শুভাশিস মৈত্র
সময়টা ১৯৮১। তখন তালতলায় এক বন্ধুর ফাঁকা ফ্ল্যাটে বইপত্র সহ মাটিতে চাদর পেতে ঘুমাই। খাওয়া দাওয়া, যখন যেমন জোটে। মাঝেমাঝে সেখানে আসত আমার থেকে বছর আটের বড়, যদিও নাম ধরে ডাকতাম, রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়। রাঘবের তখন বাদার গল্প, কমুনিস উপন্যাস বেরিয়ে গেছে, আমাদের চোখে এক বিরাট সম্ভাবনাময় লেখক (হয়েওছিল তাই)। সেই সময় সবে আজকাল পত্রিকা বেরিয়েছে। সম্পাদক গৌরকিশোর ঘোষ। বইমেলায় সামান্য পরিচয় হয়েছিল, শ্রদ্ধার সঙ্গে কথা বলেছিলাম, জরুরি অবস্থায় প্রতিবাদী লেখা লিখে জেল খেটেছেন বলে।
রাজনীতির জন্য জেল খাটা ব্যাপারটা আমাদের পরিবারে পরিচিত ছিল। আমার দুই কাকা স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে জেল খেটেছিলেন বেশ কয়েক বছর। কিন্তু লেখার জন্য, মতপ্রকাশের জন্য জেল খেটেছেন এমন মানুষ প্রথম দেখলাম গৌরকিশোরকে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
রাঘব বলল, গৌরদা নতুন ছেলেমেয়েদের লেখা চাইছেন। ফলে কাজে নেমে পড়লাম। লেখা তৈরি করে একদিন দুপুরে রাজা রামমোহন সরণীর অফিসে গিয়ে গৌরদার হাতে দিয়ে এলাম। একদিন সকালে দেখলাম লেখাটা পাঁচের পাতায় বেশ বড় করে ছাপা হয়েছে। নীচে আমার নাম। লিটল ম্যাগাজিনে তার আগে লিখেছি। কিন্তু খবরের কাগজে সেই প্রথম। লেখা বেরিয়েছে, বিকেলের দিকে চলে গেলাম আজকাল দফতরে। অ্যাকাউন্টস বিভাগে জানতে চাইলাম লেখার টাকা কবে পাব? তখন আজকালে অ্যাকাউন্টস বিভাগে কাজ করতেন স্যার আশুতোষের নাতি জনতোষ মুখোপাধ্যায়। জনতোষবাবু শুনে হেসে ফেললেন। বললেন তিনমাস বাদে আসবেন। বেরনোর সময় গৌরদার সঙ্গে দেখা করলাম। বললেন, “আরও লেখ”। ভয়ে ভয়ে বললাম, টাকাটা তাড়াতাড়ি পেলে ভাল হত, খুব দরকার। চায়ের কাপে চুমুক দিতে যাচ্ছিলেন। কাপটা নামিয়ে রেখে ফোন তুলে কাকে যেন বললেন “শুভাশিসের টাকাটা দিয়ে দাও। ওর খুব দরকার।” আমাকে বললেন “যা অ্যাকাউন্টসে গিয়ে টাকাটা নিয়ে আয়।” ১৫৫ টাকা নিয়ে চলে গেলাম কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে।
গৌরদার লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় স্কুলে থাকতে। প্রথম পড়ি নাচের পুতুল বই। তার পর ব্রজদার গুল্প। দুটো বইই ভাইবোনদের কেউ স্কুল থেকে পুরস্কার হিসাবে পেয়েছিল। তার অনেক বছর পরের কথা। জরুরি অবস্থা সবে জারি হয়েছে। ছদ্মনামে কবিতা, প্রবন্ধ লিখছি লিটল ম্যাগাজিনে। সেই সময়ে গড়িয়াহাটে বেশ বড় একটা লিটল ম্যাগাজিনের দোকান ছিল। শঙ্করের দোকান। একদিন সকালে শঙ্করের দোকানে দাঁড়িয়ে জ্যোতি দত্ত সম্পাদিত কলকাতা পত্রিকায় গৌরদার লেখার পাতা ওলটাচ্ছি, দেখলাম, বেশ ষণ্ডা মতো দুটো লোক এসে পত্রিকাটার সবকটা কপি স্টল থেকে তুলে নিল, একজন আমার হাতের পত্রিকাটাও না বলে হ্যাঁচকা টান মেরে নিয়ে নিল। এই অসভ্যতা দেখে আমি বেশ জোরে চেঁচিয়ে উঠলাম। লোক দুটো বলল, বইটা “ব্যান” হয়েছে। আমি বললাম, ব্যান হয়েছে তো আপনি নিচ্ছেন কেন? ওদের মধ্যে একজন বলল “আমরা স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোক।” আর কথা না বাড়িয়ে চলে এলাম।
পরে জরুরি অবস্থা উঠল। গৌরকিশোর ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পেলেন। প্রস্তুতি হয়ত আগে থেকেই চলছিল। গৌরদা আজকাল শুরু করলেন ১৯৮১ সালে। গৌরদা ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়পন্থী বাম। রয়িস্ট বলা হত ওঁদের। রয়িস্টরা বামপন্থার সঙ্গে গণতন্ত্র এবং মানবতাকে মেলানোর চেষ্টা করেছিলেন। মানবেন্দ্রনাথ রায়, যিনি এম এন রায় নামেই বেশি পরিচিত, ছিলেন এক বিস্ময়কর মানুষ। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, ১৯২০ সালে শ্রমিকশ্রেণির গণআন্দোলনের প্রথম মঞ্চ ‘নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’, সে বছরই গান্ধীর ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলন। পাশাপাশি সক্রিয় সশস্ত্র বিপ্লব প্রচেষ্টা। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় বিশ্ব কংগ্রেসে যোগ দিতে লেনিনের আমন্ত্রণে ওই ১৯২০ সালেই মে মাসে মস্কো পৌঁছেছিলেন সস্ত্রীক মানবেন্দ্রনাথ। ২৪ পরগনার আরবালিয়া গ্রামের নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, মানবেন্দ্রনাথ রায় ছদ্মনাম নিয়ে পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমেরিকা, মেক্সিকো হয়ে মস্কো এলেন। মেক্সিকো এবং ভারত, দুটো দেশেরই কমিউনিস্ট পার্টির তিনি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। পরে কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে তৈরি করেন র্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট দল, যার মূল কথা মানবতা। গৌরকিশোর ছিলেন সেই দলের সমর্থক। বামপন্থীরা গৌরদাকে পছন্দ করতেন না। অনেকে তাঁকে আড়ালে সিআইএ-র লোক বলতেন। নকশালরা তাঁকে হুমকি দিতেন। কংগ্রেসিরা তাঁকে জেলে বন্দি করে রেখেছিলেন জরুরি অবস্থার সময়। যাঁরা তাঁর বাড়িতে গেছেন, তাঁদের কাছে শুনেছি অতি সাধারণ জীবনযাপন ছিল গৌরকিশোরের। জীবনে কখনো কলের মিস্তিরি, কখনো বাস কনডাক্টর, নানা পেশায় কাজ করেছেন। কাউকে ভয় পেতেন না। কংগ্রেস, সিপিএম — সব দল তাঁর লেখায় সমানভাবে সমালোচিত হত। তিনি স্তালিনবাদী সমাজতন্ত্র, যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই, গণতন্ত্র নেই, তেমন সমাজের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, ভোট শেষ কথা নয় গণতন্ত্রে, মানুষের সম্মতি নিয়ে রাষ্ট্রকে চলতে হবে। তাই তিনি মানচিত্রের যে দেশ, সেই দেশের প্রতি ভালবাসার থেকেও বেশি গুরুত্ব দিতেন দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসাকে। বিশ্বাস করতেন নাগাল্যান্ড, কাশ্মীরের সমস্যা বন্দুক দিয়ে মিটবে না, সেখানকার মানুষের সম্মতি আদায় করতে হবে মানবিক সমাধানসূত্র দিয়ে।
কাগজের কথায় ফেরা যাক। গৌরকিশোর ঘোষ আজকাল (ক্যালিগ্রাফি: সত্যজিৎ রায়) নামে যে বাংলা কাগজ করেছিলেন তাতে একটা নতুন ভাবনার ছাপ ছিল প্রথম থেকেই। কীরকম বলি। একটা রিপোর্ট এল, প্রত্যন্ত গ্রামের এক কৃষক বাঁশ দিয়ে নলকূপ বানিয়েছেন। সেই খবর প্রথম পাতায় বড় করে ছাপা হল। এখন এরকম খবর প্রথম পাতায় বেরোয়, তখন বেরোত না। বা কোনও পাঠকের একটা গুরুত্বপূর্ণ চিঠি, সেটাই ‘লিড’ খবর হল প্রথম পাতায়। কোনোদিন বিরাট ছবি বেরলো প্রথম পাতা জুড়ে, ‘সভ্য’ কলকাতা শহরে দিনের আলোয় সার দিয়ে বাবুরা পেচ্ছাপ করছেন। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সেই ছবি দেখে অনেকেই বিরক্ত হয়েছিলেন। বা ধরুন একটা লেখা ছাপলেন, কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতন যেতে রাস্তার দু ধারে যে সব গাছ দেখা যেত দশ বছর আগে, সেই গাছের সারি থেকে কোনো কোনো গাছ হারিয়ে গিয়েছে।
নেতাদের বিবৃতি দিয়ে গৌরকিশোর কাগজের পাতা ভরাতে চাননি। তিনি অনেক এগিয়ে ভেবেছিলেন। বাঙালি তার জন্য প্রস্তুত ছিল না। বাঙালি অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে কংগ্রেস-সিপিএম-বিজেপি-তৃণমূলে মেতে থাকতে। ফলে বাঙালি গৌরকিশোরকে গ্রহণ করতে পারেনি। তাঁর সময়ে আজকাল কাগজের বিক্রি ছিল খুবই কম। তার পর তাঁর সহকর্মী আরেক ‘রয়িস্ট’, বিখ্যাত সাংবাদিক হামদি বে-র চাকরির শর্ত ইত্যাদি নিয়ে মালিকের সঙ্গে বিরোধে গৌরকিশোর আজকাল ছেড়ে আনন্দবাজারে ফিরে যান।
আরো পড়ুন সত্যান্বেষী পাঠক জাগুন, সরকারি বিজ্ঞাপন পেতে গেলে ইতিবাচক খবর লিখতে হবে
গৌরকিশোরের সাহিত্য প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখ করা হল না। এত অল্প কথায় তা যেমন হবে না, সেটা লেখার জন্য যোগ্য লোকও আমি নই। গৌরকিশোরের কলম, রূপদর্শী, ঝাঁকি দর্শন, গৌড়ানন্দ কবি ভনে — এসব আজকের দিনে ভাবা যায় না। তাঁর ‘পলিটিক্যাল স্যাটায়ার’ লেখায় অনুপ্রাণিত হয়ে বর্তমান সাপ্তাহিকে টানা দু বছর আমি লিখেছিলাম ‘রাজনীতি-টাজনীতি’ কলম (পরে দু খণ্ডে প্রকাশিত)। পরে রাজনৈতিক চাপেই সেটা বন্ধ হয়ে যায়। বাংলা সাংবাদিকতায় শাসককে নিয়ে হাসিঠাট্টা করার চল উঠে গিয়েছে।
নিবন্ধকার বরিষ্ঠ সাংবাদিক ও সম্পাদক। মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
শিরোনামের সঙ্গে লেখার বিষয়বস্তুর দূরত্ব ঘুচলো না। গৌরকিশোর এর সাহিত্য আলোচনা ব্যতীত এবং তাঁর রাজনৈতিক মনন এর আলোচনা ছাড়া বাঙালি কেন গৌরকিশোর ঘোষ কে বুঝতে পারলোনা এই আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়