অরূপ ইদানীং রোজ ভোর চারটেয় ওঠে। মুখ ধুয়ে সাইকেল নিয়ে চলে যায় যাদবপুর স্টেশনে। কাগজ আসে পাঁচটা নাগাদ, প্রথম ট্রেনে। ট্রেন থেকে নামিয়ে দেয় অন্য দাদা, কাকারা। তারপর সেই কাগজ গোছানো, পরপর হিসেব করে একশোটা বিভিন্ন খবরের কাগজ সাইকেলের ক্যারিয়ারে বেঁধে নিয়ে স্টেশন থেকে বেরোতে বেরোতে প্রায় ছটা। এরপর বাড়িতে বাড়িতে কাগজ পৌঁছনো। উঁচু বাড়ির বারান্দায় দড়ি বেঁধে ছুঁড়ে ছুঁড়ে, কোনো কোনো বাড়িতে গেটের নীচ দিয়ে সব কাগজ দিতে দিতে প্রায় সাড়ে সাতটা। সেখান থেকে সোজা বাজার। বাজারে রতনকাকুর পাশে বসে মাছের আঁশ ছাড়ানো, পরিষ্কার করা। সব কাজ শেষ করতে করতে এগারোটা। এর মাঝে দুবার চা আর পাঁউরুটি।
সকালের এই দুটো কাজের জন্য মাস গেলে হাজার চারেক টাকা রোজগার হয় অরূপের। মাসের শেষে সবটাই তুলে দেয় মায়ের হাতে। ওর মা বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজ করেন। মাঝে কয়েক মাস মায়েরও কোনও কাজ ছিল না। ইদানীং আবার পুরনো কাজের বাড়ি থেকে ডেকে ওর মাকে ডেকেছে, ফলে অরূপদের পরিবার একটু আলোর সন্ধান পেয়েছে। অতিমারীর আগে অরূপ স্কুলে যেত, ক্লাস সিক্সের ছাত্র ছিল। সে দেখেছে পাড়ার বন্ধুরা কেউ কেউ আবার স্কুলে যাচ্ছে, কিন্তু ওর সে উপায় নেই। স্কুলে গেলে দুপুরের খাওয়ার চিন্তা ছিল না। অরূপের বাবা এক জায়গায় নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করতেন। ছ মাস মাইনে বন্ধ থাকার পরে কাজটাই চলে গেছে। বাবা বলেছেন, আবার কেউ নাকি কাজের জন্য ডেকেছে। ফলে অরূপও আশায় আছে, আবার স্কুলে যাবে। কিন্তু ভয়ও করছে। যদি স্কুলে গিয়ে কিছু না পারে, তাহলে কি দিদিমণিরা বকবেন? যদিও কাগজ দেয় বাড়ি বাড়ি, তবু ইদানীং আর কাগজের কোনো লেখা ঝটপট পড়তে পারছে না অরূপ। তাহলে কি স্কুল থেকে বার করে দেবে? এই ভয়টাই এখন অরূপের নিত্যসঙ্গী।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
অনেক শব্দের মাঝে অনেক নৈঃশব্দ্য ঢেকে যায়। অরূপদের কথা বা ভয়, সেই নৈঃশব্দ্য, যা শোনা এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। কোভিডের পর সবে সবে স্কুল খুলেছে। কত ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনা বন্ধ হল, তা নিয়ে আলোচনা ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসছে। নতুন করে কত বেশি ছাত্রছাত্রী মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে, তা নিয়ে শোরগোলের ফাঁকে বেশ কিছু কথা হারিয়ে যাচ্ছে। করোনাকালে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ অবশ্যই স্মার্টফোনের অভাব, কিন্তু সেটাই একমাত্র সমস্যা নয়। যে ছাত্রছাত্রীরা আবার স্কুলে ফিরে যাচ্ছে বা গেছে, তাদের সমস্যা অন্যরকম। গত দু বছরে পড়াশোনা থেকে তারা এত দূরে চলে গেছে, যে তাদের আবার পড়াশোনার মূল স্রোতে ফেরানো শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। এমন বাচ্চাও হয়ত পাওয়া যাবে, যারা কোনোদিন স্কুলের মুখই দেখেনি। ছাত্রীদের অনেকের বিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু ছাত্রদের মধ্যেও পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা যথেষ্ট উদ্বেগের। অরূপদের মত অনেকেই সংসারের হাল ধরতে নানা ধরনের কাজে যুক্ত হয়েছে। অনেক ছাত্রছাত্রী হয়ত অনলাইনে পড়াশোনা করেছে, কিন্তু তাদের যতটা মানসিক এবং শিক্ষাগত ক্ষতি হয়েছে, তা কী করে পূরণ করা সম্ভব? শুধু তা-ই নয়, যারা অনলাইনে পড়েছে, তারাও জানে না ভবিষ্যতে অফলাইন এবং অনলাইন পড়াশোনার সম্পর্ক কী হতে চলেছে? সুতরাং যে অভিভাবকরা ভেবেছিলেন তাঁদের সন্তানরা এগিয়ে যাবে, এবার তাঁরাও সমস্যায় পড়ছেন।
কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এবারের বাজেটে ঘোষণা করা হয়েছে, ঘরে ঘরে টিভির মাধ্যমে পড়াশোনা হবে। কিন্তু সরকার কি জানে, সবার বাড়িতে সেই ব্যবস্থা আছে কিনা? যা করা উচিৎ ছিল, তা হল প্রথম বছরে পুরনো পড়া আবার ঝালিয়ে নেওয়া। সাধারণ অঙ্ক, পড়তে পারা বা লেখার মতো বিষয়গুলোতে জোর দেওয়া, যাতে একটু বয়সে বড় ছাত্রছাত্রীদের একবারও মনে না হয়, তারা স্কুলে ব্রাত্য। যারা পিছিয়ে আছে, তাদের আরও বেশি যত্ন এবং সময়ের প্রয়োজন। সিলেবাস শেষ করা বা কত ছাত্রছাত্রী ভর্তি হল, তাদের কতজনকে মিড ডে মিল দেওয়া হচ্ছে — এই সব হিসাব নিকাশ পরেও করা যাবে। সরকারি স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকাদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। স্কুলশিক্ষা দপ্তরকে ভাবতে হবে কীভাবে শুধু সিলেবাস শেষ করানোর কাজ না করে শিক্ষকরা পড়াশোনার গুণগত মানের দিকে নজর দিতে পারেন। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিজের নিজের স্কুলে আরও বেশি স্বাধীনতা দেওয়ার ব্যবস্থা করার ব্যাপারে কি স্কুলশিক্ষা দপ্তর আগ্রহী?
আমাদের রাজ্যে সেক্ষেত্রেও একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশের বা রাজ্যের উন্নয়ন পুরোটাই শহরকেন্দ্রিক, তাই মানুষজন চেষ্টা করেন শহরের কাছাকাছি থাকতে, উন্নয়নের ছোঁয়া পেতে। শিক্ষা দপ্তরের উৎসশ্রী প্রকল্পের দৌলতে এই মুহূর্তে গ্রাম কিংবা মফস্বলের স্কুলগুলো শিক্ষকের অভাবে ভুগছে, কারণ বেশিরভাগ স্কুল থেকে শিক্ষক-শিক্ষিকারা বদলি নিয়েছেন। ফলে গ্রামের দিকের স্কুলগুলোতে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ভীষণভাবে বিগড়ে গেছে। শিক্ষিকাদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা সত্যিই গভীর, তাঁদের যাতায়াতের সময় না কমানো গেলে তাঁরা স্কুলে কী করে সময় দেবেন? দরকারে শিক্ষিকারা কাছাকাছি বদলি হয়েছেন, সেখানে সপ্তাহে একদিন করে হলেও পুরনো পড়াশোনা মনে করানোর জন্য বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করা জরুরি।
সুতরাং স্কুলশিক্ষা দপ্তরকে এই মুহূর্তে যে কাজ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে করতে হবে, তা হল স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ। কিন্তু গত দশ বছরে কোনো নিয়োগের ক্ষেত্রেই যে সরকার স্বচ্ছতা দেখাতে পারেনি, কী করে বিশ্বাস করা যায় সেই সরকার স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে ইচ্ছুক? ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা কোনো ব্যক্তিগত কাজ নয়, যৌথ উদ্যোগ। তা যদি না হয়, তাহলে অরূপদের মত ছাত্ররা কী করে ভয় কাটাবে?
পাশাপাশি সরকারি স্কুলগুলোকে কী করে আরও বেশী আধুনিক করা যায়, যাতে মধ্যবিত্ত মানুষজন তাঁদের সন্তানদের সেই স্কুলে ভর্তি করেন, সেদিকেও নজর দিতে হবে। কিছু রাজ্য কিন্তু এ বিষয়ে যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক কাজ করেছে। দরকারে আইন করে সরকারি কর্মচারীদের সন্তানদের সরকারি স্কুলে ভর্তি হওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। এই দু বছরে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা এবং মনোজগতের যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ করতে যদি দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা না নেওয়া হয়, অরূপদের মত আরও ছাত্র কিন্তু হারিয়ে যাবে।
যখন আরও বেশি শিক্ষক নিয়োগ করা উচিত ছিল, তখন সমস্ত স্কুলে নীল-সাদা ইউনিফর্ম এবং তাতে বিশ্ব বাংলার প্রতীক লাগানোর দিকে নজর দিচ্ছে সরকার। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নাকি বাংলা আবার জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে। ছাত্রছাত্রীরা কী ইউনিফর্ম পরে পড়াশোনা করতে যাবে, তাতে কী প্রতীক থাকবে, এ সবেও এবার সরকার নাক গলাবে? সরকারের কি আর কোনো কাজ নেই? ইউনিফর্ম নির্ধারণের অধিকার কেবলমাত্র স্কুলের থাকা উচিত। কী রংয়ের জামা পরা হবে, স্কুলে কোন রুটিনে ক্লাস হবে, কোথায় বসা হবে, এগুলো যুগে যুগে স্কুলই ঠিক করে এসেছে। এসব ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ মানে স্কুলের স্বাতন্ত্র্য, স্বাধিকারে আঘাত।
আজ কর্ণাটকে হিজাব নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, তাতেও অন্যতম আপত্তির জায়গা হল, একজন ছাত্র কী পরবে আর কী পড়বে তা সরকারের ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন ইউনিফর্মটা রাজনৈতিক বিষয় নয়। কিন্তু এটা আদ্যন্ত রাজনৈতিক। একজন শিক্ষার্থীকে যদি সরকারের ইচ্ছানুযায়ীই পোষাক পরতে হয়, আগামীদিনে যে আমাদের রাজ্যেও হিজাব সংক্রান্ত ফতোয়া আসবে না, তা কি নিশ্চিত করে বলা যায়? শিক্ষামন্ত্রী উদাহরণ দিচ্ছেন, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট বা আসামে ইউনিফর্মের ক্ষেত্রে এই নিয়ম চালু আছে। তাহলে কি মেনে নিতে হবে, এই রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা ওই বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোর অনুকরণেই চলবে? তা যদি না হয়, তাহলে যখন আরও বেশি করে পড়াশোনায় নজর দেওয়া প্রয়োজন, তখন সমস্ত স্কুলের ছাত্রছাত্রীকে নীল-সাদা পোষাক পরানো আসলে এক ধরনের সমসত্ত্বতা চাপিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত, যার সঙ্গে একমাত্র সংঘ পরিবারের পোষাক থেকে খাদ্যাভাস, সব এক করে দেওয়ার ভাবনার সাদৃশ্য আছে।
মতামত ব্যক্তিগত
আরো পড়ুন
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, কোভিডকাল এবং খুড়োর কল
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
[…] নীল-সাদা ইউনিফর্ম: অপ্রয়োজনীয় এবং সংঘ … […]