সোহম দাস

আমাদের এখানে ভোট হল রবিবার। পৌরসভার নির্বাচন। ফেব্রুয়ারি শেষের সেই সকালটা রবিবারেরই মত। চারিদিকে আগন্তুক বসন্তের আলস্য। আমার বাড়ির সামনের পুকুরপাড়ের যজ্ঞিডুমুরের গাছটা এখন ন্যাড়া। অত বড় পাতার ভার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে যে সারা বছর, তাকে কীরকম নগ্ন মনে হয় দেখলে। অবশ্য এই নগ্নতা থাকবে না বেশিদিন, আর কয়েকদিন পরেই দেখব পাতায় পাতায় ছেয়ে গেছে তার ঋজু শরীর। স্বাভাবিক লাগবে তখন। আর চোখে পড়বে না তাকে।

ভোট দিতে গিয়েছিলাম। ফাঁকা, নিস্তরঙ্গ ভোটগ্রহণ চলছে। যাওয়ার রাস্তায় বসে রয়েছে শুধু শাসক দলের কর্মীরা। কাজ তেমন নেই। ভোটাররাও বুঝি তেমন উৎসাহী নয়। পুলিশ খানিক কাজ দেখাতে চেয়ে তৎপর। অসম্ভব সহযোগী ব্যবহার। আগের দিন মীনাক্ষী মুখার্জিকে যে পুলিশ মেরেছে, সেই পুলিশের সঙ্গে এই পুলিশ কোথাও মিলে যায় কিনা, একথা ভাবতে ভাবতে ভোট দিতে ঢুকলাম। অসাধারণ শান্ত ও ভদ্র পদ্ধতিতে গণতন্ত্রের উদযাপন চলছে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এ অঞ্চলে কোনোদিন ভোটে একটা আধলা ইঁট অবধি পড়েনি। অতএব এই সুষ্ঠু পদ্ধতি আমাদের কাছে বড় চেনা হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে বেশ একটা সুখানুভূতি হয়।

আমার এই পাড়াটাই একটা পৃথিবী হতে পারে, আবার একটা পৃথিবীর মোট ভাগের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোনো শতাংশের হিসাবও হতে পারে। প্রথমটা ধরলে আমাদের মানবসভ্যতার চেয়ে এ ভুবনে আর ভাল কিছু নেই, আর দ্বিতীয়টা ধরলে পদে পদে বৈপরীত্য, এবং তা-ই বাস্তব। দুটো দেখার মধ্যে এই যে বিস্তর ফারাক, এমন এক ব্যবস্থা কী করে যেন নিজেদের অজান্তেই তৈরি করে ফেলেছি আমরা, তা ভেবেই বিষণ্ণ হই বারবার।

আশপাশের পরিবেশ দেখে কখনো মনে হচ্ছে না, এই মাত্র নদিন আগেই পুলিশ আমার সমবয়সি একটা ছেলেকে বাড়িতে ঢুকে হত্যা করে গেছে। আমার ঘরের ঠিক পাশের কাঁঠাল গাছটার মৃদুমন্দ স্পন্দন দেখে বিশ্বাস হচ্ছে না, আনিস খানের মৃত্যুর ঠিক পরদিনই আমার বড় কাছের কিছু মানুষ সরকারের অপশাসন-বিরোধী পথনাটক করতে গিয়ে চরম নিগ্রহের শিকার হয়েছে। একটা অবিরাম ডেকে যাওয়া ডাহুকের ডাক শুনতে শুনতে ভুলে যাচ্ছি, কাল প্রকাশ্য রাস্তায় বাম আদর্শে নিবেদিত আন্দোলনকারীরা পুলিশের হাতে কী লাঞ্ছনাটাই না সহ্য করেছে!

আনিসের মৃত্যুর দিন আমি ঠিক কী করছিলাম?

সেদিন ছিল শুক্রবার। আমি অফিস থেকে বেরিয়েছিলাম সন্ধে সাতটা কুড়িতে। সেদিন আমি অফিসে জানিয়েছিলাম, চাকরি আর বেশিদিন করব না। সেকথা জানানোর পর বেশ হালকা লাগছিল। তারপর আমি যাদবপুরে যাই। একটা বই ফেরত দিতে। বইটার নাম অসামান্য মানভূম, লেখক তপন কর। এ বইটা ২০১৯ সাল থেকে আমার কাছে ছিল। ঝুমুর নিয়ে গবেষণার সূত্রে বইটা আমি নিয়েছিলাম শুভদীপ চক্রবর্তীর কাছ থেকে। তারপর আর ফেরত দেওয়া হয়নি। যেমন অনেক কিছুই আর করে ওঠা হয় না।

কিন্তু সেদিন আমি ফেরত দিতে গিয়েছিলাম। বইটা নেওয়া আর দেওয়ার মাঝে কেটে গেছে আড়াই বছর। তার মাঝে এনআরসি-সিএএ, দিল্লিতে গণহত্যা। তারপরেই করোনা এসেছে।

প্রথম ঢেউয়ে একদল অবাঞ্ছিত লোক মাইলের পর মাইল পায়ের ফোসকা গলিয়ে হেঁটেছে বিপদ বুকে নিয়ে। প্রাচীন ভারত ভূখণ্ডের পরিব্রাজকদের মত তাদের পিঠেও ছিল বোঁচকার মত রুকস্যাক, তাতে যা কিছু শেষ সম্বল।

তারপর দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে, মাঝে বিধানসভা ভোট নামক গণতান্ত্রিক বীভৎস মজার উদযাপন সেই ঢেউকে উত্তাল করেছে। মানুষ ভয় পেয়েছে।

সেই সময়ও পার হয়েছে। আমরা আবার নির্লজ্জ হয়ে উঠেছি। তারপর ঝটিতি সফর করে গেছে তৃতীয় ঢেউ। আর বেশি লজ্জা বা ভয় আমাদের ঘিরে ধরেনি। জিতে গেছি আমরা, খেটে খাওয়া লোকের মুখে লাথি মেরে সানন্দে জিতে গেছি আমরা। এর মাঝে কেবল রুপোলি আভা বলতে কৃষক আন্দোলনের জয়।

সেসব পার করে শুভদীপের বইটা আমি ফেরত দিয়েছি। যাদবপুর সুলেখার মোড়ে পকোড়া-কাবাব খেয়েছি সপ্তাহান্তের শেষ ব্যস্ততাটুকুকে পাশে রেখে। এইট বি মোড়ে শুভদীপ আর আমি আড্ডা মেরেছি প্রাণ খুলে, বহুদিন পরে দেখা হলে যেমন হয়। তারপর অটো ধরে গড়িয়ায় ফিরেছি, বাসস্ট্যান্ডের এটিএম থেকে তিন হাজার টাকা তুলে ফল কিনেছি একশো টাকার।

এসবের মধ্যেই কখন বুঝি আনিস খানের জীবন-যবনিকা পতনের একটা তৎপরতা চলছিল। তারপর, আমি যখন সায়নীর সঙ্গে দৈনিক আত্মসমালোচনার পর ফোন রেখে ঘুমিয়ে রেখেছি, ততক্ষণে আনিস মরে গেছে। তার বাবাকে নীচের ঘরে বন্দুকের নলে আটকে রেখে তাকে ছাদে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর সব শেষ। কাজ সমাধার পর আইনরক্ষকরা ফিরে যায়।

আমার পাড়াটা শান্ত। অস্বাভাবিক রকমের নির্ঝঞ্ঝাট এক দ্বীপের মত শান্ত। আনিসের খবর এখানে বুঝি কেউ রাখে না। যজ্ঞিডুমুরের গাছটার দিকে তাকাই। নগ্ন, বেআব্রু এক চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। ওপাশের রাস্তা, বাড়ি, বাগান, সবই দিব্যি গোচরে আসে। পাশ দিয়ে যেতে যেতেও কেউ তাকায় না ওর দিকে।

আজকাল ক্রূর নগ্নতা দেখেও পাশ কাটাতে শিখে গেছি আমরা।

আজকাল বড় বেশি নির্ঝঞ্ঝাট আর শান্ত হয়ে গেছি সকলে।

লেখক স্বাধীন গবেষক, একাধিক বই লিখেছেন। মতামত ব্যক্তিগত

আরও পড়ুন

আনিস খান বিভ্রান্ত নয়, দলীয় কর্মীও নয়

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.