দেবজিৎ ভট্টাচার্য

রাজ্য সরকারের পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরগরম। সাধারণ মানুষ ও চাকরিপ্রার্থীদের উপর রোজ আছড়ে পড়ছে একের পর এক অবিচারের কাহিনী। এ-সবের সুযোগ নিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলি ব্যবহার করে রাজ্যের সরকারকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করছে৷ ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। বিজেপির লক্ষ্যটা স্পষ্ট, নির্বাচনে না পেরে ঘুরপথে এই রাজ্যের শাসনক্ষমতা দখল। এই কারণেই সিবিআই, ইডি সহ কেন্দ্রীয় এজেন্সির হর্তাকর্তারা কার্যত বাংলার অলি-গলিতে ঘোরা ফেরা করছেন। নিঃসন্দেহে বলা যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের কাজকর্ম কেন্দ্রীয় সরকারকে এই আগ্রাসন চালানোর সুযোগ করে দিচ্ছে৷ এ-সবের মধ্যেই নরেন্দ্র মোদীর সরকার গোটা দেশের পুলিশি ব্যবস্থার সংস্কারের দাবি তুলেছে।  বলা হচ্ছে- ‘ওয়ান নেশন- ওয়ান পুলিশফোর্স’ ব্যবস্থা চালু হবে। এক দেশে একটিই পুলিশবাহিনী থাকবে, নয়তো আইনশৃঙ্খলার সমস্যা কমবে না– এমনটাই যুক্তি দিল্লির।
 
২০০৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় দেয়৷ তার ভিত্তিতে মডেল পুলিশ অ্যাক্ট-২০০৬ তৈরি হয়। তাকে ভিত্তি হিসাবে ধরেই এই ‘ওয়ান নেশন- ওয়ান পুলিশ ফোর্স’ কার্যকর করতে চাইছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার।
 
গত ২রা মে রাজ্যগুলিকে  কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের ‘জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ’-এর তরফ থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে এই বিষয়ে। গোটা দেশের পুলিশের জন্য ‘এক উর্দি, এক টুপি, এক এমব্লেম, এক পতাকা’ চালু করার লক্ষ্য নিয়েই রাজ্য পুলিশের প্রধানদের এই চিঠি পাঠানো হয়েছে। অন্য রাজ্যের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের ডিজি মনোজ মালব্যকেও এই চিঠিতে রাজ্যের পুলিশ দফতর/পুলিশবাহিনী বিষয়ক বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হয়েছে। তার মধ্যে সব থেকে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন রাজ্য পুলিশের স্তর বিন্যাস সম্পর্কে। সেই চিঠিতে সরাসরি প্রশ্ন করা হয়েছে, রাজ্য পুলিশবাহিনীরস্তর বিন্যাস ঠিক কেমন? বলা হয়েছে দ্রুত বিশদে জানাতে হবে দিল্লিকে।
 
মনে রাখা দরকার, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় প্রতিটা রাজ্যের আলাদা আলাদা পতাকার স্বীকৃতি রয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের সপ্তম তফসিল মোতাবেক এই ব্যবস্থা, যা সম্পূর্ন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণাধীন বিষয়। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজ্যগুলির সমস্ত অধিকার নিজেদের হাতে নেওয়ার উদ্যোগ নিতে এর আগেও কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে দেখা গিয়েছে। মনে করে দেখুন, ওয়ান নেশন- ওয়ান ইলেকশন, ওয়ান নেশন-ওয়ান রেশনকার্ড, ওয়ান নেশন- ওয়ান ল্যাংগুয়েজ প্রভৃতি স্লোগান তোলার মাধ্যমে এই দেশের বহুমাত্রিক সংস্কৃতি ধ্বংসের উদ্যোগ নিয়েছে বিজেপি। এই নিয়ে বিরোধীরা সরব হয়েছেন৷ কেন্দ্রের এই সব পদক্ষেপের সমালোচনা করে ‘ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন’-এর তকমা দিয়েছেন। কিন্তু কোনো কার্যকর পদক্ষেপ, দীর্ঘমেয়াদি গণআন্দোলন গড়ে ওঠেনি। ফলে সঠিক সুরাহাও হয়নি।
 
বিজেপি কর্তৃক শাসিত অধিকাংশ রাজ্যই কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। কিছু অ-বিজেপি রাজ্য ভিন্নসুর প্রকাশ করেছে। তবে, প্রতিটি ‘সংস্কারমূলক’ আইনের মতো এক্ষেত্রেও তারা হার মানতে বাধ্য। অন্তত বর্তমান পরিস্থিতি সে কথাই বলছে। খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার অবকাশ সত্যিই নেই।
 
আসলে জনগণের সম্মিলিত প্রতিবাদ বাদে এই ধরনের ফ্যাসিস্ট আক্রমণ রোখা অসম্ভব। উদাহরণ হিসাবে এই রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের কথা বলা যায়। ভোট রাজনীতিতে তারা বিজেপিকে পরাস্ত করেছে ঠিকই, কিন্তু বিজেপি সরকার কর্তৃক অনুসৃত সব রকম ফ্যাসিবাদী পদ্ধতি অবলম্বন করে বাংলায় বিরোধী স্বর স্তব্ধ করতে সচেষ্ট। বিধানসভা নির্বাচনের পর রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকখানি বদলেছে। রাজ্যের বড় অংশের মানুষের আস্থা হারিয়েছে তৃণমূল। ক্রমশ ‘বন্ধু’ কমছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বিজেপিকে পরাস্ত করতে যাঁরা তাঁকে সমর্থন (কেউ কেউ পরোক্ষে) করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই সরাসরি বিরোধিতা করছেন। সব মিলিয়ে রাজ্যে আবারও প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়ার আভাস টের পাওয়া যাচ্ছে। একদিকে সীমাহীন দুর্নীতি, অন্যদিকে রাজনৈতিক সন্ত্রাস- এসবের ফলে সৃষ্ট ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে সুযোগে বিজেপি সরকার কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলির হাতে রাজ্যের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তুলে দিতে সচেষ্ট। এজেন্সিগুলির তৎপরতাও নজর কাড়ার মতো।
 
বাংলা-সহ যে রাজ্যগুলি এখনও কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা পরিষদকে রাজ্যের পুলিশ/পুলিশবাহিনী সংক্রান্ত কোনো তথ্য,দেয়নি, সেই রাজ্যগুলিকে গত ২৪শে মে ‘রিমাইন্ডার-১’ পাঠানো হয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব কুন্দন কৃষ্ণণের পক্ষ থেকে। তিনি লিখেছেন, “আপনাদের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পাঠান। কারণ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের ডেপুটি ডিরেক্টর তা খতিয়ে দেখবেন।” সংবিধানের ২৪৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই ধরনের কাজকর্ম কেন্দ্র সরকার করতে পারে না। তাদের অধিকার নেই এমন করার। কারণ সপ্তম তফসিলির নিরিখে পুলিশবাহিনী-প্রশান ও আইনশৃঙ্খলা সম্পূর্ন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণেই। কিন্তু চেষ্টা চলছে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধ্বংস করার। গোটা বিষয়টাই কার্যত বিনা প্রতিবাদে ঘটছে। বিবৃতি দেওয়া ছাড়া আঞ্চলিক এবং বিরোধী দলগুলি কোনো কার্যকর প্রতিবাদ করছে না।
 
এই ক্রান্তিলগ্নে প্রয়োজন ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই। রাজ্য সরকারের উচিত ছিল নাগরিক সমাজ, গণআন্দোলনের কর্মীবৃন্দ, গণসংগঠনগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। কিন্তু বাস্তবে রাজ্য সরকার সমালোচকদের জেলবন্দি করতে,মিথ্যা মামলা দিতে ব্যস্ত। বৃহত্তর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ার চেয়ে রাজ্যের দুর্নীতি এবং স্বৈরাচারী শাসন রক্ষার্থেই সমস্ত সময় ব্যয়িত হচ্ছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর সংকটের কালো মেঘ ক্রমশ জমাট বাঁধছে। তীব্র হচ্ছে কেন্দ্রীয় আগ্রাসন। ‘এক রাষ্ট্র, এক পুলিশ বাহিনী’ আদতে সেই আগ্রাসনের এক জরুরি হাতিয়ার।
 
লেখক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
 
মতামত ব্যক্তিগত।
 

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.