সুদীপ গুপ্ত
বাহাত্তর বছর বয়সে সুভাষ ভৌমিকের প্রয়াণের পর যত লেখালিখি হচ্ছে তাতে কোচ সুভাষ ভৌমিকের অবদান নিয়ে অনেক কথা থাকছে। বেশিরভাগ নবীন প্রজন্মের মানুষই কোচ সুভাষকে স্মরণ করছেন। ক্লাব ফুটবলে কোচ হিসাবে তাঁর অন্তত একটি স্মরণীয় অবদান তো আছেই, সে কথায় পরে আসছি। কিন্তু আমাদের মত যারা ফুটবলার এবং কোচ — দুই ভূমিকাতেই সুভাষ ভৌমিককে দেখেছে, তাদের কাছে ফুটবলার সুভাষ ভৌমিক সবসময় এগিয়ে থাকবেন। ভারতীয় ফুটবলে কোন সুভাষের অবদান বেশি তা ভাবতে গেলে নিঃসন্দেহে বলতে হবে ফুটবলার সুভাষের অবদানই বেশি। কারণ ফুটবলার সুভাষ দেশকে আন্তর্জাতিক সম্মান এনে দিয়েছেন। ১৯৭০ মারডেকা কাপে ভারতের তৃতীয় স্থান অধিকার করায় সুভাষের বিপুল অবদান। সে বছরই এশিয়ান গেমসে ভারতীয় ফুটবল দল শেষবারের মত মেডেল জয় করে। বাহান্ন বছর আগের সেই জয়েও সুভাষের ভূমিকা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত।
সেবার এশিয়ান গেমস হয়েছিল থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাঙ্ককে, আর প্রথম দিনেই আয়োজক দেশের সঙ্গে ছিল ভারতের খেলা। ম্যাচ শুরুর একত্রিশ মিনিটের মধ্যেই ভারত দু গোলে পিছিয়ে পড়ে। ভারতীয় দলের দুই স্ট্রাইকার মহম্মদ হাবিব আর সুভাষ ভৌমিক ছাড়া প্রায় কেউই ভাবেননি সেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব। তাঁদের দুরন্ত প্রতিআক্রমণে হাফটাইমের কিছুক্ষণ আগে সুভাষের গোলে সমতা ফেরে, দ্বিতীয়ার্ধে ফের সুভাষের গোলেই এক পয়েন্ট নিশ্চিত হয়। তারপর আর ভারতীয় দলকে ফিরে তাকাতে হয়নি। মনে রাখতে হবে, কোনো সাফল্যকেই আন্তর্জাতিক সাফল্যের উপরে স্থান দেওয়া যায় না। কোচ সুভাষ জাতীয় দলের দায়িত্বে ছিলেন মাত্র একবার, ১৯৮৯ সালে। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন সেই দল একেবারেই ভাল খেলতে পারেনি। অথচ ফুটবলার সুভাষ দেশকে ট্রফি এনে দিয়েছেন। আসলে ভারতে বা কলকাতায় বড় ফুটবলার অনেক এসেছেন, কিন্তু আন্তর্জাতিক স্তরে সফল হওয়ার মত ফুটবলার হাতে গোনা। সুভাষ তাঁদের মধ্যে একজন।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
এবার কোচ সুভাষের আলোচনায় আসি। কলকাতার বড় ক্লাবগুলো সুভাষ কোচ হওয়ার আগেও ট্রফি জিতেছে, পরেও। তা নিয়ে আলাদা করে খুব কিছু বলার নেই। সুভাষের চমকপ্রদ সাফল্য এসেছিল ২০০২-০৩ মরসুমে ইস্টবেঙ্গলের কোচ হিসাবে। বিশেষত জাকার্তায় আসিয়ান কাপ জয় ভারতীয় ক্লাব ফুটবলের এক মাইল ফলক। তার পিছনে কোচ হিসাবে অবশ্যই সুভাষের বিরাট ভূমিকা ছিল। কেবল কোচ নয়, তিনি প্রকৃতপক্ষে একা হাতে দলের ম্যানেজারের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। তিনি ইস্টবেঙ্গলকে শুধু বিদেশ থেকে ট্রফি জিতে আনার স্বপ্নই দেখাননি, সে স্বপ্ন কী করে সফল করতে হয় তা-ও দেখিয়ে দিয়েছিলেন। ফিজিকাল ট্রেনার রাখা, গোটা দলকে পাঁচতারা হোটেলে রাখা, আবাসিক ক্যাম্প করার মত আরও অনেককিছু তিনি সেই দলের জন্য করেছিলেন যা কলকাতার ফুটবলে আগে কখনো হয়নি। এমনকি বিজয় মালিয়াকে বলে দলের প্রস্তুতির জন্য অতিরিক্ত টাকাপয়সার ব্যবস্থাও করেছেন সেইসময়। তবু আসিয়ান কাপ জয়ের কৃতিত্ব একা সুভাষের নয়, গোটা দলের। সেই মরসুমে ইস্টবেঙ্গলের দলটি ছিল তারকাখচিত। বাইচুং ভুটিয়া, মহেশ গাওলি, দেবজিৎ ঘোষ, সন্দীপ নন্দী, অ্যালভিটো ডি কুনহা, মাইক ওকোরো, ডগলাস ডি’সিলভা — কে ছিলেন না সেই দলে? সুভাষ ভৌমিকের কৃতিত্ব হল এতজন তারকাকে সামলানো এবং লক্ষ্য স্থির রেখে গন্তব্যের দিকে নিয়ে যাওয়া। শেষপর্যন্ত খেলাটা মাঠে নেমে ফুটবলারদেরই তো খেলতে হয়। ওই টুর্নামেন্টে বাইচুঙের দুরন্ত ফর্ম না থাকলে সুভাষের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও হয়ত ইস্টবেঙ্গলকে খালি হাতেই ফিরতে হত।
ফুটবলার সুভাষের সাফল্য কিন্তু একেবারেই নিজস্ব। উত্তরবঙ্গ থেকে একটি ছেলে কলকাতায় খেলতে এল। প্রথম মরসুমে স্পোর্টিং ইউনিয়ন, পরের মরসুমে রাজস্থান ক্লাব, তারপরেই বড় দলে জায়গা করে নিল। পরের দশ-এগারো বছর সে ময়দান দাপিয়ে বেড়িয়েছে, কলকাতার এক নম্বর ফুটবলার হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। এর কৃতিত্ব তো আর কাউকে দেওয়া যায় না। সুভাষ ক্রমশ নিজেকে অপরিহার্য করে তুলেছিলেন। ১৯৭৬ সালে যখন তিনি ইস্টবেঙ্গল থেকে মোহনবাগানে খেলেন তখন পারিশ্রমিক হিসাবে পেয়েছিলেন ৪০,০০০ টাকা। এখন টাকার অঙ্কটা কারো বিস্ময়ের উদ্রেক করবে না, কিন্তু তখন সুভাষই হয়ে উঠেছিলেন কলকাতার সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া ফুটবলার। অত টাকা তখন পর্যন্ত কলকাতার কোনো ক্লাব কোনো ফুটবলারের জন্য খরচ করেনি।
বছর তিরিশেক বয়সেই সুভাষ অবসর নেন। যাঁরা মুগ্ধ হয়ে তাঁর খেলা দেখেছেন, খেলোয়াড় জীবন আরেকটু দীর্ঘায়িত হলে হয়ত তাঁরা খুশি হতেন। কেন তিনি এমন করলেন? একাধিক কারণ থাকতে পারে। যেমন সুভাষের খেলার প্রাণ ছিল তাঁর অবিশ্বাস্য গতি, শক্তি আর সাহস। শেষদিকে তাঁর গতি কিছুটা মন্থর হয়ে গিয়েছিল। হয়ত সেই অভাব তিনি অনুভব করছিলেন। মানসিক ক্লান্তিও হয়ত অন্যতম কারণ। ভারতের মত দেশের হয়ে খেলে যিনি তিরিশ বছর বয়সের মধ্যেই আন্তর্জাতিক মেডেল জয় করে ফেলেছেন, ক্লাব ফুটবলের প্রায় সব ট্রফিই জেতা হয়ে গেছে, তিনি আর কিসের লক্ষ্যে খেলবেন? আরেকটি জোরালো কারণ, যার জন্যে কিংবদন্তী চুনী গোস্বামীও সুভাষের মত বয়সেই ফুটবল থেকে বিদায় নিয়েছিলেন, তা হল সেই সময়কার তথাকথিত পেশাদারি ফুটবলে পারিশ্রমিকের পরিমাণ। তখন আই এস এল ছিল না, এক মরসুমেই কোটিপতি হওয়া স্বপ্নেও সম্ভব হত না। ফুটবলাররা সকলেই চাকরি-বাকরি করতেন এবং আয়ের মূল উৎস ছিল সেটাই।
সুভাষ ভৌমিক সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি করে যে কথাটা বলা দরকার, তা হল তাঁর মৃত্যুতে বাঙালির আরেকটি গর্বের জায়গা ফাঁকা হয়ে গেল। গর্ব করার মত বাঙালি ফুটবলার ক্রমশ বিরল হয়ে গেছে। সুভাষ, সুব্রত ভট্টাচার্যদের সারা ভারত চিনত। তাঁদের নিয়ে বাঙালি গর্ব করতে পারত।
নিবন্ধকার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। একনিষ্ঠ ফুটবলপ্রেমী।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।