বর্তমান যুগে মেয়েদের যুদ্ধে যাওয়ার বিষয়টা অনেক সহজ হয়ে এসেছে। জাতীয় সামরিক বাহিনীগুলোতে তো বটেই, এমনকি গেরিলা বাহিনীতেও মেয়েরা যোগ দিচ্ছেন, লড়াই করছেন সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে। আজ থেকে একশো বছর আগে কিন্তু বিষয়টা এত সহজ ছিল না। দেশ নির্বিশেষে মেয়েদের যুদ্ধাস্ত্র তুলে নেওয়ার ব্যাপারে সমাজে আপত্তি ছিল অনেক। মনে করা হয়, এর জন্য নারীদের শারীরিকভাবে দুর্বল ভাবার পাশাপাশি যুদ্ধবন্দী অবস্থায় তাঁদের উপর শত্রুপক্ষের যৌন অত্যাচারের আশংকাও অনেকাংশেই দায়ী ছিল। এছাড়া রাজনীতির অঙ্গনে মেয়েদের আনাগোনাও খুব একটা স্বাভাবিক বলে ধরা হত না। তাই ভারতের মত রক্ষণশীল দেশে ব্রিটিশবিরোধী লড়াইয়ে মেয়েদের যোগদান সহজ হয়নি।

প্রথমদিকে, এমনকি গান্ধীজির অহিংস আন্দোলনেও, মেয়েদের যোগ দেওয়ার সুযোগ ছিল না। তবে ধীরে ধীরে তাঁরা পিকেটিং ইত্যাদির মাধ্যমে অসহযোগ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠেন। বেশ কিছুকাল তাঁদের যোগদান শুধুমাত্র সেটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকে, সশস্ত্র আন্দোলনের রাস্তা তাঁদের জন্য বন্ধই ছিল। বাংলা বা মহারাষ্ট্রে সশস্ত্র আন্দোলনে তাঁদের ব্রাত্য করে রাখা হয়, এমনকি বাংলার প্রথম যুগের বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখার শপথ নিতেন আন্দোলনকারীরা। পরবর্তী সময়ে পরোক্ষভাবে যোগদান করলেও, প্রত্যক্ষভাবে বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে তাঁদের আরও কিছু বছর লেগে যায়। এই প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে আজাদ হিন্দ বাহিনীতে মহিলা শাখা রাণী লক্ষ্মীবাঈ ব্রিগেডের উপস্থিতি অবাক করার মত। আর এই অবাক করা কাজই করে দেখিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

সে যুগের নিরিখে রাণী লক্ষ্মীবাঈ ব্রিগেডের পরিকল্পনা অনেকটাই আধুনিক ছিল নিঃসন্দেহে, কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসুর নারীবাহিনী নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর রাণী লক্ষ্মীবাঈ ব্রিগেড গঠন নয়। এই লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল ১৯২৮ সালে কলকাতায়, কংগ্রেসের অধিবেশনে। তিনশো মহিলার একটি সুগঠিত, সুসজ্জিত ‘বাহিনী’ তৈরি করা হয়, যার নাম দেওয়া হয়েছিল বেংগল ভলেন্টিয়ার্স। সেই বাহিনী কুচকাওয়াজ করে এই অধিবেশনের শুরুতেই। এর পুরোভাগে ছিলেন অরবিন্দ ঘোষের ভ্রাতুষ্পুত্রী লতিকা ঘোষ। কোনোরকম সামরিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই তাঁকে সুভাষ কম্যান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। যদিও ভলেন্টিয়ার্সের মেয়েরা পরেছিলেন শাড়ি এবং কোনো অস্ত্রও ছিল না তাঁদের হাতে। তবু এই প্রতীকি কুচকাওয়াজের মাধ্যমে সুভাষচন্দ্র হয়ত এই বার্তাই দিতে চেয়েছিলেন, যে রণাঙ্গনে নারী আর বিবর্জিতা নন।  পরবর্তীকালে তিনি লতিকাকে অনুপ্রাণিত করেন রাষ্ট্রীয় মহিলা সংঘ সংগঠনের কাজে। আসলে সে যুগের সাপেক্ষে সুভাষচন্দ্রের নারীচেতনা খানিক অগ্রসরই ছিল বললে খুব ভুল বলা হবে না। জেরল্ডিন ফোর্বসের মতে সে যুগে সুভাষ বসুকে অনেকেই বাংলার নারীমুক্তির অন্যতম অধিনায়ক বলেই মনে করতেন। রাজনীতির অঙ্গনে তিনি বারবারই নারীর স্থানের সপক্ষে বক্তব্য রেখেছেন। তাঁর মতে নারীর ভূমিকা গৃহস্থালিতে সীমাবদ্ধ নয়, দেশ ও জাতির প্রতিও তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। তাই তিনি একাধিকবার মেয়েদের সংগঠন গড়ে তোলার পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছিলেন বলে জানা যায়। তবে ভেরা হিল্ডেরব্যান্ড তাঁর লেখায় দেখিয়েছেন, নারী ও যৌনতা নিয়ে ভারতীয় রক্ষণশীল সমাজের মনোভাবের ছায়া সুভাষের মধ্যেও দেখা গিয়েছিল তাঁর পারিবারিক ও রাজনৈতিক জীবন, উভয় ক্ষেত্রেই।

জার্মানির সাহায্য পেতে বিফল হয়ে সুভাষ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে মৈত্রী স্থাপনের দিকে মনোযোগ দেন। ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে তিনি এই উদ্দেশ্যে সিঙ্গাপুর পৌঁছান। এর আগে থেকেই আজাদ হিন্দ ফৌজ, যার নাম আগে ছিল ইন্ডিয়ান লিবারেশন আর্মি, সম্পর্কে গভীর চিন্তাভাবনা করছিলেন তিনি। এই বাহিনী পুনর্গঠনের জন্য তিনি শারীরিকভাবে সক্ষম সমস্ত ভারতীয়ের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানান। জুলাই মাসের পাঁচ তারিখে সিঙ্গাপুরে এক সভায় সুভাষকে আনুষ্ঠানিকভাবে আইএনএ-র সর্বোচ্চ নেতা ঘোষণা করা হয়। এই সভাতেই ভাষণ দেওয়ার সময় সুভাষ ঘোষণা করেন যে তাঁর বাহিনীতে মহিলারাও এগিয়ে এসে অংশগ্রহণ না করলে তাঁর পরিকল্পনা পুরোপুরি সফল হবে না। উল্লেখযোগ্য যে এই সভায় উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় তরুণী লক্ষ্মী স্বামীনাথন (পরবর্তীকালে সেহগল) যিনি অদূর ভবিষ্যতেই হয়ে উঠবেন সুভাষের স্বপ্নের ঝাঁসির রাণী বাহিনীর প্রধান। ৯ই জুলাই আরেক সভাতেও সুভাষ মহিলা বাহিনী গড়ে তোলার পরিকল্পনা ব্যক্ত করেন। তিনি স্পষ্ট করে দেন, এই বাহিনী কোনো প্রতীকি দল হবে না, তিনি সত্যিই ভারতীয় মহিলাদের সামরিক পদে দেখতে চান। তাঁর এই বক্তব্যে আলোড়ন পড়ে যায় প্রবাসী ভারতীয় সমাজে। লক্ষ্মী জানিয়েছেন, এই সভার পর তিনি সারারাত জেগে এই বিষয়ে চিন্তাভাবনা করেছিলেন।

আইএনএ-র সিঙ্গাপুর শাখার সভাপতি শ্রী আট্টাভার ইয়েলাপ্পার অনুরোধে লক্ষ্মী, যিনি আগে থেকেই ইন্ডিয়ান লিবারেশনের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন এবং বিমানবন্দরে সুভাষকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন, এরপরই ১২ জুলাই আইএনএ-র সভায় সুভাষকে মহিলাদের দ্বারা গার্ড অফ অনার দেওয়ার উদ্যোগে সামিল হন। শুরু হয় কুড়িজন মহিলা স্বেচ্ছাসেবীর খোঁজ, যাঁরা সামরিক কায়দায় সুভাষের হাতে তুলে দেবেন অস্ত্র। কাজটা সহজ ছিল না, কিন্তু আন্তরিক প্রচেষ্টার পর সিঙ্গাপুরে কুড়িজন মহিলাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়। গবেষকদের মতে এই কুড়িজনই ছিলেন পরবর্তীকালে গঠিত সুভাষের রাণী লক্ষ্মীবাঈ ব্রিগেডের প্রাণ। এই কুড়িজন সামরিক ধাঁচের প্রশিক্ষণ নেন এবং ড্রিল শেখেন। ওজনে যথেষ্ট ভারি আইএনএ ব্যবহৃত এনফিল্ড রাইফেল সুভাষচন্দ্রের হাতে তুলে দেওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

১২ জুলাই সভার আগেও তাঁদের কড়া সামরিক প্রশিক্ষণ চলে এবং তাঁরা সুভাষচন্দ্রের হাতে তুলে দেন .৩০৩ রাইফেল। স্বাভাবিকভাবেই সুভাষের কাছে সম্মেলনের এই অনুষ্ঠান গোপন রাখা হয়েছিল। নিজের স্বপ্নের মহিলা বাহিনীর আদি রূপ দেখে সুভাষচন্দ্র অত্যন্ত খুশি হন এবং পরের দিনই এই বাহিনীর গঠন প্রক্রিয়া আলোচনা করার জন্য লক্ষ্মীকে ডেকে পাঠান। এই ভাবেই সূত্রপাত হয় রাণী লক্ষ্মীবাঈ ব্রিগেডের। সুভাষ এর ভার লক্ষ্মীর হাতেই দেন।

রাণী লক্ষ্মীবাঈ বাহিনীর প্রত্যেক মহিলা সদস্যকে রাণী বলেই সম্বোধন করা হত। এই বাহিনীর নামকরণ করার ব্যাপারে সুভাষ রাজনৈতিকভাবে খুবই সচেতন ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন এমন এক নাম যা সর্বভারতীয়, আঞ্চলিক নয়, যা সবার কাছে সুপরিচিত এবং যার মাহাত্ম্য যে কোনো ভারতীয়ের কাছে সন্দেহাতীত। একইসঙ্গে তিনি চেয়েছিলেন এই বাহিনীকে নামের দিক থেকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে যুক্ত করে দেশপ্রেমের চেতনা জাগাতে। তাঁর বাহিনীর রাণীদের মধ্যে এমন অনেকেই ছিলেন যাঁদের জন্ম পর্যন্ত ভারতের মাটিতে হয়নি। তা সত্ত্বেও এই বাহিনীকে অনেক পুরুষ সৈনিকও ভারতীয় ঐতিহ্যে সম্পৃক্ত মাতৃপূজন বা মাতৃশক্তির উদযাপন বলেই মনে করতেন।

নারীমুক্তির পথের সন্ধান দিলেও, সুভাষচন্দ্র উনবিংশ শতকের শেষ দিকের বিপ্লবী সংগঠনগুলোর সঙ্গে নারী ও যৌনতা নিয়ে প্রায় সহমত ছিলেন। তাই তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের যে সমস্ত প্রশিক্ষক রাণীদের সামরিক প্রশিক্ষণের কাজে নিযুক্ত ছিলেন, তাঁদের নারী-পুরুষ সম্পর্ক নিয়ে রামকৃষ্ণের নৈতিক মতবাদ পালন করতেই পরামর্শ দিতেন। অর্থাৎ ভারতীয় চেতনায় নারীর যে ছবি নিহিত ছিল, তার থেকে একেবারে উল্টো পথে হাঁটেননি সুভাষচন্দ্রও।

আজাদ হিন্দ বাহিনীর মেজর জেনারেল কিয়ানি জানিয়েছেন, রাণী বাহিনী গঠনের আগে সুভাষ তাঁদের কারোর সাথেই পরামর্শ করেননি। কিয়ানি নিজের স্ত্রীকে এই বাহিনীর সৈনিক হিসেবে কুচকাওয়াজ করতে দেখে আশ্চর্য এবং বিরক্ত হন, কিন্তু তিনি রাণী বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেননি কারণ তাঁকে জানানো হয়েছিল, এই বাহিনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে না, এঁদের ভূমিকা শুধুই প্রতীকি। ভেরা হিল্ডারব্যান্ড তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন, নারীর অবস্থান বার্মা বা মালয়ে খুব উঁচু ছিল না। এমনকি ভারতীয় অংশের মধ্যেও মহিলা সৈনিকের ধারণা খুব একটা গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাই বোধহয় ১৯৪৭ সালের পর লেখা বইতে জেনারেল চ্যাটার্জি ভারতীয় মেয়েদের সীতা ও সাবিত্রীর সাথে তুলনা করে রাণী বাহিনী গঠনের পরিকল্পনার সপক্ষে জোরালো সওয়াল করেছেন।

আজাদ হিন্দ ফৌজের আরেক সদস্য মেহেরবান সিংয়ের মতে এই বাহিনী কখনোই যুদ্ধক্ষেত্রে যাবে বলে মনে করা হয়নি। কিন্তু সামরিক বাহিনীতে ইউনিফর্ম পরে, অস্ত্র হাতে ভারতীয় মেয়েদের কুচকাওয়াজের মধ্যে দিয়ে প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটানোই এই বাহিনীর সার্থকতা বলে মনে করা হয়েছিল। সত্যিই প্রচুর প্রশিক্ষণ, সামরিক শৃঙ্খলায় জীবনযাপন, শত্রুর আক্রমণের বিপদ সহ্য করেও, রাণী বাহিনী কখনোই সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়নি। আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিকরা যখন যুদ্ধে আহত বা নিহত হয়েছেন, এই মেয়েদের মূলত তাঁদের সেবার কাজেই নিযুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে একটা সময়ে বাহিনীর অনেক সদস্যাই অবসাদে ভুগছিলেন। তা সত্ত্বেও পরবর্তী জীবনেও রাণীরা সর্বদাই সুভাষচন্দ্রের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।

তবে ঐতিহাসিক এইচ এন পণ্ডিত ১৯৮০-র দশকে প্রকাশিত বইয়ে লিখেছিলেন, সুভাষের পরিকল্পনা ছিল ঝাঁসির রাণী বাহিনীর আশিজনের কাছাকাছি সুশিক্ষিত সৈনিককে বেছে নিয়ে তাঁদের যুদ্ধের ময়দানে পাঠানো, যাতে তাঁদের আত্মত্যাগ একইসঙ্গে ব্রিটিশ সেনা ও ব্রিটিশবাহিনীতে কর্মরত ভারতীয় সৈনিকদের মনে তীব্র আঘাত করে। রাণীদের কেউ কেউ পরবর্তীকালে জানিয়েছেন তাঁরা এই পরিকল্পনার কথা জানতেন এবং সেভাবেই তৈরি হয়েছিলেন।

যাই হোক, ঝাঁসির রাণী বাহিনী সংগঠনের জন্য সুভাষচন্দ্রের অবশ্যই প্রশংসা প্রাপ্য, কারণ তিনি এমন একটা সময়ে নারী বাহিনী গড়ে তোলার কথা ভেবেছিলেন, যখন ভারতীয় মধ্যবিত্তদের মধ্যে মেয়েদের বাড়ির বাইরে আসতে দেওয়া, কাজ করতে দেওয়া নিয়ে বিস্তর দ্বিধা ছিল। তাই যুদ্ধক্ষেত্রে না গিয়েও রাণীরা এক গৌরবজ্জল ইতিহাস নির্মাণের অংশ হয়ে উঠেছিলেন, এ কথা বললে ইতিহাসের অপলাপ হবে না।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.