“তিন কোটি চাকরি আছে। ভালো করে খোঁজো”, অঞ্জনি বলছিল বান্ধবী কুমুদকে। তিন কোটি চাকরির মধ্যে অঞ্জনির জন্য কি একটাও নেই?
“ইংরেজি জানো?” প্রশ্ন করে কুমুদ।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
“ইংরেজিও শিখে নেব… প্রথমে বলবে হায়ার সেকেন্ডারির সার্টিফিকেট নিয়ে এসো। তারপর অফিসে গেলে হাতে ঝাঁটা ধরিয়ে দেবে”, উত্তর বিরক্ত অঞ্জনির। ঝাঁটা ধরতে অবশ্য আপত্তি নেই, প্রশ্নটা হল, সার্টিফিকেট কেন? কুমুদ বলে “ কাজ তো কাজই”।
অঞ্জনি মুখ ঝামটা দেয় “ আরে নেতার মতো কোরো না।” (আরে নেতা মত বনো ইয়ার)
দিল্লির এক সাইবার ক্যাফেতে কয়েক মিনিটের এই সংলাপ আমাদের সামনে সময়ের ছবি তুলে ধরে। মনে করিয়ে দেয় গত কয়েক বছরে দেখা খবরের কাগজের শিরোনামগুলো, যেখানে কম মাইনের চাকরির জন্যই দরখাস্ত করছেন উচ্চশিক্ষিত যুবক যুবতীরা। বলাই বাহুল্য, চাকরির আরও একটা বিকল্প হিসাবে নয়, তাঁরা এমন করছেন বাধ্য হয়ে। কারণ এসএসসি, পিএসসির মত পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ প্রায় বন্ধ। সরকারি অফিস থেকে স্কুল — সর্বত্র কয়েক লক্ষ শূন্য পদ, অথচ নিয়োগ নেই। যুবক যুবতীরা যেখানেই যাচ্ছেন, বলা হচ্ছে কাজ নেই। ঠিক এই ছবিটার মতই। ছবির নাম ইব আলে উউ। পরিচালক প্রতীক বৎস।
আসলে চাকরি গিয়েছে অঞ্জনির। অঞ্জনির দিদি শশীর ভাষায় “সরকারি চাকরি”। গ্রাম থেকে কাজের খোঁজে শহরে আসা অঞ্জনির চাকরি ছিল দিল্লির গুরুত্বপূর্ণ এলাকা থেকে বাঁদর তাড়ানোর। ঠিকাদারের অধীনে কাজ। ছবিতে আগেই জানানো হয়েছে, রাজধানী দিল্লিতে বাঁদরের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। তাই বাঁদর তাড়াতে লোক ভাড়া করেছে সরকার। আজকের ভারতবর্ষে বাঁদর অবশ্যই একটি রাজনৈতিক প্রাণী। কিন্তু সেই প্রসঙ্গে অন্য কখনো যাওয়া যাবে। বাঁদর তাড়ানোর চাকরি নিয়েই যাবতীয় লড়াই অঞ্জনির। লড়াই দিল্লি লাগোয়া বস্তিতে থাকা এক প্রবাসী যুবকের।
তবে ছবি তৈরির বেশ কয়েক বছর পরে এরকম চাকরির কদর যে বাড়বে, এটা হয়ত পরিচালক জানতেন না।
ছবিটা দেখতে দেখতে মনে পড়ে যায় রোহিত কুমারের কথা। রোহিতের কথা ভেবেই নাম পরিবর্তন করা। রোহিত একজন ‘রাইডার’। ওলা অ্যাপের অধীনে বাইক চালান। বাইকে জোম্যাটোর ব্যাগও বাঁধা থাকে। কলেজ পাশ রোহিতের কথায় “যখন যেটা পাওয়া যায়, সেটাই তখন করি।” তবে মুশকিল হল সবসময় নগদ টাকা পাওয়া যায় না। অনেকেই এখন অনলাইন পেমেন্ট করেন। দুটো সংস্থাই বেশ খানিকটা টাকা কেটে নেয়। অন্যদিকে প্রতিদিন তেলের দাম বাড়ছে। সবসময় নগদ টাকা হাতে না থাকায় বিকল্প রাস্তাও বার করেছেন রোহিত। ব্যাগেই প্লাস্টিকের বোতলে তেল ভরে রাখেন। মাঝরাস্তায় বাইকের তেল ফুরিয়ে গেলে তেল ঢেলে নেন। তীব্র গরমে কলকাতার রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় মাথায় শুধুই বাড়ির চিন্তা।
একইরকমের সংকটে পড়েছেন দমদমের বাসিন্দা অরিন্দমও। তিনি বাইক চালান র্যাপিডো অ্যাপে। তবে লম্বা ট্রিপের থেকে ছোট ট্রিপই বেশি পছন্দ করেন অরিন্দম। ছোট ট্রিপ থেকেই কিছুটা টাকা রোজগার হয়, নইলে কোম্পানি অনেকটা টাকা কেটে নেয়। দূরত্ব বেশি হলে কিলোমিটার পিছু কম টাকা দেয় কোম্পানি। পার্কিং থেকে বা এক যাত্রীকে নামানোর পর অন্য যাত্রী পর্যন্ত যেতে যে তেল খরচ হয় তার দামও ওঠে না। কোনো নির্ভরযোগ্য বিমাও নেই অরিন্দমের।
“যে ইনশিওরেন্স কোম্পানি দেয় তা পেতে অনেক হ্যাপা। কজন যে পেয়েছে তা কেউ জানে না। তার উপর আছে পুলিশের হুজ্জুতি”, বলছিলেন অরিন্দম। প্রতি ঘন্টায় হিসেব করতে হচ্ছে কত টাকা রোজগার করে বাড়ি নিয়ে যেতে পারা যাবে। তার উপর গাড়ি সার্ভিসিং, মেরামতের খরচা আছে।
অনলাইন ডেলিভারি ‘পার্টনার’ থেকে ‘রাইডার’ — সকলেই কর্পোরেট শোষণের জালে বাঁধা পড়েছেন। আর যাঁরা এই কাজ করছেন, তাঁরা অনেকেই এখনো চাকরি খুঁজছেন।
সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে বেকারত্ব বেড়েই চলেছে। ১৬ মার্চ ২০২২ আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে “অতিমারির তৃতীয় ঢেউ কাটিয়ে আর্থিক কর্মকাণ্ডে গতি এলে কাজের বাজারের হাল ফিরবে বলে আশা ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল উল্টো ছবি। শুধু যে দেশে বেকারত্ব বাড়ল তা-ই নয়, শহরাঞ্চলে তা ছাড়িয়ে গেল ১০ শতাংশের গণ্ডিও। উপদেষ্টা সংস্থা সিএমআইই-র সমীক্ষা বলছে, ১৩ মার্চ শেষ হওয়া সপ্তাহে দেশে বেকারত্বের হার ৭.৭৩%, গ্রামে ৬.৪৫% এবং শহরে ১০.৩৬%। তিনটিই আগের থেকে বেশি”।
সম্প্রতি রেলে নিয়োগ নিয়ে বিহারে যুবকদের ক্ষোভ, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দেশের কর্মসংস্থানের প্রকৃত চিত্রের আঁচ পাওয়া গিয়েছে। দ্য হিন্দু প্রকাশ করেছে মায়া জনের প্রবন্ধ ‘দি এরা অফ আনএমপ্লয়েড ইন্ডিয়া’। সেই প্রবন্ধে লেখিকা মনে করিয়ে দিয়েছেন ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হিমাচল প্রদেশে পিওন, মালি ও রাঁধুনির ৪২টা পদের জন্য জন্য দরখাস্ত করেছিলেন ১৮,০০০ প্রার্থী। তাঁদের অনেকেরই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে। ২০২১ মার্চে পানিপথ কোর্টে পিওনের ১৩টি পদের জন্য দরখাস্ত করেছিলেন ২৭,০০০ প্রার্থী। মায়া জন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, “বেকারির প্রেক্ষিতে যুবকদের হতাশা এবং ক্ষোভ বাড়বেই। যে অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান হয় না, সেই অর্থনীতি কাজে নিযুক্তদের উপর কাজের বোঝা চাপিয়ে দেয়। ক্লান্ত ভারত এবং কর্মহীন ভারত একই কয়েনের দুটো দিক”।
পশ্চিমবঙ্গেও কর্মসংস্থানের ছবিটা বেশ হতাশাজনক। বিগত দশ বছরে শূন্য পদে স্থায়ী নিয়োগ প্রায় প্রহসনে পরিণত হয়েছে। ৬ অক্টোবর ২০২১ তারিখে রাজ্য সরকারের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী রাজ্যে শিক্ষকের শূন্য পদ ১ লক্ষ ১০ হাজার। রাজ্যে এখন একটাই চাকরি। সিভিক ভলান্টিয়ারের চাকরি। সিভিক ভলান্টিয়ারদের অনেকের কাজই ইব আলে উউ-র অঞ্জনি, মহিন্দরদের কাছাকাছি।
কারোর কাজ হল সারাদিন পার্টি অফিসের বাইরে বসে থাকা আর মিছিল, মিটিং হলে ছবি তুলে অফিসারদের পাঠানো। কেউ আবার সাত সকালে থানার বড়কর্তার পুজোর ফুলও কিনতে যান। বড়কর্তাদের গাফিলতিতে জবাই হন ওই সিভিক কর্মচারীরাই। শুধু সিভিক ভলান্টিয়াররা নন, রাজ্য সরকারের বহু দপ্তরেই কাজ করছেন হাজার হাজার চুক্তিভিত্তিক কর্মচারি, যাঁদের মাসিক বেতন দশ হাজারের কাছাকাছি। যে রাজ্যে সরকারি কর্মচারিদেরই ইউনিয়ন করার অধিকার বাধা পায়, সেখানে এই রকম কর্মীরা যে কোনোভাবেই জোট বেঁধে উঠতে পারবেন তা বলাই বাহুল্য। এঁরা প্রতিদিন অঞ্জনির মতই হতাশ হয়ে বাড়ি ফেরেন।
ইব আলে উউ পরিচালক প্রতীক বৎস তুলে ধরেছেন প্রতি মুহূর্তের নিরাপত্তাহীনতার কথাও। নিরাপত্তারক্ষী হিসাবে কাজ করা, হাইপারটেনশনে ভুগতে থাকা অঞ্জনির জামাইবাবুই হোন বা অন্য সহকর্মী, রাষ্ট্র কাউকে এক মুহূর্ত নিশ্চিন্তে ঘুমোতে দিতে রাজি নয়। ছবিটা জুড়ে প্রতি মুহূর্তের ছটফটানি আমাদের স্বস্তি দেয় না। যেমন স্বস্তি দেয় না মহিন্দরের হারিয়ে যাওয়া, আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, খুন হয়ে যাওয়া। যে খুন স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক। সেই রাজনীতিই ঠিক করে দেয় অঞ্জনিদের ভবিষ্যৎ। দেশের যুবক যুবতীরা চাকরি খুঁজছে। বাকি মানুষদের বিরাট অংশ কাজের বোঝায় ক্লান্ত। আর সেই দেশেই ধর্মের নামে রাজনীতির শোভাযাত্রায় মিশে যাচ্ছে নতুন ভারতের স্বপ্ন।
ছবি: ইব আলে উউ
প্ল্যাটফর্ম: নেটফ্লিক্স
নির্দেশক: প্রতীক বৎস
অভিনয়ে: শার্দূল ভরদ্বাজ, মহেন্দর নাথ, নূতন সিনহা, শশী ভূষণ, নীতিন গোয়েল, নয়না সারিন প্রমুখ
মতামত ব্যক্তিগত
আরো পড়ুন
যত দিন যাচ্ছে সিনেমা উইশ মেশিনে পরিণত হচ্ছে: ব্রান্ডো
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।