নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মবার্ষিকীর মাত্র দুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী হঠাৎ ঘোষণা করলেন অমর জওয়ান জ্যোতির জায়গায় বসবে নেতাজির গ্রানাইট মূর্তি, আর যতদিন না মূর্তি তৈরি হয়, ততদিন থাকবে হলোগ্রাম। স্বভাবতই এই ঘোষণা দেশব্যাপী রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অমর জওয়ান জ্যোতি নির্বাপিত করা যুদ্ধে মৃত সৈনিকদের অপমান করা কিনা, নেতাজির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের অছিলায় ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা কিনা, সে বিতর্ক সহজে থামবার নয়। অনেকেই বলছেন এভাবে নেতাজিকে সম্মান করার বদলে অসম্মানই করা হল। এই প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দিতে চাই, নেতাজির জন্মদিবসকে নিজেদের মর্জিমত ব্যবহার করে তাঁর স্মৃতিকে অসম্মান করার চেষ্টা বিজেপি সরকার এই প্রথম করল না। সে উদ্দেশ্যেই এই নিবন্ধের অবতারণা।
স্বাধীনতার ৭৩ বছর পর, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিনকে ভারত সরকার পরাক্রম দিবস বলে ঘোষণা করে। নেতাজি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ফরওয়ার্ড ব্লকের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল ২৩ জানুয়ারিকে দেশপ্রেম দিবস বলে ঘোষণা করা হোক। মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার দিনটিকে দেশনায়ক দিবস হিসাবে পালন করছিল। দেশনায়কের বদলে পরাক্রম শব্দটির ব্যবহার নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী খানিক উষ্মাও প্রকাশ করেছিলেন সেই সময়ে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার দেশপ্রেম বা দেশনায়কের বদলে পরাক্রম শব্দটিকেই নেতাজির জন্মদিনের সঙ্গে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করেছিল। নিন্দুকের প্রশ্ন হল, দেশপ্রেম থেকে পরাক্রম — এতদিন পরে হঠাৎ এই ভিন্ন শব্দ চয়নের তাৎপর্য কী?
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
দেশনায়কের তো পরাক্রমই স্বাভাবিক, আর তার উৎপত্তিও তো দেশপ্রেমেই। তাহলে এই আপাতবিরোধহীন শব্দগুলিতে আপত্তিকর কিছু কি আদৌ আছে?
সংকীর্ণ দলগত বাদানুবাদ বাদ দিলেও আপত্তির অবকাশ থাকে বৈকি। কারণ এই শব্দগুলির সূক্ষ্ম পার্থক্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মতাদর্শের বীজ। এই পার্থক্য বিজেপি বনাম তৃণমূলের নয়। এই পার্থক্য দৃষ্টিকোণের, ইতিহাস বিচারের, আগামীর পরিকল্পনারও।
সমাজের নায়ক দরকার আগামীর দিকদর্শনের প্রয়োজনে, তাই নায়কের উদযাপনও দরকার। সে উদযাপনের নামকরণে এমন একটি বার্তা দেওয়া দরকার, যা সমাজের কাছে একটি নির্দিষ্ট ছবি তুলে ধরতে পারে। সেই ছবি যেমন ব্যক্তি ইতিহাসের প্রতিনিধি, তেমনই সেই বার্তা উদযাপনেও নিহিত থাকে ভবিষ্যৎ সমাজের কাঙ্খিত রূপরেখা। মুশকিল হল, ইতিহাসের ঘটনাবলী কোনো সরলরেখা মেনে চলে না। অতীতের নির্মাণ, বিনির্মাণ, পুনর্নির্মাণ — রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সবই একেকটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, এবং কৌশলও। ইতিহাসের ন্যারেটিভ নির্মাণও তো আসলে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডাই।
পরাক্রম শব্দটির মধ্যে ধ্বনিত হয় বীরত্বের উচ্চকিত ইঙ্গিত। সুভাষচন্দ্র থেকে নেতাজি হয়ে ওঠার দীর্ঘ প্রক্রিয়ার অন্তিম বিন্দুর যে ছবি সমাজের মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে, তা হল যুদ্ধের পোষাকে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেই সর্বাধিনায়কের, যিনি রক্তের বদলে ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা এনে দেওয়ায় ব্রতী এক অমিতবিক্রম পুরুষ। সেনাপতির এই ছবিও এক রাজনৈতিক প্রতীক, আজাদ হিন্দ ফৌজের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের অবয়ব। এই ভাবমূর্তি কালজয়ী, ঐতিহাসিক। পরাক্রম শব্দটি সুভাষের ওই সামরিক পোশাক পরিহিত ছবিরই অনুষঙ্গ বহন করছে। আজাদ হিন্দ বাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের প্রতিধ্বনি রয়েছে ওই শব্দে।
সুভাষচন্দ্র ১৯২৮ সালে কলকাতার কংগ্রেস অধিবেশনে গার্ড অফ অনারের আয়োজন করে দু হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবককে মিলিটারি ইউনিফর্ম পরিয়ে মার্চ করিয়েছেন, এমনকি নিজের জন্যেও হারমান কোম্পানি থেকে ব্রিটিশ সেনা অফিসারের পোশাক বানিয়ে পরে সেলাম নিয়েছেন। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি দেশবাসীর সেনাবাহিনী গঠন করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে আক্রমণ করেছেন। এমন মানুষকে বীর বা পরাক্রমী বললে এমনিতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু সুভাষচন্দ্র মানে কি শুধুই আস্ফালন, প্রবল পরাক্রম? তিনি কি শুধুই সামরিক লড়াইয়ের প্রতীক?
নেতাজি শুধু পরাক্রমী রাষ্ট্রনায়ক নন, দেশনায়কও। দেশনায়কের একাধারে অনেক পরিচয় — সেনাপতি, রাজনীতিবিদ, পথপ্রদর্শক, ভবিষ্যতের দিশারী। তাঁর রাজনৈতিক মূল্যবোধগুলিকে শুধুই যুদ্ধক্ষেত্রের পরাক্রম দিয়ে কি প্রকাশ করা যায়?
প্রশ্ন উঠতেই পারে, পরাক্রম কি দেশপ্রেমের হতে পারে না? অবশ্যই পারে। দেশপ্রেমই তো পরাক্রমের উৎস, দেশপ্রেম থেকেই তো দেশনায়কের উদ্ভব। তবে আপত্তি কেন? আপত্তির অবকাশ থাকে না, যতক্ষণ সেই দেশপ্রেমের ভিত্তি হয় গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা। যতক্ষণ না পরাক্রমে চাপা পড়ে যায় সহনশীলতা, ভ্রাতৃত্ব, সুভাষচন্দ্রের সমতা, ঐক্যের বার্তা। যাঁরা সুভাষের শুধু পরাক্রমটুকুই দেখতে পান, তাঁর অসাম্প্রদায়িক একতার ধারণা, সামাজিক-অর্থনৈতিক ন্যায়ের মূল্যবোধগুলি দেখতে পান না বা চান না, তাঁরা কি পারবেন তাঁর পরাক্রমকে সম্মান জানিয়েও তা অতিক্রম করে তাঁর দার্শনিক মূল্যবোধগুলো বুঝতে? তাঁকে পরাক্রমী থেকে দেশনায়ক করে তুলতে?
মজা হল, পরাক্রম আর দেশপ্রেম — এই দুটি শব্দই উচ্চারণ করা মাত্র এসে পড়ে জাতীয়তাবাদের অনুষঙ্গ। দুটির সঙ্গেই জাতীয়তাবাদের ধারণাকে যেমন মেলানো যায়, তেমনি খুঁটিয়ে ভাবলে উল্টোদিকেও দাঁড় করানো যায়। জনমনে দেশপ্রেম থেকেই জাতীয়তাবাদী আবেগের উদ্ভব। ফলে দুটি শব্দই একই আবেগ সঞ্চারিত করে। ইতিহাসের সব নায়কের মতই সুভাষচন্দ্রও এক আবেগের নাম। তাই তিনি নেতাজি। কিন্তু রাষ্ট্রের সঙ্গে দেশের পার্থক্য যতখানি, তার নায়কদের মধ্যেও ততখানিই। সেই পার্থক্য শুধু নামকরণ বা ব্যাকরণের নয়, ভবিষ্যতের রূপরেখার, আদর্শের, কল্পনারও। রাষ্ট্র থেকে দেশ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্যেই নিহিত আছে সুভাষচন্দ্র বসু থেকে নেতাজি হয়ে ওঠার ইতিহাস।
সুভাষচন্দ্রের রাজনীতিকে ভুলিয়ে দিয়ে উদযাপনের নামকরণে শুধুই আক্রমণের আমেজ ধরা থাকলে মানুষের মনে তৈরি করে দেওয়া যায় দেশপ্রেমেরও এক নির্দিষ্ট ধারণা — সামরিক জাতীয়তাবাদ (military nationalism)। প্রশ্ন ওঠে, নেতাজি কি তাহলে সামরিক জাতীয়তাবাদেরই প্রতীক? আসলে গণভাবনায় যদি তাঁর মূল পরিচয় তৈরি হয় হিন্দু পূজারী এক সেনানায়ক হিসাবে, তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজবাদকে ছাপিয়ে সামরিকতাবাদকেই তাঁর দর্শনের মূল নির্যাস হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। দেশনায়কের ধারণার সাথে সামরিক জাতীয়তাবাদ মেশালে পাওয়া যায় দেশপ্রেমের নামে সামরিক জাতীয়তাবাদের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, অতি ডান থেকে অতি বাম — এই রোগে সবাই ভুগেছে। হিটলার-মুসোলিনি থেকে শুরু করে স্তালিন-কাস্ত্রো-মাও সে তুং, সকলেরই সামরিক পোশাক পরিহিত ছবিরই পুজো করেছে রাষ্ট্র, প্রচার করেছে সবচেয়ে বেশি। আসলে রাষ্ট্রনেতার রূপকল্পনার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে রাষ্ট্র পরিচালনার দৃষ্টিকোণ।
দেশপ্রেম দিবস বনাম পরাক্রম দিবস — এই দুই নামকরণেই ধরা পড়ে যায় দুই বিপরীত মতাদর্শের গভীর পার্থক্য। সেই মতাদর্শ দেশকে দেখার, দেশের নেতাকে দেখার। প্রশ্ন হল, সুভাষচন্দ্রকে আমরা কীভাবে দেখব? সেনানায়ক নাকি এক স্বাধীনতাকামী দার্শনিক? কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন, সেনাপতি হলে কি দেশনেতা হওয়া যায় না? বিরোধ কোথায়? কোনো বিরোধ নেই, কিন্তু অপরিহার্যতাও তো নেই। এই উভয় সঙ্কট আবার আমাদের দাঁড় করায় এক অনিবার্য প্রশ্নের সামনে — শক্তির সর্বোত্তম রূপ কী? সামরিক শক্তিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ? বন্দুকের নলই কি তবে রাজনৈতিক শক্তির উৎস?
সতর্ক থাকতে হবে, দেশপ্রেম যেন সামরিক জাতীয়তাবাদে পর্যবসিত না হয়। সুভাষচন্দ্রের ভারতবর্ষকে পাহারা দিতে হবে। সেই ভারত যেখানে নারীর স্থান রান্নাঘরে নয়, ঝাঁসীর রানী রেজিমেন্টে, পুরুষ সৈনিকদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে। ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক লড়াইয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়াই নেতাজির মুখ্য ভূমিকা। তিনি নিঃসন্দেহে সেনানায়ক, কিন্তু সামরিক লড়াই তাঁর রাজনৈতিক সংগ্রামের একটি অংশ মাত্র, একটি কৌশলও বটে। পরিস্থিতির প্রয়োজনে হিংসার পথ বাছলেও সেই পথের দিকদর্শন সাম্যের, সাম্প্রদায়িক ঐক্যের, স্বাধীনতার। সেই একই পথ যার দিশারী স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, যিনি সুভাষকে ‘দেশনায়ক’ অভিধা দিয়েছিলেন।
মনীষীরা কোনো একটি কারণেই কাল্ট ফিগার হয়ে ওঠেন না। তাঁরা নিজের সময়কে অতিক্রম করে জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে, সমাজের সর্বস্তরে সার্বিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে পারেন, তাই কাল্ট ফিগার হয়ে যান। নিজের পছন্দমত যে কোনো মনীষীর কিছু নির্দিষ্ট মতামত বেছে নিয়ে শুধুমাত্র সেগুলির উদযাপন, আর অপছন্দের মতামত ভুলিয়ে দেওয়া — এ এক বহু ব্যবহৃত রাজনৈতিক কৌশল। উদযাপনের মধ্যেই থাকে আত্মসাৎ করে নেওয়ার কূট প্রচেষ্টা, সে রাষ্ট্রই করুক বা কোনো দল অথবা কোনো গোষ্ঠী। যখন জাতির জনক প্রায় পৌরসভার পোস্টার বয় হয়ে ওঠেন, অহিংসার বার্তা ঢেকে যায় জঞ্জাল সাফাইয়ের ডাকে, তখন সন্দেহ জাগে এ হেন প্রবল পরাক্রমের কাছে দুর্বল হয়ে পড়বে না তো সুভাষচন্দ্রের ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজবাদের রাজনীতি? এই প্রশ্ন অবশ্যম্ভাবী, কারণ সুভাষচন্দ্রের ভারতবর্ষে “জয় হিন্দ” মানে ঐক্যের বার্তা, “হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান” নয়। সুভাষচন্দ্রের বৈদিক আধ্যাত্মিকতায় “জয় শ্রীরাম” আসলে অন্তরাত্মাকে আহবান, কোনো দলীয় আস্ফালন নয়।
স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষের প্রথম যুগে নেতাজিকে ব্রাত্য রাখাই ছিল সেদিনের শাসকের রাজনৈতিক প্রয়োজন। আজকের শাসকের সুভাষচন্দ্রকে আত্মসাৎ করার সুযোগ ও সুবিধা — দুইই বেশি। সুভাষচন্দ্র একাধারে হিন্দু ধর্মীয় আচার-আচরণ মানা উপাসক, আবার সেনানায়কও। সে অর্থে তিনি আজকের শাসকদের কাঙ্খিত দেশনায়কের মূর্তির অনেক কাছাকাছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পাকে চক্রে তাঁকে ব্রিটিশবিরোধী আঁতাত করতে হয়েছিল নাজিদের সাথে, গান্ধীর অহিংসার মতাদর্শের থেকে ভিন্ন তাঁর স্বাধীনতা লাভের সহিংস রোডম্যাপ। উপরন্তু দীর্ঘদিন জনমানসে লালিত হয়েছে কিছু বাইনারি। নেহরুর সমাজতান্ত্রিক বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের বিপরীতে দাঁড় করানো হয়েছে সোশালিস্ট ডিক্টেটরশিপের প্রচ্ছন্ন আবেদনকে। এই বিতর্কিত অবস্থানগুলির সাথে আজকের শাসকদের সহজাত সহাবস্থান। সমাজতান্ত্রিক ভাবনাটি তাদের কাছে গৌণ, এক অবিসংবাদী নেতার একনায়কত্বের আবেদনই মুখ্য। যা ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক শাসন শৈলীকে বৈধতা দিতে জরুরি।
জনগণের যৌথ ধারণা ইতিহাসের জটিল তথ্য বিশ্লেষণ দিয়ে গড়ে ওঠে না। ঐতিহাসিক মুহূর্তের কিছু অবস্থান থেকেই উঠে আসে কিছু চেহারা যারা কালজয়ী হয়ে যায়। কিছু ছবি, কিছু প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় সেই সময়ের প্রতিভূ। সেগুলিকে ঘিরে যৌথ আবেগ জন্ম নেয়, বেঁচে থাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম, যতক্ষণ না সময় পরিবর্তন দাবি করে। এভাবেই বারংবার তৈরি হন যৌথ স্মৃতির ঐতিহাসিক চরিত্রেরা।
আসলে এই মুহূর্তে সুভাষচন্দ্রের এক রাজনৈতিক পুনর্নির্মাণ চলছে। দেশনায়ক মানে হিন্দুধর্মের পূজারী এবং সেনানায়ক। এই মিশ্রণ শাসকের ভবিষ্যৎ ভারতবর্ষের কল্পনারও মূর্ত রূপ। এ এক রাজনৈতিক প্রকল্প। ভারতবর্ষের ধারণারই পুনর্নির্মাণের প্রকল্প। একই প্রকল্পে যেমন বিবেকানন্দ হয়ে থাকেন শুধুই হিন্দু মসিহা, চাপা পড়ে যায় তাঁর বৈদান্তিক সাম্যবাদ, শূদ্র জাগরণের ডাক; যেমন রবীন্দ্রনাথ হয়ে থাকেন শুধুই জাতীয়সঙ্গীত রচয়িতা, বড়জোর উপনিষদের পূজারী, আড়ালে চলে যায় তাঁর আন্তর্জাতিকতাবাদ, ঢেকে যায় হিন্দু সমাজ সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাস; যেমন মানুষের মন থেকে সুকৌশলে মুছে দেওয়া হয় গান্ধীর অহিংস মূল্যবোধগুলি। সুভাষচন্দ্রের জন্মদিনকে পরাক্রম দিবসে পরিণত করা এবং অমর জওয়ান জ্যোতির জায়গায় তাঁর মূর্তি স্থাপন আসলে তাঁর আজীবন ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে দুটি পদক্ষেপ।
প্রজা তো চিরকালই দর্শক, তারা তাই দেখে যা নেতারা দেখায়, দেখাতে চায়। সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক স্বাধীনতা রবীন্দ্রনাথের পূর্ণ মানবিক স্বাধীনতারই প্রাথমিক ধাপ। আমরা কি সেই পথের দিশা দেখতে পাচ্ছি, নাকি শুধু দেখছি তার খণ্ডিত রূপ? আজকের রাজার প্রবল পরাক্রমে সেই মুক্তির পথ অবরুদ্ধ হবে না তো?
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।