রত্নাবলী রায়

আমাদের রাজ্যটাও কি যোগীর রাজ্যে পরিণত হতে চলেছে? শুক্রবারের অভিজ্ঞতার পর আমার তো তেমনই আশঙ্কা হচ্ছে। একজন সমাজকর্মী হিসাবে আমি অত্যন্ত হতাশ, ক্ষুব্ধ এবং বিষণ্ণ। খোদ কলকাতার বুকে এমন ঘটনা যে ঘটবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি।

বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েছেন বাবুল সুপ্রিয়। আমরা অনেকেই নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে তাঁর বিরোধিতা করছি। আমরা স্পষ্টভাবেই বলছি, এই ব্যক্তিকে প্রার্থী করে তৃণমূল কংগ্রেস দল পশ্চিমবঙ্গের অসাম্প্রদায়িক জনগণের প্রতি নিতান্তই অবিচার করেছে। বাবুল সুপ্রিয় বিজেপি দলের সাংসদ ছিলেন। গত বিধানসভা নির্বাচনেও তিনি টালিগঞ্জ আসনে বিজেপির টিকিটে লড়ে পরাজিত হয়েছিলেন। আমরা দেখেছি, বিজেপিতে থাকাকালীন বাবুল সুপ্রিয় দিনের পর দিন সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়িয়েছেন। অন্য ধর্মের মানুষের “চামড়া গুটিয়ে” নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও প্রকাশ্যে সংখ্যালঘুদের পাকিস্তান বা বাংলাদেশে পাঠানোর কথা বলেছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ছাত্রীদের প্রতি অবমাননাকর আচরণ করেছেন। প্রবীণ বাচিকশিল্পীকে “যৌনদাসী” বলেছেন। প্রতিবন্ধীদের কর্মসূচিতে গিয়ে একজন প্রতিবন্ধী মানুষকে মেরে পা ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। এককথায় বলতে গেলে যত রকমভাবে বিষ ছড়ানো যায়, সবই তিনি করেছেন।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

আমরা গভীর বিস্ময় ও যন্ত্রণার সঙ্গে দেখলাম, এহেন বাবুল সুপ্রিয় দল বদল করে তৃণমূল কংগ্রেস দলে যোগ দিলেন এবং বালিগঞ্জের টিকিট পেলেন।

গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গে একটি স্লোগান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল — নো ভোট টু বিজেপি, অর্থাৎ বিজেপিকে একটিও ভোট নয়। ক্রমশ তা একটি গণআন্দোলনের চেহারা নেয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজমুখে এই আন্দোলনকে ধন্যবাদ জানান। বালিগঞ্জ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস তাদের প্রার্থী হিসাবে বাবুল সুপ্রিয়র নাম ঘোষণা করার পর আমরা অনেকে মিলে ঠিক করি প্রতিবাদ করতেই হবে। আমাদের মধ্যে অনেকে এনআরসি, সিএএ, এনপিআর বিরোধী আন্দোলনের কর্মী। অনেকে প্রতিবন্ধীদের অধিকার আন্দোলন নিয়ে কাজ করেন, অনেকে নারী আন্দোলন বা অন্য গণতান্ত্রিক সংগঠনের সদস্য। আমরা একটি কেন্দ্রীয় স্লোগানের ভিত্তিতে পথে নামার পরিকল্পনা করি। ‘নো ভোট টু বাবুল-বিজেপি’— এই ছিল আমাদের স্লোগান। বিকেল চারটেয় পার্ক সার্কাসের আরসালান রেস্তোরাঁর সামনে থেকে নাগরিক মিছিল শুরুর কথা ছিল। পুলিশ কর্তৃপক্ষকে মেল করে কর্মসূচির কথা জানানো হয়েছিল। কোনোরকম রাস্তা অবরোধ বা বিক্ষোভের পরিকল্পনা ছিল না, একেবারেই শান্তিপূর্ণ নাগরিক মিছিল।

আমি যখন আরসালানের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছি প্রায়, তখনই ফোনে খবর এল পুলিশ নির্বিচারে ধরপাকড় শুরু করেছে। বিশিষ্ট সমাজকর্মী প্রসেনজিৎ বসু এবং আরও কয়েকজন সেভেন পয়েন্টসে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছে। তখনো পর্যন্ত মিছিল শুরুই হয়নি, কোনো স্লোগান পর্যন্ত দেননি কেউ। অথচ পুলিশ প্রসেনজিৎদের আটক করে লালবাজার নিয়ে গেল। খবর পাচ্ছিলাম, ওই চত্বর জুড়ে নজরদারি চলছে। মিছিলে যোগ দিতে কেউ আসছেন মনে হলেই তুলে নিচ্ছে পুলিশ।

আমরা কোয়েস্ট মলের সামনে নামলাম। নামতেই দেখি সেখানেও একাধিক পুলিশের গাড়ি এবং ভ্যান। গণআন্দোলনের কর্মী সুমন সেনগুপ্তও সেখানে ছিলেন। পুলিশ আমাদেরও চার্জ করতে শুরু করে, মিছিল করতে এসেছি কিনা জানতে চায়। এলাকা খালি করে দিতে বলে। আমি, সুমন এবং অন্যরা গ্রেফতারি এড়াতে কোয়েস্ট মলের ভিতরে ঢুকে যাই। ইতিমধ্যে খবর আসে, প্রসেনজিৎরা ছাড়াও আরও ২০ জনকে আটক করেছে পুলিশ, সবমিলিয়ে মোট ২৬ জনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একটা শান্তিপূর্ণ নাগরিক মিছিল রুখতে এ কেমন বীভৎস আগ্রাসী আচরণ! বলে রাখা ভাল, তিনজন মহিলা স্রেফ বাজার করতে এসেছিলেন। তাঁদেরও আন্দোলনকারী ভেবে আটক করা হয়।

এর মধ্যেই মিছিলে অংশ নিতে দু গাড়ি ভর্তি প্রতিবন্ধী মানুষজন আসেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের ঘিরে ফেলে পুলিশ। বলা হয়, এক মিনিট এখানে থাকলে আটক করা হবে। এরপর তাঁদের গাড়িগুলিকে কার্যত কর্ডন করে বের করে দেওয়া হয়। আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধু, প্রবীণ অধ্যাপক অমিত দাশগুপ্ত ফুটপাথ ধরে হাঁটছিলেন। তাঁকে পুলিশকর্মীরা এসে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি কোথায় যাবেন। অমিত জানান, ঠিক এই মুহূর্তে তিনি কোথায় যাবেন তা এখনো ঠিক করেননি। এরপর পুলিশ তাঁকে লালবাজারে নিয়ে চলে যায়।

আমরা বেশ কিছুক্ষণ কোয়েস্ট মলেই আটকে থাকি। বাইরে পুলিশের দাপাদাপি। এরপর মলের পিছনের গেট দিয়ে বেরোই। ততক্ষণে সেখানে একদল সংখ্যালঘু মানুষ জড়ো হয়েছেন। তাঁরা সকলেই এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। তাঁদের সাহায্যে আমরা বাড়ি ফিরে আসি।

পশ্চিমবঙ্গেও কি উত্তরপ্রদেশের মতো পুলিসরাজ চলছে? একজন প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে পথে নামা যাবে না? এ কেমন গণতন্ত্র? শাসক দল বা বাবুল সুপ্রিয় কি মানুষকে ভয় পাচ্ছেন? তাহলে আর এত টাকাপয়সা খরচ করে নির্বাচনের নামে প্রহসনের কী প্রয়োজন? সরাসরি বাবুল সুপ্রিয়কে জয়ী ঘোষণা করে দেওয়া হোক!

আমি অত্যন্ত ব্যথিত, হতাশ এবং উদ্বিগ্ন। যেভাবে সরকার বিরোধীদের গলা টিপে ধরছে, তা ভয়াবহ। এর পরিণতি ভাল হতে পারে না। এক অস্বাভাবিক, দম বন্ধ করা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। নাগরিক সমাজকে যদি এভাবে দমন করা হয়, তাহলে সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হবে। পঞ্চায়েত এবং পৌর নির্বাচনে আমরা দেখেছি ভোটের নামে প্রহসন। এখন দেখছি নাগরিক সমাজের পথে নামার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা। এই অন্ধকার পথ থেকে শাসক সরে আসুন। নাহলে এর পরিণতি তাঁর জন্যও ভাল হবে না।

লেখিকা সুপরিচিত সমাজকর্মী। মানসিক স্বাস্থ্য এবং প্রতিবন্ধী অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনরত। একাধিক পুরস্কারে সম্মানিত। মতামত ব্যক্তিগত, তথ্যের দায় নিবন্ধকারের

আরো পড়ুন

আরএসএসের পছন্দসই অগভীর বিরোধিতার মুখ শত্রুঘ্ন, বাবুল

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.