে গড়ে তুললেন নিজস্ব ফিল্ড প্রোজেক্ট। লিকি ছিলেন প্রভাবশালী ব্যক্তি। গবেষণা জগতে তো বটেই, রাজনীতি ও পয়সা জোগানোর মহলেও তাঁর যথেষ্ট যোগাযোগ ছিল। তার জোরে প্রয়োজনীয় পুঁজি আর অনুমতি পেতে সমস্যা হল না ফসির। তাঁর জায়গায় একজন আফ্রিকান বা এশীয় গবেষক থাকলে এসব যে এত সহজে হত না, তা বলাই বাহুল্য।
ফসি যে সময়ে ভিরুঙ্গাতে পৌঁছন, সেখানকার মানুষজন, ভূ-প্রকৃতি আর জঙ্গল সম্পর্কে অল্পস্বল্প জানতেন। কিন্তু ওই অঞ্চলের সমাজ-সংস্কৃতি বা রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে প্রায় কোনো ধারণাই ছিল না তাঁর। তবে সাহস ছিল দুর্জয়, আর ছিল অসহ্য কষ্ট সয়ে টিকে থাকার ক্ষমতা।
একাধিক প্রাচীন আগ্নেয়গিরির সমাহার এই ভিরুঙ্গা পর্বতশ্রেণি। ছড়িয়ে আছে রোয়ান্ডা, উগান্ডা আর কঙ্গো – এই তিন দেশ জুড়ে, ৫০০০-১৪০০০ ফিট উচ্চতায় ঘন জঙ্গল। ঠান্ডা, কুয়াশাচ্ছন্ন, স্যাঁতসেঁতে, মেঘ-বৃষ্টির অবিরাম লুকোচুরি। জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে মধ্য আফ্রিকার এই বনাঞ্চল বেশ স্বতন্ত্র। পার্বত্য গোরিলাদের একমাত্র বাসভূমি এখানকার ঘন জঙ্গল। গোরিলারা সামাজিক প্রাণী, তবে দীর্ঘদিন এমন নির্দিষ্ট আবহাওয়ায় থাকতে থাকতে তাদের গতিবিধি ভিরুঙ্গাতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে, অন্যত্র কোথাও সরে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। চরম ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতার কারণে তারা তখন নানাভাবে বিপন্নও বটে। তার উপর আছে চোরাশিকার, মহামারি, রাজনৈতিক সংঘর্ষের ভয়। ওদিকে সংরক্ষিত এলাকায় মানুষের আনাগোনা বাড়ছে।
ফসি যখন সে পাহাড়ে কাজ করতে গিয়েছেন, রোয়ান্ডা তখন আফ্রিকার স্থলবেষ্টিত এক ছোট্ট দেশ, কিন্তু জনঘনত্ব অনেক। প্রতিবেশী উগান্ডা বা জাইরের তুলনায় রোয়ান্ডার রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন মোটামুটি স্থিতিশীল। কিন্তু দেশজুড়ে জমির তীব্র ঘাটতি আর গ্রামীণ দারিদ্র্যের জোড়া সংকট মানুষকে ক্রমশ জঙ্গলনির্ভর করে তুলল। স্বাভাবিকভাবেই সে চাপটা এসে পড়ল সংরক্ষিত এলাকায়। কিন্তু একথা মনে রাখতে হবে, এই ‘অনুপ্রবেশ’ বন্যপ্রাণীর প্রতি ঔদাসীন্য থেকে নয়, বরং বাধ্য হয়ে।
গবেষণা এবং খ্যাতি
সে সময়ে বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় প্রাইমেটদের তালিকায় পার্বত্য গোরিলাদের অবস্থান বেশ উপরে, সংখ্যাটা কমতে কমতে চার-পাঁচশোতে এসে ঠেকেছে। এই প্রজাতির গোরিলাদের উপর প্রথম বিস্তারিত ফিল্ড স্টাডি করেছিলেন বিজ্ঞানী জর্জ শ্যালার, ১৯৫৮-৫৯ সালে। কিন্তু ফসির কাজের ধরন ছিল আরও গভীর এবং দীর্ঘ পর্যবেক্ষণনির্ভর।
একসময়ে জাইরেতে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হলে তাঁকে সেই দেশ ছাড়তে হয়। সেইসময়েই রোয়ান্ডায় পাড়ি দেন। মাউন্ট কারিসিম্বি আর মাউন্ট ভিসোকের মাঝামাঝি ১০,০০০ ফুট উচ্চতায় গড়ে তোলেন কারিসোকে গবেষণাকেন্দ্র। একে অত উঁচু, জনবিচ্ছিন্ন জায়গা, তার উপর সর্বক্ষণের বৃষ্টির কারণে কনকনে ঠান্ডা, পরিকাঠামোও নামমাত্র। সবমিলিয়ে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি মোটেই অনুকূল ছিল না। অমন একটা জায়গায় পড়ে থেকে কাজ করতে গেলে প্রয়োজন ছিল অদম্য মানসিক জোর। সেটা ফসির ছিল।
আগেই বলেছি, গবেষণার জন্য ফসি নির্ভর করছিলেন দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের উপর। সেইমতই কাজ শুরু। প্রত্যেক দিন ফিল্ডে যান, গোরিলাদের আচার আচরণ নকল করেন। বছর ঘুরে যায়, তবু ধৈর্য হারান না। দুবছরেরও বেশি লেগে গেল শুধু গোরিলাদের কাছাকাছি পৌঁছতে। ধীরে ধীরে শুরু হল পরবর্তী পর্যায়। প্রত্যেককে আলাদা করে চিহ্নিত করলেন, আলাদা আলাদা নাম দিলেন, জন্ম-মৃত্যুর হিসাব রাখা শুরু করলেন। গোরিলাদের যূথবদ্ধ জীবনযাপন সম্পর্কেও নোট রাখা শুরু হল। সামগ্রিক কাজে কেটে গেল আরও অনেকগুলো বছর। তারপর এক সময়ে বাইরের পৃথিবীর কাছে নতুন পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করল ভিরুঙ্গার গোরিলারা। ততদিনে ডিজিট, বেটোফেন, আঙ্কল বার্ট, মাচো, কোকো – এমন নানা নামকরণ হয়েছে তাদের। কেবল নামই নয়, প্রত্যেকের যে নিজস্ব ব্যক্তিত্ব রয়েছে, ইতিহাস রয়েছে, সে সম্পর্কেও মানুষকে ওয়াকিবহাল করলেন ফসি। এহেন চিহ্নিতকরণের বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব অপরিসীম। গোরিলাদের আচার আচরণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা গেল তো বটেই, সহমর্মিতার দৃষ্টিকোণ থেকেও এর গুরুত্ব কম নয়।
কিন্তু সমস্যা হল অন্য জায়গায়। কাজ করতে করতে গোরিলাদের সঙ্গে মানসিকভাবেও এতটাই জড়িয়ে পড়লেন তিনি যে, একসময়ে ভাবতে শুরু করলেন, ওখানে তিনিই মালিক। এদিকে যে দলগুলোর উপর তিনি গবেষণা করছিলেন, তাদের অনেক সদস্যই পরে নিহত হয়েছে। কেউ মরেছে চোরাশিকারীর গুলিতে, কেউ অ্যান্টিলোপ-ধরা ফাঁদে আটকা পড়েছে, তাকে বাঁচানো যায়নি।
তবে যা বলছিলাম, এই গবেষণার বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। গোরিলাদের সম্পর্কে মানুষ বরাবরই ভেবে এসেছে, তারা যেমন হিংস্র, তেমনই আক্রমণাত্মক। ফসির গবেষণা দেখাল, ওরা আসলে স্বভাবগতভাবে শান্ত। ওদেরও একটা সামাজিক জীবন রয়েছে। প্রতি পরিবারের মাথায় থাকে একজন পুরুষ সিলভারব্যাক। পারিবারিক বন্ধনও বেশ মজবুত। এই অনুসন্ধানের ফলে গোরিলাদের সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাল, সংরক্ষণের ব্যাপারেও সচেতনতা বাড়ল। অবশ্য একথাও জানিয়ে রাখা ভালো, সামগ্রিক গবেষণাটি বৈজ্ঞানিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলেও তথ্য সংগ্রহের কাজটি পদ্ধতিগতভাবে প্রশ্নাতীত নয়।
এই প্রসঙ্গে তাঁর জগৎজোড়া খ্যাতিও প্রশ্নের মুখে পড়বে। শুধুমাত্র বিজ্ঞান গবেষণা তাঁকে ওই খ্যাতি এনে দেয়নি। আফ্রিকার নির্মম অরণ্য-পরিবেশে একলা শ্বেতাঙ্গ মহিলা প্রভূত কষ্ট সয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন – এমন একখানা নায়কোচিত ভাবমূর্তি নির্মাণে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের বিরাট অবদান ছিল। এ ধরনের শক্তিশালী ভাবমূর্তি নির্মাণ আসলে এক সচেতন রাজনীতির অংশ, যে রাজনীতি প্রাণী সংরক্ষণের মত যৌথ, রাজনৈতিক কাজকে দিব্যি ব্যক্তির আত্মত্যাগের সমার্থক করে তোলে। বিজ্ঞানী হিসেবে ডায়ান ফসির যে দ্রুত উত্থান, তার নেপথ্যেও ওই ব্যক্তিপুজোর রাজনীতি।
বিজ্ঞানী থেকে শহিদ
এহেন ডায়ান ফসির কর্মযজ্ঞে নাটকীয় মোড় এল ১৯৭৭ সালে। চোরাশিকারীদের হাতে নিহত হল তাঁর প্রিয় সিলভারব্যাক গোরিলা ডিজিট। শিকারের ট্রফি হিসাবে তখন বাজারে গোরিলাদের হাত আর মাথার ব্যাপক চাহিদা, সম্ভবত সেই কারণেই মারা হয়েছিল ডিজিটকে। তবে কেবল চোরাশিকারের কারণেই নয়, অন্যান্য প্রাণীর জন্য পাতা ফাঁদে আটকা পড়েও গুরুতর জখম হত গোরিলারা। ফসি গোটা ব্যাপারটাকেই দেখলেন অন্যভাবে। তাঁর কাছে ডিজিটের মৃত্যুটা হয়ে দাঁড়াল ব্যক্তিগত বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। রীতিমত অস্তিত্বের সংকট।
এই ঘটনার পর থেকে বদলে গেলেন তিনি। এতদিন মোটামুটি ‘নিষ্ক্রিয়’ সংরক্ষণেই কাজ চালিয়ে নিচ্ছিলেন, এবার প্রবলভাবে ‘সক্রিয়’ হয়ে উঠলেন। চোরাশিকার আটকাতে জঙ্গলে টহলদারি পাহারার ব্যবস্থা হল। ফাঁদ পাতা হলে তাও নষ্ট করে দেওয়া হত। তবে তাঁর বিরুদ্ধে আরও গুরুতর অভিযোগ – চোরাশিকার দমনের নামে আশেপাশের গ্রামগুলোতে যথেচ্ছ অত্যাচার চালিয়েছে তাঁর দল। নানা বিবরণ থেকে জানা যায়, কেবল সন্দেহের বশে বহু গ্রামবাসী শারীরিক নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। তাঁদের ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, এমনকি ছাড় পায়নি পরিবারের শিশুরাও।
তাঁর জীবৎকালেই এসব ঘটনা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু ফসির মৃত্যু পরবর্তী উদযাপনের প্রাবল্যে এসব অভিযোগ, বিতর্ক স্বভাবতই ধোপে টেঁকেনি। উলটে খুনের বীভৎসতাকে সামনে রেখে দিব্যি তাঁকে শহিদও বানানো হয়েছে। এ ধারণাও পাকাপোক্ত হয়ে যায় যে, তিনি যা করেছেন ঠিক করেছেন। অথচ সংরক্ষণের জন্য যে দমননীতিতে তিনি বিশ্বাস করতেন, তা নিয়ে একটিবারের জন্যও প্রশ্ন তোলা হয়নি।
মৃত্যু পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ ও কিছু অস্বস্তিকর সত্য
অবশেষে সেই প্রশ্ন উঠল ১৯৮৬ সালে। ভ্যানিটি ফেয়ার পত্রিকা সেপ্টেম্বরের মাসিক সংখ্যায় একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। ফসির মৃত্যুর পর ততদিনে প্রায় নমাস কেটে গিয়েছে, তাঁর ওই আত্মত্যাগী ভাবমূর্তিটিও মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। এহেন আখ্যান নির্মাণের প্রকল্পে জোর ধাক্কা মারে অ্যালেক্স শুমাটফের ওই লেখাটি। ফসি সম্পর্কে একেবারে উলটো ছবি তুলে ধরেন তিনি। সেখানে জানানো হচ্ছে, ফসি ছিলেন স্বার্থপর, সন্দেহপ্রবণ এবং চূড়ান্ত কর্তৃত্ববাদী – সরকার বা স্থানীয় মানুষের সঙ্গে তো বটেই, বারবার সংঘর্ষে জড়িয়েছেন সহকর্মীদের সঙ্গেও।
শুমাটফের লেখাটি যে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, তার অকাট্য প্রমাণ চারবছর পরে প্রকাশিত অভিজ্ঞ সাংবাদিক হ্যারল্ড পি হেসের লেখা দ্য ডার্ক রোম্যান্স অফ ডায়ান ফসি বইটি। সাংবাদিকসুলভ দক্ষতায় বিস্তর গবেষণা করে হেস বইটি লিখেছিলেন। জরুরি তথ্যের জন্য কথা বলেছিলেন ফসির ছাত্রছাত্রী, সহকর্মী, সাংবাদিক, স্থানীয় রোয়ান্ডাবাসীদের সঙ্গে। তাঁরা হেসকে জানিয়েছিলেন, ফসির প্রবণতাই ছিল ভয় দেখানো আর কথায় কথায় লোককে অপমান করা। তার উপর বইটি পড়লেই বোঝা যায় – এ কোনো বিচ্ছিন্ন অতিরঞ্জন নয়, বরং এক অসুস্থ সংরক্ষণ মডেলের গবেষণালব্ধ আখ্যান। সেই মডেল দাঁড়িয়েই ছিল চূড়ান্ত ভীতি প্রদর্শন আর কর্তৃত্ববাদের উপর।
আরো পড়ুন শুধু শিম্পাঞ্জি নয়, মানুষকে দেখার চোখও বদলে দিয়েছেন জেন গুডঅল
কেলি স্টুয়ার্ট, স্যান্ডি হারকোর্ট, ইয়ান রেডমন্ড, ডেভিড ওয়াটস এবং এমি ভেডারের মত ফসির কয়েকজন ছাত্রছাত্রী এবং সহকর্মীও পরবর্তীকালে জানিয়েছিলেন, কারিসোকে সেন্টারে কোনো সুস্থ কাজের পরিবেশ ছিল না। কোনো বিষয়ে কেউ দ্বিমত প্রকাশ করলে তাকে সন্দেহ করা হত, স্বাধীন চিন্তাভাবনার এতটুকু পরিসর ছিল না। গোরিলা গোষ্ঠীদের সম্পর্কে সংগৃহীত তথ্যের উপরেও কড়া নিয়ন্ত্রণ রাখতেন ফসি, চাইলেই ব্যবহার করার সুযোগ ছিল না। যতদিন ফসি ছিলেন, অমন ভয় আর প্রশ্নহীন আনুগত্যের অনুশীলন কারিসোকেতে কোনো গবেষণার অনুকূল যৌথতার পরিবেশ গড়ে তুলতে পারেনি। পুরোটাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল ফসির কর্তৃত্ব প্রদর্শনের কেন্দ্র।
অবধারিত ফলাফল? বিজ্ঞান গবেষণায় ফসির মনোযোগ আরও বেড়েছিল ঠিকই, কিন্তু মানুষের থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন।
উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারত ও আফ্রিকায় প্রাণী সংরক্ষণ: একটি তুলনা
ধরা যাক, ভারতের অরণ্য সংরক্ষণের বিষয়ে ওয়াকিবহাল কেউ ফসির এসব কীর্তিকাহিনি পড়ছেন। সেক্ষেত্রে পুরো ধাঁচটাই তাঁর কাছে অবিশ্বাস্য রকমের চেনা ঠেকবে। উপনিবেশবাদ যেভাবে সংরক্ষণকে সংজ্ঞায়িত করে, আমাদের দেশের সংরক্ষণ নীতি সেই সংজ্ঞা মেনেই তৈরি। সেই নীতি জঙ্গলবাসী মানুষকে ভিটেছাড়া করেছে, তাদের জঙ্গলনির্ভর জীবনধারণকে অপরাধ বলে চিহ্নিত করেছে। সঙ্গে ঘোষণা করেছে, জঙ্গলের পরিসরকে মানুষের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের নামে এতবছর ধরে আসলে যা ঘটে এসেছে, তাকে এককথায় উৎখাত আর পুলিশি নজরদারি ছাড়া কিছুই বলা যায় না।
ফসির চিন্তাধারা এই ঔপনিবেশিক যুক্তি-ভাবনার সঙ্গে দিব্যি খাপ খেয়ে যায়।আজকের দিনের বহু চিন্তাবিদই তাঁর অবদানকে ভিন্ন চোখে দেখছেন। তাঁদের বক্তব্য, পশ্চিমা পুঁজিতে পুষ্ট যে ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে ফসি কাজ করেছেন, সে ব্যবস্থায় আফ্রিকার মানুষের কণ্ঠস্বর জায়গা পায় না। সে ব্যবস্থা প্রাণী সংরক্ষণের নামে মানুষের উপর অত্যাচার করে। এই চিন্তাবিদদের মধ্যে রাজনৈতিক পরিবেশবিদ, নারীবাদী তাত্ত্বিক, উপনিবেশবাদবিরোধী চিন্তক – সকলেই আছেন।
বিজ্ঞান গবেষক হিসাবে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র – এই দুই দেশেই কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে আমার। আমার পক্ষে কোনোভাবেই এই ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গিকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। নারী বলেও ফসিকে নায়ক বা ব্যতিক্রমী হিসাবে তুলে ধরার একটা চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু তাতেও তাঁকে ছাড় দেওয়া চলে না। কারণ ওই ভাবমূর্তি নির্মাণ ও মহিমাকীর্তনের বিকৃত অনুশীলনের আড়ালে প্রতিনিয়ত চাপা পড়ে গিয়েছে স্থানীয় মানুষের পরিশ্রম, জ্ঞান আর বঞ্চনার দীর্ঘ ইতিহাস।
অবদানের পুনর্মূল্যায়ন
মৃত্যুর পর চল্লিশ বছর কেটে গেল, কিন্তু ফসিকে নিয়ে বিতর্ক বোধহয় চিরকালীন। তাঁর কাজ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। আজ পার্বত্য গোরিলারা যে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, তার অন্যতম কারণ তিনি। ফসিই তো প্রথম গোরিলাদের সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণায় বদল এনেছিলেন। গবেষণাকেন্দ্র হিসাবে তাঁর প্রতিষ্ঠিত কারিসোকে রিসার্চ স্টেশনও যথেষ্ট সক্রিয়। ফসির পর ফিল্ড ডিরেক্টর হয়েছিলেন কেলি স্টুয়ার্ট। গোরিলাদের আচরণ, পরিবেশ, সংরক্ষণ নীতি নিয়ে সেখানে ধারাবাহিক কাজ চলছে। গোরিলা পর্যটনের মত নতুন ধাঁচের কাজ শুরু হয়েছে, স্থানীয় মানুষও যোগ দিয়েছেন, সর্বাঙ্গীণ সংরক্ষণের ফলে ভিরুঙ্গাতে গোরিলাদের সংখ্যাও বর্তমানে বেড়েছে। ফসির জীবদ্দশাতেই তাঁর ছাত্রছাত্রীরা এই ধরনের দীর্ঘস্থায়ী মডেলের প্রস্তাব করেছিলেন, কিন্তু তাঁর তীব্র আপত্তিতে সেসব প্রস্তাব পত্রপাঠ নাকচ হয়ে গিয়েছিল।
আসলে কাজ নিয়ে তাঁর আবেগ থাকলেও কোনো নৈতিক স্বচ্ছতা ছিল না। মানববিদ্বেষের অজুহাত পশুপ্রেম কেন হবে – সেই প্রশ্নে ফসির পদ্ধতিকে ক্ষতিকর বলা ছাড়া উপায় থাকে না।
ভারত, আফ্রিকা, গ্লোবাল সাউথের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সংরক্ষণ নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। ভয় বা উৎখাতের উপর নির্ভর করে সংরক্ষণ চলতে পারে না। সংরক্ষণ হোক যৌথতা, দায়বদ্ধতা আর সচেতনতাকেন্দ্রিক। বিজ্ঞানচর্চার চরিত্রেও বদল আনার প্রয়োজন আছে। তা কঠোর হোক, ক্ষতি নেই – কিন্তু আত্মসমালোচনার দরজাও খোলা থাকুক।
ফসিকে মনে রাখার জন্য তাঁর চরিত্র শুদ্ধিকরণের কোনো দায় আমাদের নেই। সংরক্ষণের ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায়টাকে প্রশ্ন করতে গিয়ে সেই পুরনো কথাটাই আবার মনে এল – মানবাধিকারের প্রশ্ন বাদ দিয়ে পরিবেশ রক্ষার ভাবনা অসম্ভব।
নিবন্ধকার পেশায় বন্যপ্রাণী জীববিজ্ঞানী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনা মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল সায়েন্সেসের সঙ্গে যুক্ত। মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।








