মধ্যবিত্ত গেরস্থ বাড়ি। নির্বাচনের দিন সকালবেলা। বাড়ি ঘিরে ধরে ৮-১০ জন লোক। তারা শাসক দলের ক্যাডার। পাড়ার হর্তাকর্তা। হুমকি দিচ্ছে, বুথে যাওয়া যাবে না, গেলে ফল ভাল হবে না।

বুথের পর বুথে বিরোধী এজেন্ট নেই। সকাল সকাল মারধর করে বের করে দেওয়া হয়েছে। এজেন্টের বাড়িতে ঢুকে হুমকি দিচ্ছে ভৈরববাহিনী। মাকে বলা হচ্ছে, ছেলের লাশ দেখতে হবে। ভোট মিটতেই লুকিয়ে পড়তে হচ্ছে বিরোধী প্রার্থীর সন্তানকে। কোথাও প্রৌঢ়া মহিলার মুখ ফাটিয়ে দেওয়া হচ্ছে মেরে। অপরাধ, তিনি বাম দলের এজেন্ট। কোথাও ধাক্কা মারতে মারতে বের করে দেওয়া হচ্ছে প্রার্থীকে। অটো করে, টোটো করে ওয়ার্ডে ঢুকে পড়ছে ২০০-৩০০ বহিরাগত। চলছে অবাধ তাণ্ডব, একতরফা ছাপ্পা ভোট। দিনের আলোয় কল্লোলিনী কলকাতার বুকে গণতন্ত্রের তলপেটে লাথি মারতে মারতে হেসে উঠছে শাসক দল।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

কোন শাসক দল? মাত্র কয়েক মাস আগে যারা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে বিধানসভায়। কলকাতা পুরসভার ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে যারা এগিয়ে ছিল ১৩১টিতে। বিজেপি এগিয়ে ছিল ১২টিতে। তার মধ্যেও দুটি ওয়ার্ডে ভবানীপুর উপনির্বাচনে শাসক দল এগিয়ে যায়। বামেরা শূন্য, কংগ্রেস এগিয়ে ছিল মাত্র একটি ওয়ার্ডে।

অতি বড় বিরোধী সমর্থকও ভাবেননি পৌর নির্বাচনে গদি উল্টে যাবে, তৃণমূল হারবে। বস্তুত বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে কলকাতা কার্যত বিরোধীশূন্য। বিজেপি ভেঙে প্রতিদিন নেতা, কর্মীরা যোগ দিচ্ছেন তৃণমূলে। বামেরা হীনবল। কংগ্রেস প্রায় অস্তিত্বহীন। এই অবস্থায় পৌর নির্বাচনে এমন বল্গাহীন সন্ত্রাস করার কি আদৌ প্রয়োজন ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের?

ছিল না, আবার ছিলও বটে। তৃণমূল প্রমাণ করল, ভোট লুঠ তারা কেবল নির্বাচনে জেতার জন্য করে না, করে অভ্যাসে। গণতন্ত্রকে অসম্মান করার যে অভ্যাস বাংলার মসনদে বসলে মজ্জাগত হয়ে যায়, তৃণমূল তার ব্যতিক্রম নয়, বরং অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে যেতে সে মরীয়া। কেবল জয় তাকে তৃপ্ত করে না, সে মেরে জিততে চায়। চায় নিরঙ্কুশ জয়। বিরোধিতার কোনও রকম পরিসর রাখায় সে বিশ্বাস করে না।

এই মানসিকতা বিপজ্জনক। না, কেবল সিপিএম বা বিজেপি বা কংগ্রেসের জন্য নয়, বিপজ্জনক তৃণমূলের নিজের জন্যও। স্বৈরাচার যতদিন ক্ষমতায় থাকে, তাকে নিরঙ্কুশ বলে মনে হয়। কিন্তু বস্তুত সে ফাঁপা। বাইরে দাপটের খোলস, ভিতরে আত্মবিশ্বাসহীন এক অস্তিত্ব, যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অবিশ্বাস আর আতঙ্ক। অবিশ্বাস নিজের দলের সহকর্মীর প্রতি। আতঙ্ক মুখ নিচু করে হেঁটে যাওয়া আমজনতা সম্পর্কে। স্টোনচিপস, বালি, সিন্ডিকেট ব্যবসার আপাত রমরমার আড়ালে তার জন্য তৈরি হচ্ছে এক অস্বাভাবিক ভবিষ্যৎ, তা সে জানে। আরও জানে, স্বৈরাচারের বিদায় কোনও স্বাভাবিক পদ্ধতিতে হয় না। ইতিহাসের নিষ্ঠুর চলন স্বৈরাচারের বিদায়লগ্নে নৃশংসতাকে নায়কের আসন দেয়। রবিবাসরীয় গণতান্ত্রিক তাণ্ডব নৃত্য দেখতে দেখতে মনে পড়ছিল সেই নারীর কথা। ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অপরাধে প্রকাশ্য রাস্তায় যাঁর শাড়ি খুলে নেওয়া হয়েছিল। ঈশ্বরের দোহাই, তৃণমূল সরকারের পতনের লগ্নে ওই নারী যেন নিরস্ত্র থাকেন।

শাসকের ভুল হয়ে যায়। সময়কে চিনতে, সময়ের গতিকে বুঝতে ভুল হয়। ভুল হয়, কারণ তার নজরে মিশে থাকে দম্ভ আর ভয়ের ককটেল। কোবাড গান্ধী বলেছিলেন, এই ব্যবস্থা এমন কোনো সরকার তৈরি হতে পারে না, যারা সাধারণ মানুষকে সম্মান করবে। শাসক জনতাকে সম্মান করতে ভুলে গেলে বিপদ। বিপদ আরও বাড়ে, যখন একটি রাজনৈতিক দল গোটা রাজ্যকে নিজের সম্পত্তি মনে করতে থাকে। মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলব, অথচ সরকারি টাকায় গড়ব মন্দির — এমন দ্বিচারিতা চিরকাল বিনা প্রতিরোধে করা চলতে পারে, এই আত্মবিশ্বাস শাসকের জন্য বিপজ্জনক। আপনারা নিজেদের স্বাভাবিক বিদায়ের পথ রুদ্ধ করে দেবেন না। আপনাদের বিদায় যেন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই হয়, তা নিশ্চিত করুন। আগামীর পশ্চিমবঙ্গকে কোনও অগণতান্ত্রিক পথে সমাধান খুঁজে নিতে বাধ্য করবেন না।

কবীর সুমন লিখেছিলেন, “বিরোধীকে বলতে দাও, বিরোধীকে বলতে দাও.. তোমার ভুলের হিসাব দিক।” মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী, বিরোধীকে বলতে দিন। কথা বলার অধিকার কেড়ে নেবেন না। আপনার দলের সর্বগ্রাসী আচরণ এই রাজ্যের ক্ষতি তো করছেই, তার সঙ্গে এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসকেও। হিন্দুত্ববাদী হায়েনাদের দোহাই দিয়ে সেই পরিণতিকে দীর্ঘদিন রোখা অসম্ভব। কত বছর ক্ষমতায় থাকবেন আপনারা? পাঁচ বছর, দশ বছর, পনেরো বছর? প্রতিহিংসার আয়ু কিন্তু আরও অনেক বেশি।

পশ্চিমবঙ্গে এমন কোনো ‘সৎ’ সাংবাদিকতা এখন হতে পারে না, যা দ্বিধাহীনভাবে এই স্বৈরাচারের নিন্দা করতে ভয় পায়। এমন কোনো ফ্যাসিবিরোধী অ্যাক্টিভিজম হতে পারে না, যা এই ভোট লুঠের বিরোধিতা করে না। এমন কোনো সৎ গণতান্ত্রিক কর্মসূচি অসম্ভব, যা প্রকাশ্যে, চিৎকার করে এই নির্লজ্জ দখলদারির অবসান চায় না।

বিজেপি ভয়াবহ। তার কবর খুঁড়েছে বাংলা। কিন্তু এই মৃত নগরীর রাজা হয়েছে আপনি কী পাবেন, হে শাসক? এখনো সময় আছে, নিজেদের স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক পথে বিদায় নিশ্চিত করুন। রাজ্যের মানুষকে অস্বাভাবিক পথে হাঁটতে বাধ্য করবেন না।

~মতামত ব্যক্তিগত।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.