“Nowadays anyone who wishes to combat lies and ignorance and to write the truth must overcome at least five difficulties. He must have the courage to write the truth when truth is everywhere opposed, the keenness to recognise it although it is everywhere concealed, the skill to manipulate it as a weapon, the judgement to select those in whose hands it will be effective and the running to spread the truth among such persons “
— Bertolt Brecht
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
এই স্বার্থান্বেষী, কীটদষ্ট গলিত সমাজে আজানুলম্বিত মিথ্যার বিরুদ্ধে আর সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য ফাদার স্ট্যান,আনন্দ তেলতুম্বড়ে, সোমা সেন, সুধা ভরদ্বাজ, ভার্নন গনজালভেস, ভারভারা রাও — যাঁরা ভীমা কোরেগাঁও কেসে গ্রেপ্তার হয়েছেন তাঁদের সবার দিকে তাকিয়ে দেখুন; ব্রেখট বর্ণিত এই নির্দেশিকা তাঁরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন।
কেন ইউএপিএ? প্রথমে সেই আলোচনায় আসি। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অন্য আইন তো ছিল এতদিন। তা কি যথেষ্ট ছিল না? ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০, ১২০ (বি), ১২৪ এসব তো ছিলই। তারপরেও দেখা যাচ্ছে বিচারাধীন অবস্থায় একজন রাজনৈতিক বন্দীকে এই আইনগুলোর আওতায় দীর্ঘ সময় আটক রাখা যাচ্ছে না। তাঁরা বেরিয়ে যাচ্ছেন জেল থেকে, স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক কাজকর্ম করছেন, মানুষকে সংগঠিত করছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন। সবচেয়ে বড় কথা সোচ্চার হচ্ছেন, যা আরো অনেককে আলোড়িত করছে। এককথায় চিন্তার বীজ বপন করছেন বারবার। আর কে না জানে চিন্তার বীজ থেকেই মুক্তির ফসল অঙ্কুরিত হয়।
তাই দীর্ঘায়িত করো বিচার প্রক্রিয়া। যুক্তি-তর্কের আর্গুমেন্ট চালিয়ে যেহেতু সাজা দেওয়া সম্ভব নয়, তাই বিলম্বিত করো বিচার। জেলের মধ্যেই স্থবির ও অক্ষম করে দাও কর্মক্ষম প্রাণবন্ত মানুষগুলোকে। আর বিচারের সেই দীর্ঘসূত্রিতা এবং মুক্তির ক্লান্তিহীন আইনী প্রয়াসের পরও শেষে বিচারাধীন রাজনৈতিক বন্দীর নীরব মৃত্যু দেখে চমকে উঠুক বাকি বিশ্ব, অন্তত মনে মনে স্বীকার করুক রাষ্ট্রের বিরূদ্ধে দাঁড়ালে এমন পরিণতি অবশ্যম্ভাবী। তাই ও পথ মাড়িয়ো না। কী জানি, যে পর্যায়ে আত্মস্বার্থচরিতার্থকামী হয়ে উঠছে সমাজ; মধ্যবিত্ত বিবেক হয়তো আজ থেকে বছর কুড়ি পরে উদাহরণ দিতে গিয়ে বলবে “বার খেয়ে স্ট্যান…….”
‘গ্রেটার এভিল’ বিজেপি কিন্তু ইউএপিএ চালু করেনি। করেছে ‘লেসার এভিল’ কংগ্রেস। হাজার হাজার দলিত-আদিবাসী-মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে, জাতিসত্তার আন্দোলনের সাথে যুক্ত শয়ে শয়ে প্রতিবাদীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বিগত দেড় দশকে ইউএপিএ, আফস্পায় সারা দেশে —কাশ্মীরে, মণিপুরে।
কিন্তু তারপরও ‘বুলন্দ আওয়াজেঁ’ প্রতিবাদে মুখর হয়েছে আরো আরো। কোনো শর্তে মনোবল ভাঙা যায়নি রাজবন্দীদের। জেলের মধ্যে বসেই ভারভারা রাও যেমন লিখেছেন তাঁর অনন্যসাধারণ কাব্যময় জেলগাথা ক্যাপটিভ ইমাজিনেশন, নাগপুর জেলের আণ্ডাসেলের অপ্রশস্ত অন্ধকার ঘরের মেঝেতেই যেমন ঝলসে উঠেছে অরুণ ফেরেরার কার্টুন চরিত্র আর ছবির কোলাজ; তেমনই কোর্ট চত্বরে মুখোমুখি হওয়ার সামান্য সুযোগেই সমস্ত শরীরী ভাষা দিয়ে তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে তাঁরা আলোর পথযাত্রী। এই অমানিশার মধ্যেও থামবে না সূর্যমুখী ভোরের পথ বেয়ে তাঁদের অক্লান্ত হেঁটে চলা।
কেন ভীমা কোরেগাঁও? কী হয়েছিল ভীমা কোরেগাঁওতে তা আমরা মোটামুটি জানি। পেশোয়াদের বিরুদ্ধে মাহার বিজয়গাথা পালন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন দলিত ও বামপন্থী সংগঠনগুলো। এই অবধি ঠিক ছিল। প্রত্যেক বছর এমনই হয়। শহীদ স্তম্ভে মাল্যদান, আম্বেদকরের স্মৃতিতে ভাষণ ইত্যাদি। কিন্তু এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে তাঁরা ঘোষণা করলেন আজকের ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী শাসকরাই হল নয়া পেশোয়া। মিলে গেল ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে দলিত আর বামপন্থী ডিসকোর্স। যার ফলিত রূপে লক্ষ লক্ষ মানুষ সমবেত হলেন। ঘুম উড়ে গেল ক্ষমতাসীন দিল্লীর পেশোয়াদের।
আনন্দ তেলতুম্বড়ের কথায় আসি। গোয়া স্কুল অফ ম্যানেজমেন্টসহ সারা দেশের প্রতিষ্ঠিত সব কর্পোরেট সেক্টরের সাথে যুক্ত যে মানুষটি, তিনি কী এমন লিখেছেন যাতে তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে পুরে দিতে হবে? যাঁর মুক্তির দাবীতে নোয়ম চমস্কি সহ আন্তর্জাতিক মানের বুদ্ধিজীবীরা চিঠি দিয়েছেন ইউনাইটেড নেশনসের সেক্রেটারি জেনারেলকে, তাঁকে গ্রেপ্তার করে ভারতরাষ্ট্রের কি মুখ পুড়ছে না যথেষ্ট পরিমাণে? তারপরও কেন? এর উত্তর একটা মাত্র জায়গাতেই খুঁজে পাওয়া যাবে। জায়গাটা হল আনন্দের লেখা।
ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে কালিমালিপ্ত করা তো উদ্দেশ্য বটেই। কারণ তিনি শুধু সুলেখক বুদ্ধিজীবী নন, তিনি রক্তের সম্পর্কে আম্বেদকরের আত্মীয়ও। তাই মোদীজিকে হত্যার ষড়যন্ত্রী হিসেবে তাঁকে চিহ্নিত করে সমস্ত দলিত নেতৃত্ব ও দলিত আন্দোলনের ফ্রেম থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করা অন্যতম লক্ষ্য। উপরন্তু আনন্দ নিজের লেখায় যা স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন, তা হল দলিত আন্দোলনকে শুধু আম্বেদকরের জয়ধ্বনি আর জয় ভীমের ডঙ্কা বাজালে চলবে না, তাকে নামতে হবে দেশের জল-জমি-জঙ্গল লুঠ আর কর্পোরেট দখলের বিরুদ্ধে। দাঁড়াতে হবে বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে। তবেই হবে জাতের বিনাশের লক্ষ্যে নিপীড়িত জাতের ঐক্য।
আর একইসাথে বামপন্থীদের ভারতবর্ষের জাতব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁদের ঐতিহাসিক যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। নিতে হবে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি। জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামনের সারিতে এগিয়ে আসতে হবে তাঁদের। এবং তা আজকেই, কোন সূদূর ভবিষ্যতে বিপ্লবের জন্য যেন সেই লড়াই অসমাপ্ত না থাকে।
অর্থাৎ ঐতিহাসিকভাবে যে দুই ধারার মিলন সম্ভব না হওয়ার জন্য শুধু ব্রিটিশ জমানায় নয়, ব্রিটিশ পরবর্তী সময়েও সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তরের সম্ভাবনা ধাক্কা খেয়েছে বারবার, আনন্দ তাত্ত্বিকভাবে সেই দুই ধারা ও সম্ভাবনাকে মিলিয়ে দিয়েছেন। তারই প্রায়োগিক ফসল ভীমা কোরেগাঁও। এরপরেও রাষ্ট্র আতঙ্কিত হবে না? জেলে পুরবে না সেই বুদ্ধিজীবীকে, যে পৃথিবীর বৃহত্তম ‘ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক-সমাজতান্ত্রিক’ রিপাবলিককে ব্যঙ্গ করে নিজের বইয়ের নাম রেখেছে রিপাবলিক অফ কাস্ট, দৃপ্ত স্বরে ঘোষণা করেছে “No revolution without annihilation of caste. No annihilation of caste without revolution”?
ফাদার স্ট্যানের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। খ্রিস্টান মিশনারি হয়ে যদি শুধুমাত্র ধর্মান্তরকরণ সম্পন্ন করা আর পুঁজির মানবিক মুখের ভূমিকা নেওয়ার কাজ করতেন, যা ঐতিহাসিকভাবে করে এসেছেন এদেশের অধিকাংশ খ্রিস্টান মিশনারি, তাহলে হয়তো রাষ্ট্র ভারতরত্ন দিত তাঁকে, যে সম্মান সে দিয়েছে চ্যারিটি খ্যাত মাদার টেরেসাকে।
ধর্ম নিয়ে রাজনীতি না করে এই কালাপাহাড় ফাদার কী করলেন? শিক্ষার আলো দেখালেন বঞ্চিত আদিবাসী শিশুদের, গড়ে তুললেন আশ্রম, গড়ে তুললেন মিথ্যা মামলায় আটক বন্দীদের মুক্তির জন্য সংগঠন। সেই বন্দীরা, যারা পাহাড় আর জঙ্গল লুঠের বিরুদ্ধে, কর্পোরেট আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী রোনা উইলসন, শঙ্কর গুহনিয়োগীর সহযোদ্ধা সুধা ভরদ্বাজ, দলিত আদিবাসীদের সংগ্রামের পাশে দাঁড়ানো সোমা সেন, উত্তরাখণ্ডের প্রশান্ত রাহী, নব্বই শতাংশ শারীরিক প্রতিবন্ধকতার মুখেও শিরদাঁড়া টানটান করে দাঁড়ানো জি এন সাইবাবা — যাঁরা যাঁরা এই পর্যায়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন, প্রত্যেকের জীবনেতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখুন;যাদের ‘আরবান নকশাল’ বলে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা হয়েছে, তাঁদের প্রত্যেকের জীবনধারার দিকে তাকিয়ে দেখুন। এঁরা প্রত্যেকে সেই প্রমিথিউস, আন্তোনিও গ্রামশির ভাষায় “অরগ্যানিক ইন্টেলেকচুয়াল”, মাটিতে যাঁদের পা, সর্বহারার সাথে যাঁদের নিবিড় সম্পর্ক, সমস্ত দুঃস্বপ্নের কালরাত্রিতেও গান গায় যে ফেরারী পাখিরা।
বেদীর কাছে একগোছা ফুল কিংবা মালা রেখে দিয়ে, দায়সারা দু-একটা ক্রুদ্ধ মিটিং বা সভায় শোক বাক্যে দু-একবার মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে শুধু উপচারে তপ্ত অশ্রু আর শোকের আগুনকে ঠান্ডা করার দিন কিন্তু শেষ হয়ে আসছে। এক ঐতিহাসিক সময় তিল তিল করে কিছু মানুষকে তৈরী করেছিল সমাজের জন্য। সেই মানবিক পুঁজিও দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। আমাদের স্থির করতে হবে আমরা অরগ্যানিক হবো না নন-অরগ্যানিক।
~মতামত লেখকের ব্যক্তিগত।
- স্ট্যান স্বামী – ছবি NDTV থেকে।
- “পিঞ্জরা তোড়” আন্দোলনকারীদের জামিনে মুক্তি – ছবি PTI থেকে ।
- সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় ও উমর খালিদ – ছবি উইকিপেডিয়া থেকে।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।