সবে ধান ঘরে আসছে। মাঠে আলু চাষ জোর কদমে আরম্ভ হয়েছে। রাসায়নিক সার বিক্রি হচ্ছে কালোবাজারে। ইউরিয়া সারের এমআরপি বস্তা পিছু ৩৬৫ টাকা, খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকায়। ডিএপির এমআরপি ১১২৫ টাকা, বিক্রি হচ্ছে ১৪০০ টাকায়। এনপিকে সারের এমআরপি ১৪৬৫ টাকা, বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৮০০ টাকায়। সরকারের কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ নেই। বিশেষ করে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে যে কোনো বিরোধী দলের কাছে এটা একটা বড় ইস্যু হওয়ার কথা। কিন্তু রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি এ ব্যাপারে স্পিকটি নট। আবার দেখুন, কেন্দ্রীয় সরকার আইন সংশোধন করে সীমান্ত এলাকায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নজরদারির এলাকা সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত করে দিয়েছে। এর আসল উদ্দেশ্য রাজনৈতিক – সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা সংখ্যালঘু মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং সন্ত্রস্ত রাখা। একইসঙ্গে এতে রাজ্য সরকারের অধিকার খর্ব করা হল। এই ইস্যুতে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হওয়ার কথা ছিল, মমতা ব্যানার্জির গলা সপ্তমে চড়ার কথা ছিল। কিন্তু তেমনটা হয়নি। দুই দলের পারস্পরিক সহযোগিতা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। বরং হিন্দুত্বের চিত্রনাট্য অনুসারী।

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের আসল লক্ষ্য ভারতে হিন্দুরাষ্ট্র কায়েম করা। বিজেপি তাদের রাজনৈতিক মুখ। হিন্দুরাষ্ট্রের পথে দুই প্রধান কাঁটা বামপন্থী দলগুলো এবং কংগ্রেস। তাদের নির্মূল করা দরকার। তাই আরএসএস ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’ কথাটা বারবার বলে। কিন্তু দেশের জনবিন্যাসের বৈচিত্র্যের কারণে বিজেপির একার পক্ষে এখনো সেই কাজ করা সম্ভব নয়। তাই যেখানে সরাসরি বিজেপিকে দিয়ে ক্ষমতা দখল না করা যাচ্ছে না, সেখানে অন্য সহযোগী দল দরকার। কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি অথবা মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল ক্ষমতা দখলে আরএসএসের সেই সহযোগী দল। বর্তমানে জাতীয় রাজনীতিতে আপ দলের প্রধান কাজ বিজেপিবিরোধী কংগ্রেসকে দুর্বল করা। দ্বিতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসার পরেই কেজরিওয়াল হনুমান চালিশা পড়েছেন, দিল্লির দাঙ্গায় আপ দলের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গোয়া, হরিয়ানার বিধানসভা নির্বাচনে আপ গিয়ে হাজির হয়েছে, এমনকি হিমাচল প্রদেশ এবং গুজরাটে আপ কংগ্রেসকে সরিয়ে প্রধান বিরোধী হিসাবে উঠে আসতে চাইছে। আইনত এতে কোনো অন্যায় নেই, কিন্তু কেজরিওয়ালের উঠে আসাটা আসলে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিত্রনাট্যের অঙ্গ। তাই কেজরিওয়াল সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন ভারতীয় টাকায় লক্ষ্মী, গণেশের ছবি ছাপানো উচিত।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

কেজরিওয়ালের চেয়ে মমতার আরএসএস, বিজেপি ঘনিষ্ঠতা আরও বেশি প্রকট। তৃণমূলের জন্মই হয়েছে কংগ্রেসের ভিতরের সেই অংশকে নিয়ে, যারা আরএসএসপন্থী। আরএসএস ও মমতার যৌথ যাপনের কথা অপ্রকাশিত কিছু নয়। মমতারই দলের একদা সাংসদ কৃষ্ণা বসু লিখে গেছেন কীভাবে গুজরাট দাঙ্গার পরেও মমতা বিজেপি সরকারকে সমর্থন দেওয়ার পক্ষে অনড় ছিলেন। আরএসএস একাধিকবার মমতাকে তাদের দুর্গা বলে উল্লেখ করেছে, অতীতে বাংলায় ক্ষমতা দখলের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়েছে। মমতা নিজেও আরএসএসের প্রশংসা করেছেন।

২০২১ সালে তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় এসে মমতার হিন্দুত্বের প্রতি ঝোঁক বৃদ্ধি পেয়েছে। সংখ্যালঘু ভোটের জোরে বিপুল সংখ্যক আসনে জয়ের পরেও মমতার এই অবস্থান নিশ্চিতভাবে আরএসএস তথা হিন্দুত্বের প্রতি আকর্ষণ প্রকাশ করছে। ২০২৩ সালের মধ্যে দিঘায় ২০ একর জমির উপর ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে জগন্নাথ মন্দির তৈরি হয়ে যাবে। তৈরি করছে ওয়েস্ট বেঙ্গল হাউজিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন বা হিডকো। সংস্থার মুখ্য বাস্তুকার সুমন নিয়োগী জানিয়েছেন দিঘায় জগন্নাথ মন্দির মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রোজেক্ট। এছাড়া দিঘা শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদ ন্যায় কালীমন্দিরে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শোয়ের ব্যবস্থা করেছে। ২০২৪ সালের মধ্যে নদীয়া জেলার মায়াপুরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় হিন্দু মন্দিরের উদ্বোধন হবে। ইসকনের এই মন্দির নির্মাণ করছে ফোর্ড কোম্পানি, রাজ্য সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে। পাঠক মমতার এই মন্দিরপ্রীতির সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী অথবা যোগী আদিত্যনাথের অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের মিল খুঁজে পেতে পারেন। দুর্গাপুজোয় সরকারি কর্মচারীদের ছুটি বৃদ্ধি, ঈদে ছুটি কমিয়ে দেওয়া নিশ্চিতভাবে মমতার হিন্দুত্বের প্রতি প্রবল আকর্ষণকেই প্রতিষ্ঠিত করে। দুর্গাপুজোর শেষে কার্নিভাল, এমনকি মোদীর বারাণসীর সন্ধ্যারতির আদলে কলকাতায় গঙ্গারতি আরম্ভ করার পরিকল্পনা — সবই আরএসএসের চিত্রনাট্য অনুযায়ী মগজে হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠা করার কৌশল।

অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। গত বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসার পরে তো মমতা জাতীয় রাজনীতিতে মোদীর বিকল্প মুখ হয়ে উঠতে পারতেন। হল না, কারণ তৃণমূলের উদ্দেশ্য কংগ্রেসকে দুর্বল করে জাতীয় স্তরে বিজেপির সুবিধা করে দেওয়া। তাই গোয়া বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল অর্থ ভাণ্ডার নিয়ে উপস্থিতি। ত্রিপুরায় বিজেপিবিরোধী সিপিএমকে দুর্বল করার জন্য একইভাবে প্রচুর অর্থ সহযোগে উপস্থিতি। ঝাড়গ্রামে মোহন ভাগবত এলে সাদর আমন্ত্রণ, আরএসএস ভাল, বিজেপি খারাপ, মোদী ভাল অমিত শাহ খারাপ। এর কোনোটাই অস্থির মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত নয়। প্রত্যেকটি সুচিন্তিত, আরএসএসের চিত্রনাট্য মেনে।

রাজ্যের বিরোধী দলনেতা (প্রাক্তন তৃণমূলী) এবং মুখ্যমন্ত্রীর পারস্পরিক রাজনৈতিক সম্ভাষণ বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির পক্ষেও বিপজ্জনক হয়ে উঠছিল। একজন বলতেন “হরিদাস”, “গদ্দার”; অন্যজন বলতেন “বেগম মমতা”। শুভেন্দু অধিকারী তো অভিষেক ব্যান্যার্জির জন্মের ইতিহাস নিয়েও কদর্য মন্তব্য করেছেন। তারপর হঠাৎ বিধানসভায় বহুদিন বাদে মমতা-শুভেন্দু সাক্ষাৎ, মমতার শুভেন্দুর প্রতি স্নেহের উচ্চারণ “কতদিন পরে এত কাছে এলি!” এমনকি বিজেপি বিধায়ককে দলে নিয়ে এসে অর্থমন্ত্রী করার প্রস্তাব। পরদিনই শুভেন্দুর ভাই দিব্যেন্দুর অভিষেককে চায়ের নেমন্তন্ন কোনোভাবেই নিছক সৌজন্য নয়।

আরো পড়ুন কলকাতার পৌর নির্বাচনে বিজেপির ‘উধাও’ হওয়ার নেপথ্যে

রাজ্য রাজনীতিতে এই প্রথমবার তৃণমূল সত্যিই কিছুটা বেকায়দায়। শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে একাধিক ক্ষেত্রে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি। দলের একাধিক হেভিওয়েট নেতা, মন্ত্রী জেলে। বামপন্থীরা, বিশেষ করে সিপিএম, কিছুটা হলেও সংগঠিত। বিক্ষিপ্তভাবে হলেও গ্রামে গ্রামে প্রকাশ্য যোগদানের মধ্য দিয়ে সংখ্যালঘু ভোট বাম শিবিরে ফিরছে। এই সময়টা মমতার কাছে মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। দুর্নীতি নিয়ে সিবিআই, ইডির তদন্তের ধীর গতি নিয়ে বিচারপতিরা হতাশা ব্যক্ত করছেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সঙ্গে বিচারপতিরাও কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। সঠিক তদন্ত হলে শুধু রাজ্য রাজনীতি নয়, জাতীয় রাজনীতি আন্দোলিত হয়ে যেতে পারে। ফলে আরএসএস কখনোই চাইবে না তৃণমূল বিপদে পড়ুক। তৃণমূল বিপদে পড়লে রাজ্যে বামেদের পুনরুত্থান হবে। জনবিন্যাসের কারণেই বাংলায় বিজেপির ক্ষমতা দখল প্রায় অসম্ভব। তাই বিজেপি না পারলে তৃণমূল ক্ষমতায় থাকুক, বামেরা যেন কোনোমতেই ফিরতে না পারে। পশ্চিমবঙ্গে বামেরা আবার শক্তিশালী হলে জাতীয় স্তরেও আরএসএস, বিজেপির সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। হিন্দুরাষ্ট্রের পরিকল্পনা বিপদে পড়বে।

তাই শুভেন্দু-মমতার সাম্প্রতিক হিমশৈলের চূড়া মাত্র। জলের নিচে রয়েছে হিন্দুরাষ্ট্রের ব্লু প্রিন্ট।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.