ব্রজ রায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে বিজ্ঞান আন্দোলনের একজন সেনানী বললেন, এক অধ্যায় শেষ হল। সত্যিই কি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি? তাহলে তো বলতে হয় তাঁর উত্তরাধিকার বহন করার মত কেউ নেই। ব্রজ রায়ের জীবন চলমান ইতিহাস। মরণোত্তর দেহদান আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে তাঁর পরিচিতি নিয়ে নতুন করে বলবার দরকার নেই। কিন্তু যে রাজনৈতিক মতাদর্শ এই সামাজিক আন্দোলনে ব্রজ রায়দের প্ররোচিত করেছিল তার চর্চা বিশেষ হয় না।
মাত্র একুশ বছর বয়সে (১৯৫৭ সালে) যিনি অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হতে পেরেছিলেন, তিনি পঞ্চাশ বছর বয়সে কেন মরণোত্তর দেহদান আন্দোলন গড়ে তোলার অঙ্গীকার করলেন? সে কি রাজনৈতিক জীবন থেকে সরে আসা? আপাতদৃষ্টিতে এমনটা মনে হতেই পারে। রাজনৈতিক কর্মী থেকে সমাজকর্মী হয়ে যাওয়ার, পূর্বের রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি আস্থা হারানোর অনেক নজির আমাদের দেশে রয়েছে। এক সময়ের বিপ্লবী পরবর্তীতে মার্কসবাদের শ্রেণি রাজনীতিকে, ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে অস্বীকার করে সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন এমন মানুষ বিরল নন। তাঁদের সঙ্গে ব্রজ রায়কে একাসনে বসালে কিন্তু সত্যের অপলাপ হবে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন মার্কসবাদী, ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যবস্থা বদলের স্বপ্ন নিয়ে চলা এক মানুষ।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
মরণোত্তর দেহদান আন্দোলনও ছিল তারই অঙ্গ। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, ‘গণদর্পন’ প্রথমে ছিল একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বহু নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। কিন্তু ব্রজ রায়সহ অনেকেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে আরো ছড়িয়ে দিতে চাইছিলেন। তাঁদের মনে প্রশ্ন জাগে, একজন মানুষের মৃত্যুর পর তাঁর জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ধর্মীয় পরিচয় অনুসারেই দেহের বিনষ্টি হয়। কিন্তু যিনি নিজের ধর্ম পরিচয় মানেন না, বস্তুবাদী — তাঁর ক্ষেত্রে এমন হবে কেন? অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিরও জীবনাবসানে সাম্প্রদায়িক পরিচিতিকেই আশ্রয় করতে হয়। তাছাড়া একজন ব্যক্তি এই সমাজেই বেড়ে ওঠেন। তাহলে মৃত্যুর পর তাঁর দেহ কেন সমাজের হবে না? মৃতদেহের অধিকার পরিবারকে দেওয়ার অর্থই হল ব্যক্তি মালিকানাকে স্বীকৃতি দেওয়া। বিজ্ঞানী জে বি এস হলডেন মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেছিলেন। ১৯৬৪ সালের ১ ডিসেম্বর ভুবনেশ্বরে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মরণোত্তর দেহ অন্ধ্রপ্রদেশে দান করা হয়। ব্রজ রায়সহ গণদর্পনের পাঁচজন মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করার সিদ্ধান্ত নিলেন। শুরু হল আরো মানুষকে যুক্ত করার প্রচেষ্টা। ১৯৮৬ সালের ৫ নভেম্বর জে বি এস হলডেনের ৯৫তম জন্মদিবসে ৩৪ জনের মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে এক সামাজিক আন্দোলনের সূচনা হল। বলা যেতে পারে ব্যক্তি মালিকানা ও ধর্মীয় পরিচিতির বিরুদ্ধে জেহাদই জন্ম দিয়েছিল এমন এক সামাজিক আন্দোলনের।
বিপ্লবী স্পর্ধাই ব্রজ রায়দের এই পথে চলতে শিখিয়েছিল। দারিদ্র্যের জ্বালায় যে ছেলে ছোলা বিক্রি করে পড়াশোনা চালাত, স্বাধীনতার আসল মানে বুঝতে তার খুব অসুবিধা হয়নি। ১৯৩৬ সালের ৩০ নভেম্বর জন্মের পর থেকেই দারিদ্র্যের সঙ্গে তাঁর লড়াই চলেছে। ১৯৫০ সালে স্বাধীন দেশের সরকার স্কুল ফি চালু করায় তাঁর মত অনেকেরই লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পাঁচের দশকে একের পর এক গণ আন্দোলন, তারও আগে ১৯৪৯ সালে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির লতিকা,প্রতিভা,অমিয়া ও গীতার পুলিশের গুলিতে শহিদ হওয়া কিশোর ব্রজকে বাম রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১৯৫৩ সালে মাত্র সতেরো বছর বয়সেই ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫৫ সালে ওয়েলিংটন স্কোয়ারে গণনাট্যের সম্মেলনে যোগ দেওয়ায় তাঁর বেসরকারি কোম্পানির চাকরি চলে যায়। প্রবল আর্থিক অনটনে চাকরিটা ছিল তাঁর বড় সম্বল। ক্ষমা চাইলে চাকরিটা হারাতে হত না। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে চাকরি যাওয়াকে তিনি গর্বের বলেই মনে করেছিলেন।
এদিকে গণনাট্যের অনেক সিদ্ধান্তের সঙ্গে তিনি একমত হতে পারছিলেন না। শৃঙ্খলার নামে প্রশ্নহীন আনুগত্যকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। অন্ধভাবে সব কিছু মেনে নেওয়া যে মার্কসবাদবিরোধী, সে বয়সেই তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ১৯৬০ সালের ১১ জুলাই কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারীদের ঐতিহাসিক ধর্মঘট হয়। ব্রজ রায় তখন ডাক বিভাগে কাজ করেন। ধর্মঘট সফল করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু পাঁচদিনের মাথায় সেই ধর্মঘট তুলে নেওয়া হয়। নেতৃত্বের এই আপসকামী মানসিকতা তিনি মেনে নিতে পারেননি। দলের নির্বাচনকেন্দ্রিক কর্মসূচি, সংসদীয় রাজনীতির সারবত্তা নিয়েও তাঁর মনে প্রশ্ন দেখা দেয়। মার্কসবাদের ছাত্র হিসাবে নিজের মনে জন্ম নেওয়া নানা প্রশ্নে তখন জর্জরিত হচ্ছেন তিনি। এমন সময়েই চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক বিপ্লবী অনন্ত সিংহের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। বিপ্লবী গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ প্রমুখ ব্রিটিশ আমলে আন্দামান জেলে বসেই মার্কসবাদের চর্চা শুরু করেন। আওয়ার স্ট্যান্ড নামে একটি সশস্ত্র বিপ্লবী দল গড়ার পরিকল্পনা করেন। স্বাধীনতার পরেও অনন্ত সিংহ সেই বিপ্লব প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। অনন্ত সিংহ, ব্রজ রায় প্রমুখ কয়েকজন মিলে ১৯৬৫ সালে রেভল্যুশনারি কমিউনিস্ট কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (আর সি সি আই) নামে একটি বিপ্লবী দল গড়ে তোলেন। দলের দলিলে বলা হয় “Communists are predominantly dominated by revisionists, but the ranks are revolutionary.” ঠিক হয় নিজেদের গোপন রেখে কমিউনিস্ট পার্টির ভিতর থেকেই তাঁরা কাজ করবেন।
এই রাজনৈতিক কর্মকান্ড চলতে চলতেই ব্রজ রায়ের জীবনে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। নাটক করার সুবাদে তৃপ্তি চৌধুরীর সঙ্গে আগেই আলাপ হয়েছিল। ডাক বিভাগে কর্মরত তৃপ্তি চৌধুরীও ছিলেন বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ। ব্রজ রায় ও তৃপ্তি চৌধুরী পরস্পরকে জীবনসঙ্গী করেন। বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানকে অস্বীকার করে তাঁরা লিভ টুগেদারের সিদ্ধান্ত নেন। লেনিন-ক্রুপস্কায়ার মতোই বিপ্লবের স্বার্থে কোন সন্তানের জন্ম না দেওয়ার সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেন। সম্ভবত ব্রজ রায়-তৃপ্তি চৌধুরী প্রথম কলকাতায় লিভ টুগেদারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তৃপ্তিদি ব্রজ রায়ের থেকে বয়সেও বড়। ছয়ের দশকে এই ভাবনা বৈপ্লবিক ছিল। তাঁরা এঙ্গেলসের ‘দি অরিজিন অফ দ্য ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রপার্টি এন্ড দ্য স্টেট’ বইটির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। পরিবার প্রথা, বিবাহ ব্যবস্থার সঙ্গে ব্যক্তি মালিকানা ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক কেবল আত্মস্থই করেন নি, সেই আদর্শকেই জীবনের পাথেয় করেন।
তৃপ্তি চৌধুরীও আর সি সি আই-এর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। গোপন কাজের জন্য ঘন ঘন ঠিকানা বদল, অস্ত্র প্রশিক্ষণ এসবের জন্য তহবিল গড়তে আর সি সি আই রাজনৈতিক ডাকাতির পথ গ্রহণ করে। লেনিনবাদী এই কৌশল নিয়ে তাঁদের কোন দ্বিধা ছিল না। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিপ্লবী কর্মকান্ডে রাজনৈতিক ডাকাতিও তাঁদের শিক্ষা দিয়েছিল। আর সি সি আই কলকাতার বুকে একের পর এক পোস্ট অফিস, ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে। ব্রজ রায় এসব কর্মকান্ডে সামনের সারিতে ছিলেন । কিন্তু দলের ভিতর বিশ্বাসঘাতকদের আসল কাজ বানচাল করার প্রয়াস, কারো কারো নকশাল আন্দোলনের প্রতি আকর্ষণ দলকে ক্রমশ দুর্বল করতে থাকে। ব্রজ রায়, তৃপ্তি চৌধুরীরা এরপর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বোমা বিস্ফোরণ ও লিফলেট বিলি করে প্রচারের কৌশল নেন। টাইম বোমা বানানোর কৌশলও তাঁরা শিখে নিয়েছিলেন। তবে এমনভাবে বিস্ফোরণের পরিকল্পনা নেওয়া হত যাতে প্রাণহানি না হয়। ১৯৬৯ সালের ১১ নভেম্বর ব্রজ রায় ও তৃপ্তি চৌধুরীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ব্রজ রায়ের ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন। ১৯৭০ সালের ১০ জানুয়ারি গ্রেপ্তার হন অনন্ত সিংহ।
আট বছর কারাবাসের পর ১৯৭৭ সালের ১০ ডিসেম্বর ব্রজ রায় মুক্তি পান। জেল থেকে ছাড়া পেয়েই বন্দীমুক্তি, মানবাধিকার আন্দোলনে যুক্ত হন। কিন্তু ডাকাত বলে দাগিয়ে দিয়ে ব্রাত্য করার প্রয়াস তাঁকে বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছিল। পথ চলতে চলতেই ১৯৮৬ সাল থেকে তিনি মরণোত্তর দেহদান আন্দোলন গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। সেদিনের সেই সূচনা আজ অনেক বিস্তৃত হয়েছে। ব্রেন ডেথ হওয়া ব্যক্তির প্রত্যঙ্গ দানে আজ এই রাজ্য যে সাফল্য অর্জন করেছে, তাতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। নানা জায়গায়, চিকিৎসক মহলে তিনি এ বিষয়ে অক্লান্তভাবে লেগে থেকেছেন। সেই কাজ করতে গিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানেও নিজেকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। মরণোত্তর দেহদানের প্রচারে তিনি কেবল দেশের বিভিন্ন প্রান্তেই নন, বাংলাদেশেও একাধিকবার গিয়েছিলেন। আন্দোলন যাতে বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গড়ার কাজ থেকে সরে না আসে, সরকারি অনুদান বা বিদেশি অনুদান নির্ভর সংগঠনে পরিণত না হয় সে বিষয়েও শেষ দিন পর্যন্ত সচেষ্ট ছিলেন। কারণ এন জি ও–র নামে অরাজনীতির রাজনীতিকে তিনি ঘৃণা করতেন। বিশ্বাস করতেন, আদর্শ কমিউনিস্ট হতে হলে জীবনচর্যায় সেই বোধের অনুশীলন করতে হয়।
মেডিকাল কলেজগুলোতে প্যাথলজিকাল অটোপ্সি আবশ্যিক করতে বহু লড়াই করেছেন। রোগ নির্ণায়ক ময়না তদন্ত বহু অজানা রোগের মোকাবিলা করতে চিকিৎসা বিজ্ঞানকে সাহায্য করবে। করোনায় মৃত ব্যক্তির দেহ ময়না তদন্ত নিয়ে আজ নানা দেশে আলোচনা চলছে। করোনাতেই তাঁর জীবনাবসান হল। গণদর্পনের কমরেডরা তাঁর দেহের ময়না তদন্তের জন্য উদ্যোগী হয়েছেন, স্বাস্থ্য বিভাগের সম্মতিও মিলেছে। সম্ভবত কলকাতায় এক ইতিহাস রচিত হতে চলেছে। এই লেখা যখন লিখছি তখনো পর্যন্ত ঠিক আছে ১৪ই মে, ২০২১ ময়না তদন্ত হবে। ভারতে এই প্রথম করোনায় মৃত ব্যক্তির দেহ ময়না তদন্ত হবে। ইতিহাস শেষ হয় না, এভাবেই নতুন অধ্যায়ে পা বাড়ায়। ইতিহাস থেমে থাকে না। ব্রজ রায়ের পথ চলা তার সাক্ষী।
ঋণস্বীকার: চলতে চলতে পথ – মুক্তি হোম, লোকায়ত মাল্টিডাইমেনশনাল রিসার্চ সোসাইটি
ব্রজ রায় এবং গণদর্পন – ছবি নিজস্ব
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।