মার্চ ২০২২, অতিমারীর দীর্ঘ প্রকোপ কাটিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ছন্দে ফেরার চেষ্টা করছে। আমরা জানি এই সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সরকারি ও সরকারপোষিত স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের, কারণ সহজেই অনুমেয়। মূলত গ্রাম ও মফস্বলের ছেলেমেয়েরাই বিগত বেশ কিছু বছর ধরে এই স্কুলগুলোর ছাত্রছাত্রী। অতিমারী সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছে এই অংশের অর্থনীতিতে ও সমাজজীবনে। হাজার হাজার মানুষ কাজ হারিয়েছেন, সংসারের প্রয়োজনে ছেলেদের কাজে ঢোকানো হয়েছে, নাবালিকা মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এদের কাছে পৌছয়নি কোন অ্যাপনির্ভর শিক্ষা (যদিও অন্য অনেক শিক্ষকের মতই এই লেখকেরও দৃঢ় বিশ্বাস যে স্কুল স্তরে অ্যাপনির্ভর শিক্ষা অর্থহীন)। সরকারের তরফ থেকে এই ক্ষতি পূরণ করার কোন সদর্থক প্রচেষ্টা চোখে পড়েনি।

কিন্তু এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের স্কুলশিক্ষা অন্য কারণে তীব্র সমালোচনার কেন্দ্রে। প্রথম কারণটা হল শিক্ষক নিয়োগে চূড়ান্ত দুর্নীতি আর দ্বিতীয়টা, সব স্কুলে এক ইউনিফর্ম চালু করার সরকারি ঘোষণা। প্রথমটা এই লেখকের উপজীব্য নয়। এই আলোচনা শুধু ইউনিফর্ম নিয়ে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

সরকারি স্কুলশিক্ষা ব্যবস্থার সাথে সমাজের যেসব মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত তাঁরা জানেন, গত মাসের একেবারে গোড়ার দিকে পশ্চিমবঙ্গ সমগ্র শিক্ষা মিশনের তরফে একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়, চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে রাজ্যের সমস্ত স্কুলে প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সমস্ত ছাত্রছাত্রীর পোশাকের রং হবে নীল সাদা। প্রত্যেক ছাত্র পাবে একটি করে সাদা হাফ ও ফুল শার্ট এবং একটি করে নীল হাফ ও ফুল প্যান্ট। প্রাথমিকের ছাত্রীরা পাবে দুটি সাদা জামা ও নীল ফ্রক এবং ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ছাত্রীরা পাবে দুটি করে সাদা কামিজ ও নীল সালোয়ার। সর্বোপরি প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর জামায় থাকবে বিশ্ব বাংলার লোগো।

স্বাভাবিকভাবেই এই সিদ্ধান্ত ঘোষিত হবার পর বিভিন্ন মহলে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। সরব হয়েছেন শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী থেকে শুরু করে প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকরাও। প্রত্যেকের বক্তব্য মোটামুটি একই, ইউনিফর্ম যে কোনো স্কুলের ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ওটা যেমন স্কুলের স্বাতন্ত্র্যের পরিচায়ক, তেমনই ছাত্রছাত্রীদের স্বকীয়তারও লক্ষণ। এর সাধারণীকরণ মেনে নেওয়া যায় না। সবচেয়ে বড় আপত্তির জায়গা হল প্রস্তাবিত লোগো। বিভিন্ন স্কুলের জামায় স্কুলের নিজস্ব লোগো থাকে, সেটাও ছাত্রছাত্রীদের স্বাতন্ত্র্য প্রদান করে থাকে।

উপর্যুক্ত আপত্তিগুলো ছাড়াও অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলী অন্য একটা বাস্তব সমস্যার দিকে আঙুল তুলেছেন। সেটা হল শিশুসুলভ চাপল্যে এক স্কুলের ছাত্র বা ছাত্রী যদি অন্য স্কুলে চলে যায়, তবে তাকে খুঁজে বের করা অসম্ভব হবে। আপাতদৃষ্টিতে সামান্য মনে হলেও সমস্যাটা গুরুতর হয়ে উঠতে পারে।

এ প্রসঙ্গে সরকারের বক্তব্য কী?

মাননীয় পাঠক, একটু নিজের স্মৃতির উপর চাপ দিন। ২০১৩ সাল নাগাদ তৃণমূল সরকার কলকাতায় এক অদ্ভুত নির্দেশ জারি করে। বাড়ির রং নীল সাদা করা হলে পৌর কর মকুব হবে। আর্থিক টানাটানির রাজ্যে এই নির্দেশ অদ্ভুত এবং একই সঙ্গে হাস্যকর মনে হয়েছিল। কলকাতাবাসীকে ধন্যবাদ, তাঁরা কর বাঁচানোর টানে দলে দলে এই নিয়ম মেনে নেননি। প্রাথমিকভাবে বালখিল্য মনে হলেও কিছুদিন পরে নির্দেশের পরিধি আরও বাড়ানো হ্য়, যা থেকে এর আসল উদ্দেশ্য অনেকটা মালুম হয়। সেটা হল শহরের সমস্ত রাস্তা, রেলিং, সরকারি অফিস, সরকারি স্কুল নীল সাদা রং করতে হবে। কাজটাও খুব দ্রুত হয়ে যায়। নিন্দুকেরা বললেন, এত নীল সাদা রঙের মূল পরিবেশক নাকি কালিঘাট অঞ্চলে রাতারাতি গজিয়ে ওঠা একটা কোম্পানি। বিরোধীদের সমালোচনার জবাবে মুখ্যমন্ত্রীর অনুগতরা বলেছিলেন, এই দুটো রং কোনো রাজনৈতিক দলের নয়, তাই সমালোচনার কিছু নেই।

মনে করে দেখুন, প্রিয় পাঠক, বঙ্গ মিডিয়া মুখ্যমন্ত্রীর যে পোশাকের বর্ণনা দিতে গত ১২-১৪ বছরে ক্লান্ত হয়নি। তাঁর নীল পাড়, সাদা শাড়ি এবং নীল সাদা হাওয়াই চটির উল্লেখ কয়েক লক্ষবার হয়েছে। অত্যন্ত সচেতনভাবে একটা অভিজ্ঞান তৈরি করা হয়েছে, এখন সেই ছাঁচে গোটা রাজ্যটাকে ঢালার পালা শুরু হয়েছে।

২০১৬ সালে সরকার স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পোশাক দেবার কথা ঘোষণা করে এবং স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে এই কাজ শুরু হয়। তবে সেই ইউনিফর্মের কাপড়ের মান নিয়ে তীব্র অসন্তোষ আছে ভুক্তভোগী অনেকের, এই লেখকেরও। তারপর ধাপে ধাপে লোগো সমন্বিত স্কুল ব্যাগ এবং প্রাথমিকের ছাত্রছাত্রীদের জুতো দেওয়াও শুরু হয়। কিছু সমালোচনা থাকলেও সরকারের এই উদ্যোগ প্রচুর মানুষের সমর্থন পেয়েছে। এটাকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর একেবারেই মৌলিক ভাবনা বলে প্রচার করা হলেও শাসকবন্ধু মিডিয়ার দাপটে বাংলার মানুষ ভুলে গেছেন, এই সরকার আসার আগেও সর্বশিক্ষা অভিযান প্রকল্পে ছাত্রছাত্রীদের পোশাকের জন্য কিছু টাকা দেওয়া হত প্রতি বছর, আর এই ধরনের প্রকল্প দেশের অন্য অনেক রাজ্যেও আগে থেকেই চালু আছে।

তবে সকলের জন্য একই পোশাকের ফরমান তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন বিজেপিশাসিত গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ এবং আসামে গোটা রাজ্যের সরকারি স্কুলে সকলের একই ইউনিফর্ম প্রচলিত আছে। যেহেতু সরকারি স্কুলে সবকিছুই সরকার দেয়, তাই সবার একই পোশাক পরায় ওঁরা সমস্যার কিছু দেখছেন না। মন্ত্রী যেসব রাজ্যের উদাহরণ দিয়েছেন সেখানকার শাসকের ওই ধরনের পদক্ষেপ স্বাভাবিক, কারণ নীতিগতভাবে তারা এ দেশের মূল সুর বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সম্পূর্ণ বিরোধী। তারা চায় বৈচিত্রহীন ঐক্য, ছকে বাঁধা সমাজ, প্রশ্নহীন আনুগত্য। কিন্তু বিজেপির ঘোষিত বিরোধী এ রাজ্যের শাসক দলের কর্মকাণ্ডও একই পথে এগোচ্ছে কেন?

দুটো নির্দিষ্ট রং, যা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা শাসক দলের সমার্থক হয়ে গেছে, সেগুলোকেই শিশুমনে অমোঘ বলে এঁকে দেওয়ার বন্দোবস্ত চলছে। শাসকের এই আধিপত্য বিস্তারের নেশায় আমরা যেন ভুলে না যাই, ২০১৯-২০ নাবালিকাদের মাতৃত্বে এ রাজ্য দেশের শীর্ষে, ২০২১-২২ সালে আবার নাবালিকা বিবাহে শীর্ষে। প্রচারের ঢক্কানিনাদ কিন্তু সারাক্ষণ আপনাকে জানাচ্ছে, কন্যাশ্রী প্রকল্প নাবালিকা বিবাহ রোধে সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে সফল প্রচেষ্টা এবং একটি ‘আন্তর্জাতিক সংস্থা’ দ্বারা একাধিকবার পুরস্কৃত।

সবশেষে বলি বিশ্ব বাংলা লোগোর কথা।

লোগো বা ব্যাজ হল একধরনের পরিচিতি বা প্রতীক। বিভিন্ন সংগঠন, দেশ বা ক্লাবের জন্য এর ব্যবহার বহুল প্রচলিত। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, সরকার নয়, মূলত বাঙালি জাতির আত্মমর্যাদা জাগিয়ে তুলতেই এই ব্যাজ। একটা জাতির আত্মমর্যাদা উসকে দিতে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ব্যাজ প্রচলনের ভাবনা অদ্ভুত হলেও নতুন নয় কিন্তু। অন্য এক দেশে বহু বছর আগেই এ জিনিস হয়েছিল। জার্মানিতে দশ থেকে চোদ্দ বছরের ছেলেদের জন্য নির্দিষ্ট চিহ্নবিশিষ্ট (নাজি প্রতীক) ব্যাজ লাগানো ইউনিফর্ম চালু করেছিলেন একদা টাইম ম্যাগাজিন ঘোষিত ‘পার্সন অব দ্য ইয়ার’ অ্যাডলফ হিটলার। এই ছেলেদের ‘হিটলার ইয়ুথ’ নামক সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত করা হত। ১৯৩৯ সালে জার্মানির সমস্ত ছাত্রের জন্য এই সংগঠনের সদস্যপদ বাধ্যতামূলক করা হয়। বাকিটা ইতিহাস।

লেখা শেষ করব একটা প্রচলিত প্রবাদ স্মরণ করে “ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা এই, যে আমরা ইতিহাস থেকে কিছুই শিখি না।”

লেখক পদার্থবিদ্যার শিক্ষক এবং শিক্ষক আন্দোলনের কর্মী

আরো পড়ুন

নীল-সাদা ইউনিফর্ম: অপ্রয়োজনীয় এবং সংঘ পরিবারসুলভ

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.