মার্চ মাস আরম্ভ হয়ে গেছে, উত্তরপ্রদেশে আর মাত্র এক দফা ভোটদান বাকি। পাঞ্জাব, গোয়া, আর উত্তরাখণ্ডের ভোট ইতিমধ্যেই ইভিএম বন্দী হয়ে গেছে। আগামী শনিবার, অর্থাৎ ৫ মার্চ, দ্বিতীয় দফা ভোটদানের মধ্যে দিয়ে মণিপুরের নির্বাচনও শেষ হয়ে যাবে। ১০ মার্চ পাঁচ রাজ্যের যে ফল একসাথে বেরোবে তার উপর ভারতের ভবিষ্যৎ অনেকটা নির্ভর করছে। তাই সব পক্ষই ওই দিনটার দিকে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে।
আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু অবশ্যই উত্তরপ্রদেশ। গোয়ার মত মাত্র কয়েকটা বিধানসভা আসনের রাজ্যে স্থায়ী সরকার প্রায় হয়ই না, অনেককিছুই নির্ভর করে ফল বেরোবার পরের ঘটনাবলির উপর। মণিপুরের অবস্থাও তথৈবচ। আর পাঞ্জাবে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি প্রধান শক্তি হিসাবে উঠে আসতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে, দীর্ঘদিনের সঙ্গী শিরোমণি অকালি দলের সাথেও তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। উত্তরাখণ্ডে কংগ্রেস, বিজেপির শক্তি তুল্যমূল্য, ফলে কে জেতে তা নিয়ে আগ্রহ আছে। কিন্তু ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশের গুরুত্ব তার আকারের কারণেই অনেক বেশি। উত্তরপ্রদেশে কাদের সরকার হল তা পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তার উপর গত পাঁচ বছরে রাজ্যটা বারবার নানারকম নেতিবাচক কারণে সংবাদের শিরোনামে থেকেছে। তাই সেখানকার হাল হকিকত জানতে কিছুদিন আগেই আমি উত্তরপ্রদেশের গ্রামে গঞ্জে গিয়েছিলাম। সাধারণ ভোটার সম্পর্কে বেশ কিছু নতুন অভিজ্ঞতা হল।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
যে জিনিসটা দেখে সবচেয়ে অবাক লাগল, তা হল ২০১৪ সালের পর থেকে বিজেপির পক্ষে জনমত তৈরি করতে যারা সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছে, সেই মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর উপর উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষেরও কোনো আস্থা নেই। বহু জায়গায় জিজ্ঞেস করেছি “কোন চ্যানেল দেখেন, কোন কাগজ পড়েন?” আমাকে অবাক করে দিয়ে অনেকেই বলেছেন, তাঁরা কোনো ন্যাশনাল টিভি চ্যানেল দেখেন না। বেশকিছু চ্যানেল এবং কাগজ সম্পর্কে তাঁদের পরিষ্কার বক্তব্য “ওটা মোদীর মিডিয়া।” ওঁরা বেশি বিশ্বাস করেন স্বাধীন সাংবাদিকদের। অজিত অঞ্জুম, প্রজ্ঞা সিং, সাক্ষী যোশীর মত ইউটিউবারদের বারবার নাম করছেন উত্তরপ্রদেশের সব ধরনের মানুষ।
আর যা দেখলাম, তা হল লখনৌ আর অযোধ্যা সংলগ্ন এলাকায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রভাব এখনো রয়েছে, রামমন্দিরের জন্য অনেকে বিজেপিকে পছন্দ করছেন। কিন্তু বাকি রাজ্যে মেরুকরণের রাজনীতি তেমনভাবে কাজ করছে না। ২০১৭ বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে দেখেছিলাম হিন্দুরা মুসলমানদের ব্যাপারে রীতিমত আক্রমণাত্মক ভাষায় কথা বলছেন। কিন্তু এবার ওসব নিয়ে প্রশ্ন করলেই তাঁরা বলছেন “হমকো ভড়কায়া গয়া থা” (আমাদের উস্কানো হয়েছিল)। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, ডিসেম্বর মাসে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের একজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তি আমাকে বলেছিলেন, যে কোনো মতামতের পক্ষে-বিপক্ষে মেরুকরণ সময়সাপেক্ষ। মনমোহন সিংকে সারা দেশের চোখে ব্যর্থ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তুলে ধরা বা রাহুল গান্ধীর ‘পাপ্পু’ ভাবমূর্তি তৈরি করার জন্য নাকি ওঁরা দু-আড়াই বছর পরিশ্রম করেছিলেন। কিন্তু উত্তরপ্রদেশের এবারের নির্বাচনে প্রভাব ফেলার মত মেরুকরণের কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অতিমারীর কারণে। সেই ভদ্রলোক অবশ্য মনে করেন পাঁচটা রাজ্যের সবকটাতেই মেরুকরণ করতে পারার ব্যর্থতা বিজেপিকে ভোগাবে।
আর এস এসের একটা অংশের আশঙ্কা, গত কয়েক বছরে বিজেপির সদস্য সংখ্যা যেভাবে ফুলে ফেঁপে উঠেছে, তাতেও দলের লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়েছে। কারণ এই নতুন সদস্যদের অধিকাংশই যতটা না বিজেপির মতাদর্শের ভক্ত, তার চেয়ে বেশি নরেন্দ্র মোদীর ভক্ত। ফলে এঁদের কৌশল কম, আবেগ বেশি। এঁদের হাবভাব, সোশাল মিডিয়ার কার্যকলাপ অনেক বেশি আক্রমণাত্মক। এই সদস্যদের প্রভাবে নাথুরাম গডসেকে নায়কের মর্যাদা দেওয়ার মত ঘটনা ঘটছে, যার ফলে শিক্ষিত শহুরে মানুষদের মধ্যে বিজেপির প্রভাব কমছে। অথচ আর এস এস বরাবর অন্তত প্রকাশ্যে বলে এসেছে, মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী আমাদের লোক নয়। সেই নীতি ত্যাগ করায় দীর্ঘমেয়াদি নির্বাচনী ক্ষতি হতে পারে বলে আর এস এসের কেউ কেউ ভয় পাচ্ছেন। উপরন্তু, তাঁদের মতে এই মোদীভক্তরা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের হয়ে সেভাবে খাটছেন না, যাতে আদিত্যনাথ মোদীর প্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয় নেতা না হয়ে উঠতে পারেন।
যে কথা এতদিনে সবাই জেনে গেছেন, সেটা হল রাকেশ টিকায়েতের জায়গা পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে কৃষক আন্দোলনের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। উত্তরপ্রদেশের অন্যান্য অংশে দেখলাম ততটা না হলেও, মানুষ বলছেন আইনগুলো যখন প্রত্যাহারই করল সরকার, তখন অত দেরিতে কেন? উত্তরপ্রদেশের যে অঞ্চলেই যান, একটা বিষয় নিয়ে বিশেষ করে অল্পবয়সীরা কথা বলছেন। তা হল, কর্মসংস্থানের অভাব। এবারের নির্বাচনে সাম্প্রদায়িকতা, আইনশৃঙ্খলার পাশাপাশি এটাও ভোটারদের কাছে খুব বড় ইস্যু মনে হল। রাজধানী লখনৌয়ের আশেপাশে আবার অনেকের মতে আদিত্যনাথের আমলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, আর উন্নতি হয়েছে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির।
উত্তরপ্রদেশের রাজনীতি সম্পর্কে কোনো আলোচনাই জাতপাতের রাজনীতির কথা না বলে শেষ করা যায় না। কোন জাত কোন দলকে ভোট দেবে তা এক জটিল অঙ্ক। ২০১৭ সালের নির্বাচনে এবং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে দেখা গিয়েছিল জাতপাতের চিরাচরিত অঙ্ক কাজ করেনি। হিন্দুদের সব বর্গের ভোট বিজেপির ঝুলি ভরে দিয়েছিল, মুসলমান ভোট গিয়েছিল তাদের বিপক্ষে। তার কারণ ছিল মুজফফরনগরের দাঙ্গার পর থেকে গোটা রাজ্যে প্রবল ধর্মীয় মেরুকরণ। আগেই বলেছি এবার তেমন মেরুকরণ দেখা যাচ্ছে না। ফলে জাতপাতের সমীকরণ বদলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। সেই পরিস্থিতিতে মায়াবতীর দল বহুজন সমাজ পার্টি কেমন ফল করে, বিজেপি তার দিকে তাকিয়ে থাকবে। আসাদুদ্দিন ওয়েসির অল ইন্ডিয়া মজলিস-এ-ইত্তেহাদুল মুসলিমীন যদি অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টির সংখ্যালঘু ভোটে ভাগ বসাতে পারে, তাহলেও বিজেপির লাভ।
যা অনস্বীকার্য, তা হল প্রধানমন্ত্রী মোদীর এখনো বেশ খানিকটা ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা রয়েছে, যা আদিত্যনাথের নেই। মোদীর জনপ্রিয়তা বহু রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির কার্যোদ্ধার করতে পারেনি। উত্তরপ্রদেশে পারে কিনা, সেটাই এখন দেখার। এত শক্ত লড়াই বিজেপিকে অনেকদিন লড়তে হয়নি।
মতামত ব্যক্তিগত।
আরো পড়ুন:
পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী বদলে কৃষক আন্দোলনের ভূমিকা উড়িয়ে দেওয়া যায় না
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।