পশ্চিমবঙ্গের দুই আসনে উপনির্বাচনের ফল প্রকাশ হওয়ার পর ভারতীয় জনতা পার্টি বাদে আর কাউকেই তেমন বিষণ্ণ বা অভিযোগমুখর হতে দেখা যাচ্ছে না। তৃণমূল নেতৃত্ব দৃশ্যত খুশি। রাজ্যের আরও একটি লোকসভা আসন তাঁদের দখলে এল। বস্তুত, এই প্রথম আসানসোল লোকসভায় জিততে পারলেন কোনো তৃণমূল প্রার্থী। তাও আবার তিন লক্ষাধিক ভোটে। বালিগঞ্জ বিধানসভায় তৃণমূলের ভোট এবং ভোট শতাংশ কমেছে অনেকখানি। কিন্তু কুড়ি হাজার ভোটের বড়সড় ব্যবধানেই জয় পেয়েছেন বাবুল সুপ্রিয়।
বামপন্থীরাও খুশি, তবে তাঁরা মূলত বালিগঞ্জ নিয়েই কথা বলছেন। চিরকালের বামবিরোধী কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত বালিগঞ্জে সিপিএমের ফল সত্যিই নজরকাড়া। বছরখানেক আগের বিধানসভা নির্বাচনে এই আসনে সিপিএম পেয়েছিল সাড়ে পাঁচ শতাংশের কিছু বেশি ভোট। এবার তা প্রায় ছ গুণ বেড়েছে। শুধু তাই নয়, বালিগঞ্জ বিধানসভার অর্ন্তগত সবকটা ওয়ার্ডেই সদ্যসমাপ্ত পুরভোটে জিতেছিল তৃণমূল। এবার দুটো ওয়ার্ডে বাবুল সুপ্রিয়র চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন বামপ্রার্থী সায়রা শাহ হালিম। তার মধ্যে একটা ওয়ার্ডে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বাড়ি। ঘটনাচক্রে, ওই ওয়ার্ডেই থাকতেন রিজওয়ানুর রহমানও।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
উপনির্বাচনের ফলাফলে রীতিমত খুশি নাগরিক সমাজও। যাঁরা বালিগঞ্জে ‘নো ভোট টু বাবুল’ প্রচার করেছিলেন, তাঁরা তৃণমূলের ভোট কমে যাওয়াকে তাঁদের সাফল্য হিসাবে প্রচার করছেন। সিপিআইএমএল লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদকও টুইট বার্তায় বালিগঞ্জ আসনে বাম প্রার্থীর ফলাফলে সন্তোষ ব্যক্ত করেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হল, আদৌ কি উপনির্বাচন নিয়ে বিজেপিবিরোধী সব মহলের এতখানি আত্মতৃপ্ত হওয়ার অবকাশ রয়েছে? সে কথায় যাওয়ার আগে চট করে শুকনো কিছু পরিসংখ্যানে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
প্রথমেই আসা যাক বালিগঞ্জের কথায়। তৃণমূলের ভোটে যে অনেকখানি ধ্বস নেমেছে তা স্পষ্ট। বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের হেভিওয়েট প্রার্থী প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায় পেয়েছিলেন ১,০৬,৫৮৫ ভোট, অর্থাৎ ৭০ শতাংশ। ২০২২ সালের পুরভোটে খোদ সুব্রতবাবুর ওয়ার্ডেই তাঁর বোন তৃণমূল প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্দল হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সেই কাঁটা সামলেও ভোট বাড়ায় শাসক দল। পৌর নির্বাচনে বালিগঞ্জের সব ওয়ার্ড মিলিয়ে তৃণমূল পেয়েছিল ১,১৫,২৬৮ ভোট। এবার সেই ভোট বিপুল পরিমাণে কমল। সাকুল্যে ৫০,৯৯৬ ভোট পেলেন বাবুল সুপ্রিয়।
২০২১ সালের নির্বাচনে বালিগঞ্জ আসনে তৃণমূলের সঙ্গে সংযুক্ত মোর্চার ব্যবধান ছিল ৯৮,১১১ ভোটের। এবার তা কমে হল ১৯,৯০৪। তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী বাবুল পেলেন ৪৮.৬৪ শতাংশ ভোট। সিপিএমের ভোট ৫.৬ শতাংশ থেকে এক লাফে বেড়ে হল ৩১.৯৯ শতাংশ। বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে বামেরা পেয়েছিলেন ৮,৪৭৪ ভোট। ২০২১ পুরভোটে সব ওয়ার্ড মিলিয়ে বামেদের ভোট ছিল ১১,২৪২। উপনির্বাচনে অনেকখানি কম ভোট পড়া সত্ত্বেও তা বেড়ে হল ৩০,৯৭১।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে, বিজেপির ভোট বিধানসভার থেকে অনেকখানি কমে গিয়েছিল কর্পোরেশন নির্বাচনে। তা কিছুটা বেড়েছে। বিজেপি প্রার্থী ২০২১ সালের বিধানসভায় পেয়েছিলেন ৩১,০৫৪ ভোট। পুরসভায় সব ওয়ার্ড মিলিয়ে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ১০,১৫৭। এবার বিজেপি প্রার্থী কেয়া ঘোষ পেয়েছেন ১৩,১৭৪ ভোট।
উল্লেখ্য, কর্পোরেশনের ফলাফলের নিরিখে বালিগঞ্জ বিধানসভায় দ্বিতীয় স্থানে ছিল কংগ্রেস। তাদের প্রাপ্ত ভোট ছিল ১১,৬২০। বামেরা তৃতীয় এবং বিজেপি চতুর্থ স্থানে ছিল। এবারে কংগ্রেসের ফলাফল শোচনীয়। তারা পেয়েছে ৫,২০৫ ভোট। কংগ্রেসের একাংশ সিপিএম প্রার্থীর বিরুদ্ধে খোলাখুলি সাম্প্রদায়িক, নারীবিদ্বেষী প্রচার করেছিলেন। সায়রার পোশাক নিয়েও কটাক্ষ করা হয়েছে। ভোটের ফলে প্রমাণিত, নির্বাচকমণ্ডলী, বিশেষত সংখ্যালঘুপ্রধান ওয়ার্ডগুলোর ভোটাররা এই ধরনের কুৎসা ভালভাবে নেননি।
বালিগঞ্জ কেন্দ্রে নজরে ছিল তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও। যে দুটো ওয়ার্ডে সিপিএম এগিয়ে রয়েছে, সেই দুটোতেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে টলমল তৃণমূলের সংগঠন। উপনির্বাচনের প্রচারে ৬৪ ও ৬৫ নম্বর ওয়ার্ডে দলের দুই গোষ্ঠীর লড়াই প্রকাশ্যে এসে পড়ায় তীব্র অস্বস্তিতে পড়েছিল তৃণমূল নেতৃত্ব। ৬৫ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূলের কর্মীসভা চলাকালীন দুই গোষ্ঠীর মারামারিতে জখম হন প্রাক্তন মেয়র পারিষদ তথা কাউন্সিলরের স্বামী সুশীল শর্মা। বর্তমান কাউন্সিলর নিবেদিতা শর্মার সঙ্গে প্রাক্তন কাউন্সিলর মাখনলাল দাসের গোষ্ঠীর লড়াই তুঙ্গে। সেই বিরোধ থামাতে নিজের বাড়িতে বৈঠক ডাকেন স্বয়ং মেয়র ফিরহাদ হাকিম। তবে তাতে কাজের কাজ হয়নি।
অন্যদিকে ৬৪ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের ব্লক সভাপতি বিজলী রহমানের সঙ্গে কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে এসে ফের কাউন্সিলর হওয়া শাম্মী জাহানের এলাকা দখলের লড়াই চলছে। রয়েছে সিন্ডিকেট নিয়ে বিস্তর অভিযোগ। এই ওয়ার্ডেও দুই গোষ্ঠীর লড়াই থামাতে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন দেবাশিস কুমার ও বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু সংঘর্ষ থামলেও তার প্রভাব যে ইভিএমে পড়েছে তার স্পষ্ট প্রমাণ এই দুই ওয়ার্ডে বামেদের কাছে জোড়াফুলের হার। সাড়ে তিন মাস আগে পৌরনির্বাচনে যে ৬৪ নম্বর ওয়ার্ডে ১৮,৪০২ ভোটে জিতেছিলেন তৃণমূলের শাম্মী, সেখানেই বাবুল ২২৪ ভোটে হেরে গেলেন। অন্যদিকে ৬৫ নম্বরে নিবেদিতা শর্মা ২২,৬৩০ ভোটের ব্যবধানে জিতলেও এবার বাবুল হারলেন ৯১৮ ভোটে। একদিকে প্রার্থী না-পসন্দ অধিকাংশ সংখ্যালঘু ভোটারের, তার উপর মাটি কামড়ে সায়রার প্রচার, সর্বোপরি তীব্র গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দুটো ওয়ার্ডে দাম দিতে হল তৃণমূলকে।
আসানসোলে বিরাট ব্যবধানে জিতেছে তৃণমূল। ২০১৪ সালে ৭০,০০০ এবং ২০১৯ সালে ১,৯৭,০০০ হাজার ভোটে জিতেছিলেন বিজেপির বাবুল সুপ্রিয়। এবার শত্রুঘ্ন সিনহা জিতেছেন তিন লক্ষাধিক ভোটে। তৃণমূল পেয়েছে ৬,৬৩,০০০-এর কিছু বেশি ভোট। বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ৩,৫৪,০০০। সিপিএমের পার্থ মুখোপাধ্যায় পেয়েছেন ৯০,৪১২। তৃণমূলের ৫৬.৬২ শতাংশ এবং বিজেপির ৩০.৪৬ শতাংশের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে ৭.৮ শতাংশ ভোট পাওয়া সিপিএম। তবে ২০১৯ সালের তুলনায় বামেদের ভোট সামান্য বেড়েছে।
অবাঙালি অধ্যুষিত আসানসোলে তৃণমূলের ফলাফল রীতিমত নজরকাড়া। একুশের নির্বাচনে সাতটা বিধানসভা মিলিয়ে আসানসোলে মোট ৫৪,৮১১ ভোটে এগিয়ে ছিল তৃণমূল। এই উপনির্বাচনে তা বেড়ে হল ৩,০৩,২০৯। গত বিধানসভায় আসানসোলের পাণ্ডবেশ্বর, রানিগঞ্জ, জামুড়িয়া, আসানসোল উত্তর, বারাবনি — এই পাঁচ বিধানসভা আসনে জিতেছিল তৃণমূল। আসানসোল দক্ষিণ এবং কুলটিতে জয় পেয়েছিল বিজেপি। আসানসোল দক্ষিণ থেকে জিতেছিলেন এই উপনির্বাচনের বিজেপি প্রার্থী অগ্নিমিত্রা পালই। এ বার সেই আসনেও পিছিয়ে বিজেপি। পাশাপাশি পাণ্ডবেশ্বরে তৃণমূলের ভোট ব্যবধান বেড়ে প্রায় এক লক্ষের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। ব্যবধান পঞ্চাশ হাজার ছাড়িয়েছে জামুড়িয়ায়। আসানসোল উত্তরেও তিরিশ হাজারের বেশি ব্যবধানে জিতেছে তৃণমূল। এ ছাড়া বারাবনিতে তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান বেড়ে হয়েছে ৭১,৭০৬। সব মিলিয়ে আসানসোলের ফল তৃপ্তি দিতেই পারে জোড়াফুল শিবিরকে। বামেদের জন্য খারাপ খবর, একদা দুর্গ হিসাবে পরিচিত এই শিল্পাঞ্চল, যেখানে শ্রমিকদের ভোট নির্ণায়ক ভূমিকা নেয়, সেখানে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো লক্ষণ নেই।
যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এই লেখার অবতারণা, এবার তাতে ফেরা যাক। আদৌ কি এই ফলাফল বিজেপিবিরোধী শক্তিগুলোর জন্য আশাব্যঞ্জক? সংখ্যাতাত্ত্বিক আলোচনা সরিয়ে রাখলে বলতে হয়, একেবারেই না। তৃণমূল কংগ্রেস প্রমাণ করে দিল, বালিগঞ্জের মতো ৪৮ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটারের কেন্দ্রে তারা বাবুল সুপ্রিয়র মত একজন মার্কামারা সাম্প্রদায়িক প্রার্থীকেও কুড়ি হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতিয়ে আনতে পারে। বাম ভোট যতই বাড়ুক, আসানসোলের সাম্প্রদায়িক হিংসার পর দাঙ্গাবাজিতে অভিযুক্ত বাবুলকে তেমন কড়া লড়াইয়ের মুখে পড়তে হল না। ষোল শতাংশেরও বেশি ভোটে তিনি জিতলেন। আসানসোলেও জিতলেন একদা রামমন্দির আন্দোলনের প্রথম সারিতে থাকা শত্রুঘ্ন। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বিরোধিতা আর সংঘ পরিবারের রাজনীতির বিরোধিতা যে এক নয়, তৃণমূল তা বারবার হাতেকলমে প্রমাণ করে দিয়েছে। সংঘ পরিবার থেকে আসা দুজনকে ভোটে জিতিয়ে তারা আরও একবার দেখাল, বঙ্গে আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে পরাস্ত করার কাজটা এখনো আগের মতই কঠিন। বিজেপি তো বটেই, এই কাজে অন্যতম প্রধান বাধা শক্তিশালী তৃণমূল কংগ্রেস।
মতামত ব্যক্তিগত
আরো পড়ুন
মিছিল থেকে গ্রেপ্তার: যোগীর রাজ্য হতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ?
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।