আইআইটি খড়্গপুরের ছাত্র ফয়জান আহমেদের মৃত্যুর ব্যাপারে গত বুধবার (১৬ অগাস্ট ২০২৩) কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবগননম ও বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ বিচারপতি রাজশেখর মান্থার সিঙ্গল বেঞ্চের রায় বহাল রাখেন। অর্থাৎ ফয়জানের মৃত্যু যে আদালতের চোখে হত্যাই, তা আরও একবার প্রমাণিত হল এবং এর তদন্তের জন্য বিচারপতি মান্থা যে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করে দিয়েছিলেন, তাকেও কাজ চালিয়ে যেতে বলা হল। পরিবর্তন বলতে দুই বিচারক সিটের তিন সদস্যের মধ্যে দুজনের নাম আলাদা করে রাখেন (set aside), কারণ তাঁদের মতে আদালত নয়, তদন্তকারী দলের নেতা (এক্ষেত্রে অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল অফ পুলিস, কে জয়রমন) ঠিক করবেন তাঁর দলে কারা থাকবেন।

অর্থাৎ বিচারপতি মান্থার রায়ের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার এবং আইআইটির আবেদন খারিজ হয়ে গেল। এই ঘটনার আলোকে দেখে নেওয়া যাক, গতবছরের অক্টোবরে ফয়জানের মৃত্যুর পর থেকে তাঁর বাবা-মাকে ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য কী অমানুষিক লড়াই চালাতে হচ্ছে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

আইআইটির তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ফয়জানের মৃতদেহ হোস্টেলে আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকেই ওই প্রতিষ্ঠান এই প্রতিভাবান ছাত্রের মৃত্যুকে খুন বলে মানতে অস্বীকার করে এসেছে। তারা গোড়া থেকেই বলে এসেছে আসামের তিনসুকিয়ার বাসিন্দা রেহানা ও সেলিম আহমেদের একমাত্র ছেলে ২৩ বছরের ফয়জান আত্মহত্যা করেছে। সে নাকি অবসাদে ভুগছিল এবং তা থেকেই এই চরম পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু ফয়জানের বাবা-মা শুরু থেকে বলে এসেছেন তাঁদের ছেলেকে খুন করা হয়েছে। যখন খড়্গপুর পুলিস এবং প্রথম ময়না তদন্তের রিপোর্ট সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারল না, তখন রেহানা ও সেলিম কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন।

রাজ্য ও আই আইটির বিরুদ্ধে যুগপৎ লড়াই

হাইকোর্টে শুধু যে ফয়জানের বাবা-মাকে আইআইটির মত বিরাট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে তা নয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধেও লড়তে হয়েছে। কারণ সরকার বরাবর দাবি করেছে খড়্গপুর পুলিসের তদন্ত ঠিক পথেই চলেছে। ঘটনাচক্রে সেলিমের এক বন্ধু মারফত ফয়জানের পরিবার কয়েকজন দুঁদে আইনজীবীর সন্ধান পান, যাঁদের অন্যতম হলে রণজিৎ চ্যাটার্জি এবং অনিরুদ্ধ মিত্র।

হাইকোর্টে বিচারপতি মান্থার এজলাসে শুনানি চলাকালীনও পুলিস মৃত্যুর সঠিক কারণ চিহ্নিত করতে পারেনি। ফলে বিচারপতি দ্বিতীয়বার ময়না তদন্তের নির্দেশ দেন এবং তার ফলাফলে একথা প্রতিষ্ঠিত হয় যে ফয়জানকে খুন করা হয়েছে। তখন বিচারপতি মান্থা পুলিসকে সরিয়ে তদন্তের দায়িত্ব সিটের হাতে তুলে দেন। শুনানির সময়ে বিচারপতি আইআইটির আইনজীবীদের মৌখিকভাবে এ কথাও বলেন যে আদালত এই তদন্তের দায়িত্ব সিবিআইকে দেবে না। এরপরই রাজ্য সরকার এবং আইআইটি এই রায়ের বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন করে। ডিভিশন বেঞ্চে রাজ্য সরকারের পিটিশন ছিল সিট গঠনের বিরুদ্ধে আর আইআইটির খড়্গপুরের দাবি ছিল পুরো মামলাই খারিজ করে দিতে হবে। রাজ্য সরকারের হয়ে সওয়াল করেন স্বয়ং অ্যাডভোকেট জেনারেল, আইআইটিও শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীদের আসরে নামায়।

আইআইটির কৌঁসুলিরা তাঁদের ভার্বাল সাবমিশনে বারবার দাবি করেন যে ফয়জানের বাবা-মায়ের এই মামলা রুজু করার উদ্দেশ্য আসলে আইআইটির থেকে টাকা আদায় করা। উপরন্তু তাঁরা দাবি করেন এটা র‍্যাগিংয়ের ব্যাপার নয়। তবে বিচারকরা রাজ্যের দাবি অনুযায়ী সিট বদলাতেও মত দেননি, আবার আইআইটির এই বক্তব্যেও সায় দেননি যে এটা খুন নয়। শুধুমাত্র বলেছেন সিটের এডিজি নিজে তাঁর দলের সদস্যদের বেছে নিতে পারেন।

অর্থাৎ এই মামলার পরিণাম যা-ই হোক, ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের পর একথা প্রতিষ্ঠিত হল যে ফয়জানের মৃত্যু হত্যাই, আত্মহত্যা নয়, যা আইআইটি কর্তৃপক্ষ দাবি করেছিল। এই রায়ের ফলে দশ মাসের পুরনো এই মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির সম্ভাবনাও জোরদার হল। আশা করা যায়, এবার শুধু যে অপরাধীদের খুঁজে পাওয়া যাবে তা নয়, ভারতের অন্যতম প্রতিভাবান ছাত্রকে খুন করার উদ্দেশ্যও উদ্ঘাটিত হবে।

ন্যায়বিচারের লড়াইয়ে নেমে বিধ্বস্ত জীবন

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাবালক ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় র‍্যাগিং এবং হত্যার অভিযোগ উঠেছে, তা নিয়ে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বহু প্রতিবাদ সংগঠিত হচ্ছে। এমনকি ছেলেটির জেলা নদিয়ার বাসিন্দারাও ন্যায়বিচারের দাবিতে যাদবপুর পর্যন্ত মিছিল করে এসেছেন। এইসব প্রতিবাদের চাপেই যাকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা হচ্ছিল তা নিয়ে কলকাতা পুলিস তৎপর হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত নজনকে গ্রেফতার করেছে।

আরো পড়ুন স্বপ্নদীপের অপমৃত্যু এবং র‍্যাগিং নিয়ে কিছু কথা

কিন্তু রেহানা আর সেলিম গত দশ মাস ধরে রাজ্য সরকার এবং আইআইটির মত দুই মহাশক্তির বিরুদ্ধে একক লড়াই লড়ে যাচ্ছেন। দ্বিতীয় ময়না তদন্তের জন্য ফয়জানের মৃতদেহ নিয়ে তাঁর মা রেহানাকে ২১ দিন কলকাতায় বসে থাকতে হয়েছিল। রেহানার স্বামী সেলিম বললেন “দিনেরবেলায় আমরা আদালতে যেতাম, উকিলদের সঙ্গে দেখা করতাম বা পুলিসের মর্চুয়ারিতে যেতাম আর রাত্তিরে স্রেফ প্রার্থনা করতাম। রেহানার জীবন একেবারে তছনছ হয়ে গেছে। না ঠিক করে খায়, না ঘুমোয়। কখনো কখনো গোটা রাত জেগে থাকে আর আমাকে বলে, ছেলে একদিন ঠিক ফিরে আসবে।”

ইনিউজরুম ওয়েবসাইটের অনুমতিক্রমে এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হল। তথ্য প্রতিবেদকের।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.