২০০৪ সালের ২৬শে ডিসেম্বরের কথা মনে আছে?
একটা সুন্দর, শান্ত সকালে আচমকা প্রায় তিনতলা সমান ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল চেন্নাইয়ের সমুদ্র সৈকতে! পরে জানলাম এর ফলে আমাদের বছরটা নাকি তিন সেকেন্ড ছোট হয়ে গেছে!
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
আমাদের দেশের অবস্থাটা আবার সেইরকম বলে মনে হচ্ছে। শুধু এবার টেকটনিক প্লেট নয়, অপরাধী একটা ছোট্ট নিউক্লিক অ্যাসিডের কণা! যাকে স্যার পিটার মেডাওয়ার বলেছিলেন, “A piece of bad news wrapped in a protein coat”।
ভারতবর্ষে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে, এবং সত্যিই টাইডাল ওয়েভের আকার ধারণ করেছে। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চাপান উতোর, এক দল কেন্দ্রীয় সরকারকে তুলোধোনা করছেন, আর এক দল রক্ষণাত্মক হতে হতে এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে তাদের কাছে যে কোন সমালোচনাই দেশদ্রোহের নামান্তর!
এমতাবস্থায় আমার পক্ষে বিদেশে বসে শুধুমাত্র খবরের কাগজ, বিবিসি, সিএনএন বা এনডিটিভির উপর নির্ভর করে মন্তব্য করা খুবই অসুবিধাজনক হয়ে পড়ে। কারণ কথাগুলো তথ্যভিত্তিক না হয়ে হয় মতামতভিত্তিক। তবু চেষ্টা করি, কারণ ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের (UK) অবস্থার সঙ্গে ভারতের অনেকগুলো মিল আছে।
ব্রিটেনের প্রথম ঢেউ শেষ হয় গত বছর জুন মাসে। তার পর সত্যিই করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় শূন্যে পৌঁছে যায়। বাজার হাটে, কাফে রেস্তোরাঁ পাবে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে, সরকারের তরফে হসপিট্যালিটি শিল্পকে চাঙ্গা করার উদ্দেশ্যে ঘোষণা করা হয় একটা প্রকল্প, যার নাম ‘Eat out to help out’। রেস্তোরাঁয় গিয়ে খেলে খাবারের দামের উপর ভর্তুকি দিচ্ছিল সরকার। ব্রাইটন ও ডেভনের সমুদ্রতটে রেকর্ড ভিড় হল। শুধু বৈজ্ঞানিকরা বলছিলেন, “এখনো বিপদ পুরো কাটেনি!”
কা কস্য পরিবেদনা!
সেপ্টেম্বর থেকে কেস একটা-দুটো করে বাড়তে আরম্ভ করল; অক্টোবরে হাসপাতালগুলো আবার পুরনো অবস্থায় ফিরে যেতে বাধ্য হল, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, অনিচ্ছাসত্ত্বেও!
এবার দেখা যাক ভারতবর্ষের অবস্থা। প্রথম ঢেউ (অর্থাৎ কেস সংখ্যা বাড়তে থাকা) ভারতবর্ষে শুরু হয়েছিল লকডাউন উঠে যাবার পর! এই right shift of infection curve বিশ্বের আর কোনো দেশে হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। কেন হয়েছে, তা আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধির বাইরে, এপিডেমোলজিস্টরা বলতে পারবেন। প্রথম তাণ্ডবটা শেষ হয় মোটামুটি জানুয়ারির শেষ নাগাদ। বিলেতের সঙ্গে আমাদের গ্রাফটা অনেকটাই একরকম ছিল, সেই সঙ্গে আমাদের আচরণও মোটামুটি একই রকম।
প্রথমে বেশকিছু রাজ্যে নির্বাচন এসে পড়ল। রাজনৈতিক মিটিং মিছিলে ভিড় বাড়তে শুরু করল। রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যেও দায়িত্বের অভাব দেখা দিল — এই ব্যাপারটা সর্বদলীয়। ফেব্রুয়ারি আর মার্চে কলকাতায় ব্রিগেডের জমায়েতকে একটা উদাহরণ বলে ধরা যেতেই পারে। এই প্রসঙ্গে বলা ভালো, যে বিলেতে বা ইতালিতে ‘সুপার স্প্রেডিং ইভেন্ট’ হিসেবে এই ধরণের ঘটনা ঘটেছে, এবং বিস্ফোরণটা ঘটেছে মোটামুটি তার সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই। ভারতের ক্ষেত্রে কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসে তেমন সাংঘাতিক সংক্রমণ দেখা যায় নি। সম্ভবত তখনো আমাদের প্রথম ঢেউয়ের ল্যাজের অংশটা চলছিল বলে।
কিন্তু সব ভাল জিনিসই একসময় শেষ হয়।
আমরা যখন নির্বাচন আর রাজনীতি নিয়ে মত্ত, তখন ভাইরাসটা মিউটেট করল! আমাদের জীবনবিজ্ঞানের টুকিটাকি থেকে মনে থাকবে যে মিউটেশন হচ্ছে জিনের আকস্মিক পরিবর্তন, যার ফলে প্রাণীর গঠন ও চরিত্র, দুইই পাল্টে যেতে পারে। SARS-Cov-2 তার আগেও বহুবার মিউটেট করেছে, সেগুলো আমাদের কাছে পরিচিত হয়েছে ব্রাজিল ভ্যারিয়ান্ট, সাসেক্স ভ্যারিয়ান্ট, সাউথ আফ্রিকা ভ্যারিয়ান্ট ইত্যাদি নামে। এতদিন পর্যন্ত মিউটেশনগুলো ছিল একটা, বড়জোর দুটো জিনে। এইবার ভারতবর্ষে এই পরিবর্তনটা হলো তিনটে জিনে!
এখন B1617 নামটা আমাদের কাছে সুপরিচিত। ভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীরা বলছেন এই পরিবর্তনের ফলে ভাইরাসটার সংক্রমণের ক্ষমতা অনেক বেড়ে গেছে! দুটো মিউটেশনের যোগফল এই B1617, E484Q এবং L452R। এখনো পর্যন্ত বিশ্বের সতেরোটা দেশে এই ভ্যারিয়ান্ট দেখা গেছে।
কিন্তু এর পর যে ব্যাপারটা হল, তাতে ষাঁড়াষাঁড়ির জোয়ারটা সত্যিই সুনামির আকার ধারণ করল!
কুম্ভমেলা।
এবার হিন্দুদের এই বিশেষ অনুষ্ঠানটা ছিল হরিদ্বারে। উত্তরাখণ্ড সরকার প্রথমেই জানিয়ে দিলেন যে মানুষের স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দিয়েও, তাঁরা ধর্মাচরণে কোনরকম বাধাই দেবেন না! সেই সঙ্গে, বর্তমান ভারতের নিয়ম মেনে ধর্মের হাত ধরে এল উগ্র জাতীয়তাবাদ ও হিন্দুত্ব। লেখাপড়া জানা লোকেদের মুখেও শোনা গেল, “গত বছর তবলিগী জমায়েত করতে দেওয়া হয়েছিল, তাই আমাদেরও কুম্ভমেলায় জড়ো হবার অধিকার দিতে হবে!”
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই হরিদ্বারে পুণ্যার্থীদের ঢল নামল; পরীক্ষা-নিরীক্ষার যেটুকু ব্যবস্থা ছিল, সে গেল হাওয়ায় উড়ে! ঠিক কত লোক হয়েছিল হিসাব করা মুশকিল, কিন্তু বিভিন্ন সূত্রের খবর থেকে আন্দাজ করা হচ্ছে সাড়ে তিন থেকে চার কোটি পুণ্যার্থীর সমাগম হয়েছিল হরিদ্বারে! এঁরা এসেছেন ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, তারপর ফিরেও গেছেন!
ওই মেলায় ঠিক কী রকম ভিড় হয়, তার বর্ণনা সুধী পাঠক দুটো বাংলা বইয়ে পাবেন। সমরেশ বসুর অমৃত কুম্ভের সন্ধানে ও নবনীতা দেবসেনের করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে! এবারেও তাই। এক আখড়ার প্রধান কোভিডে মারা গেলেন এপ্রিলের ১৩ তারিখে। ইনি নাকি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ছিলেন, তবে করোনাভাইরাস পার্টিকলগুলো ভবিষ্যতের লেন্সে বোধহয় ভালো করে ধরা পড়ে না। আরো একটা আখড়ার প্রধান কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন
এইবার সাধু-সন্তদের কানে জল গেল; তাঁরা বোধহয় বুঝলেন যে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর কারোরই ভাইরোলজি বা এপিডিমোলজিতে প্রশিক্ষণ নেই। নিরঙ্করী আখড়া জানাল যে তারা হরিদ্বারে আর থাকবে না।
দু এক দিনের মধ্যে কুম্ভমেলা বন্ধ করে দেওয়া হল, কিন্তু ‘শাহী স্নান’ ইত্যাদির কল্যাণে ততদিনে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে।
দুদিন আগে এক এপিডিমোলজিস্ট বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিলাম। তার কথাগুলো অনুবাদ না করে হুবহু তুলে দিলাম। “Ray, what Trump, Bolsonaro, Johnson with his Cheltenham festival and Lombardi with their football match couldn’t do, India did with their Kumbh Mela!”
এর মধ্যে হলো আর এক গ্যাঁড়াকল হল ভ্যাক্সিন। ভারত সরকারের করোনা প্রতিক্রিয়ার একটা মূল অংশ ছিল ভ্যাক্সিন। অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড ভ্যাক্সিন নিয়ে পাশ্চাত্যে যে একটা বিতর্ক শুরু হয়েছে, তা পাঠক নিশ্চয়ই জানেন। তার ছাপ ভারতের উপরেও পড়েছে। তার উপর ভারত বায়োটেকের কোভ্যাক্সিন কাজ করে কি না, ইত্যাদি জানবার জন্যে ফেজ থ্রি ট্রায়াল নিয়েও একটা চাপান উতোর শুরু হয়, যার ফলে প্রথমটা অনেকেই ভ্যাক্সিন নিতে রাজি হন নি। মিউটেশন হওয়া ভাইরাসের ওপর ভ্যাক্সিন কাজ করবে কিনা বুঝবার আগেই সংক্রমণের মাত্রা এমন বেড়ে যায় যে সারা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। ফলে অক্সিজেনের জোগান, ওষুধ অকুলান (কিছুটা কালোবাজারিও চলছে), লখনৌয়ের রাস্তাঘাটে, কানপুরে, গুজরাটে মৃতদেহ সৎকারের অকল্পনীয় দৃশ্যগুলো এখন সারা বিশ্বের সামনে। উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকার যথারীতি অক্সিজেন সংক্রান্ত প্রশ্ন করাকে অপরাধে পরিণত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। সেসবের মধ্যে যাচ্ছি না, কারণ আরো অনেকেই লিখেছেন।
সবশেষে কয়েকটা কথা।
১। অতিমারীর প্রতিক্রিয়া সব সময়েই একটা রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া। এখানে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক টেনে আনা (হ্যাঁ, সেটাও চলছে পুরো দমে) হচ্ছে কুযুক্তি।
২। অতিমারী ব্যাপারটা বিশ্বব্যাপী। তার প্রতিক্রিয়া ও প্রস্তুতি, দুটোই আন্তর্জাতিক হওয়া উচিৎ। সে ব্যাপারটা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও এখনো হয়ে ওঠেনি।
৩। যে ব্যাপারটা সর্বাগ্রে প্রয়োজন ছিল, সততা এবং সত্য স্বীকার করা, আমরা (দুটো দেশই, আমার মাতৃভূমি এবং আমার বেছে নেওয়া দেশ) তাতে অক্ষম হয়েছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার বলেছে, যে শুধুমাত্র ভাইরাস মিউটেশনের ওপর জোর দিয়ে, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জমায়েতকে অগ্রাহ্য করলে চলবে না।
আমরা কি তা মানছি?
ছবি Wikipedia ও Japan Times এর website থেকে।
লেখক ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের পশ্চিম মধ্যাঞ্চলে ডাডলির রাসেলস হল হাসপাতালে আপৎকালীন চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত। মতামত নিজস্ব, প্রতিষ্ঠানের নয়।
তথ্যসূত্র
- Christina Pagel: A very real danger that COVID19 will become entrenched as a disease of poverty.blogs.bmj.com
- Brazil’s report on Bharat Biotech plant. Why is the CDSCO silent?www.thequint.com
- WHO blames ‘perfect storm’s for India Covid crisis. Guardian, Tuesday 27th April, 2021.
- The system has collapsed, India’s descent into Covid hell. By Hannah Ellis- Peterson. Guardian, Wednesday, 21st April 2021.
- Neil Ferguson: UK’s Covid situation is bleak as control measures may not work.https://www.imperial.ac.uk>news
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।