১৯৬৭ সালে ইউনিসেফের প্রতিনিধি হিসাবে একটি প্রকল্পের কাজে প্রখ্যাত অভিনেতা মার্লন ব্রান্ডো ভারতে আসেন। দিল্লিতে অল ইন্ডিয়া রেডিওর স্টুডিওতে অমিতা মালিকের সঞ্চালনায় ব্রান্ডো ও সত্যজিৎ রায়ের মধ্যে এক দীর্ঘ কথোপকথন হয়, যা দূরদর্শনে সম্প্রচারিত হয়েছিল। সেই কথোপকথন গত দুদিন ধরে নাগরিক ডট নেটের পাঠকরা পড়ছেন। আজ শেষ পর্ব।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
সত্যজিৎ: আপনার কি মনে হয় আমেরিকান ছবিতে গত কুড়ি বছরে কোনো চোখে পড়ার মত পরিবর্তন এসেছে? কারণ সব জায়গায় সবকিছু বদলাচ্ছে। সিনেমার চেহারাই বদলে যাচ্ছে।
মার্লন: সবকিছুই বদলাচ্ছে, স্টাইলগুলো বদলাচ্ছে।
সত্যজিৎ: আপনার কি আপশোস হয়, বা আদৌ কখনো এরকম মনে হয়, যে চল্লিশের দশকের ছবিগুলো এখনকার চেয়ে ভাল ছিল? কারণ কিছু লোক তো বলে যে সেই সোনালি দিনগুলো চলে গেছে।
মার্লন: আমার মনে হয় পরিবর্তন অনিবার্য। যা চলে গেছে তা নিয়ে আপশোস করার বা স্মৃতিমেদুরতায় ভোগার কোনো মানে হয় না।
সত্যজিৎ: এবং অন্যরকম কিছু হবে।
মার্লন: হ্যাঁ, আমাদের সেটার সাথে মানিয়ে নেওয়াই ভাল। এখন আমেরিকায় একটা জিনিস হচ্ছে যেটাকে বলা হয় আন্ডারগ্রাউন্ড ফিল্ম মুভমেন্ট।
সত্যজিৎ: হ্যাঁ, অ্যান্ডি ওয়ারহল। ওটার সম্বন্ধে আপনার কী মত?
মার্লন: আমার মতে ওটা ঠিক সময়ে এসে পড়েছে। আসলে আমেরিকা বছরের পর বছর ঘুমিয়ে ছিল। আমরা বলতাম এখানে কিছু হবে না, এখানে সব ভাল চলছে। আমরা সবাই বেশ খেয়ে পরে সুখে ছিলাম। তারপর হঠাৎ একটা বিস্ফোরণ হল আর কৃষ্ণাঙ্গদের কেন্দ্র করে এক নিদারুণ পরিস্থিতি তৈরি হল। আমরা একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম।
কারণ কাগজে আমরা নিকারাগুয়ার বিপ্লব বা দিল্লির দাঙ্গার কথা আগেই পড়ে ফেলেছি। তারপর হঠাৎ দেখছি আমাদের নিজেদের দেশেই বর্ণবিদ্বেষী দাঙ্গা হচ্ছে। আমেরিকার মানুষের উপর এর প্রভাব আপনারা কল্পনা করতে পারবেন না। যেমন ধরুন, ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করায় পৃথিবীর অনেক দেশে সরকার পালটে গেছে তো? যেমন তুরস্কে। তারা দায়িত্ব নিয়ে খারাপ সরকার বদলে ফেলে তুলনামূলকভাবে ভাল সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। অথচ আমেরিকার ছাত্রছাত্রীদের কিছুদিন আগেও কোনো হেলদোল ছিল না। কিন্তু এখন ওরা ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে জোর আওয়াজ তুলেছে। বর্ণবৈষম্য এবং সরকারের নীতিগুলো সম্পর্কে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ওরা এখন সবকিছুতে ঢুকে পড়েছে এবং দিনদিন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
সত্যজিৎ: একইসঙ্গে অ্যালান জিনসবার্গের গোষ্ঠীকে দেখা যাচ্ছে। আর প্রাচ্য সম্পর্কে একটা অদ্ভুত আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এমনকি মারিজুয়ানা, ড্রাগ আর এলএসডি সম্পর্কেও।
মার্লন: আমেরিকা এক অর্থে এখনো একটা পথপ্রদর্শক দেশ। কারণ প্রযুক্তিতে আমরা সামনের সারিতে আছি, ফলে তার পীড়াগুলোর আক্রমণ সবচেয়ে প্রথমে আমাদের উপর হয়। সুতরাং জনগোষ্ঠী হিসাবে দেখতে গেলে কিছু কিছু দ্বন্দ্ব হয়ত এই মুহূর্তে এখানে নেই, কিন্তু যে কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ হতে পারে। যেমনটা আমেরিকায় হয়েছে। অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। আর আমেরিকাকে সাধারণভাবে এগিয়ে থাকা বা উন্নত দেশ মনে করা হলেও, আসলে অনেক ব্যাপারে আমরা পিছিয়ে থাকা দেশ। আমাদের অন্য দেশগুলোর থেকে অনেককিছু শেখার আছে। বিশেষ করে মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে। আমরা এই সমস্যাটা মেটানোর চেষ্টা করছি, আর তাতে অগ্রগতিও হচ্ছে।
সত্যজিৎ: মনে হয় না, সিনেমা সমস্যাটা কিছুটা মেটাচ্ছে?
মার্লন: অবশ্যই। ইউ এস ইনফরমেশন সার্ভিসেসের প্রধান মিস্টার এডওয়ার্ড আর মারো হলিউডে আমাদের কাছে এসেছিলেন, সবাইকে ডেকেছিলেন। বললেন আপনাদের কাছে যা আছে আর এই মাধ্যমে আপনাদের যা স্থান, তার মূল্য আপনারা যা ভাবেন তার চেয়ে অনেক বেশি।
আপনারা ছবিতে মানুষকে যেভাবে দেখান সেটা নিয়েও ভাবা দরকার। কারণ প্রযোজকরা কোনোকিছুর পরোয়া করে না। তারা স্টিরিওটাইপ অনুযায়ী চলে। আর কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে যারা শিক্ষিত, প্রতিভাবান — তাদের দিয়ে সেই স্টিরিওটিপিকাল চরিত্রগুলো করানো হচ্ছিল। তারা অভিনয় করতে স্রেফ অস্বীকার করেছে।
সত্যজিৎ: কারণ তারা অপমানিত বোধ করেছে।
মার্লন: হ্যাঁ, সেই কারণে ওগুলো এখন উঠে যাচ্ছে। আমি একটা হিন্দি ছবি দেখলাম যেটা সামাজিক, সাংস্কৃতিকভাবে ঠিক বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু সেখানে এক ভিখারি ছিল। আমি দেখে বিস্মিত হলাম যে দর্শকরা তাকে দেখে হাসলেন। অভিনেতা ওই চরিত্রটা করতে রাজি হয়েছেন এটাই যথেষ্ট বিস্ময়কর। চরিত্রটা পঙ্গু এবং বাঁকাচোরা শরীরের। আমি দেখে খুব আঘাত পেলাম যে ওরকম একটা লোককে নিয়ে রসিকতা করা হয়েছে।
সত্যজিৎ: খুবই কুরুচিকর। আমার মনে হয় এই মনোবৃত্তি সিনেমা থেকে পুরোপুরি মুছে যাওয়া উচিত। হয়ত কিছুটা রয়ে গেছে এখনো।
অমিতা মালিক: কিন্তু সব মিলিয়ে, ভবিষ্যতের দিকে তাকালে সিনেমা নিয়ে এখনো আশাবাদী হওয়া যায়। এ ব্যাপারে কি আপনারা একমত?
মার্লন: আমার মনে হয় শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে ততই সিনেমা উইশ মেশিনে পরিণত হচ্ছে। যেমন ধরুন রিচার্ড নিক্সনের গত নির্বাচনে জয়টা…
সত্যজিৎ: উনি তো কেনেডির জন্যে জিতলেন…
মার্লন: হ্যাঁ, কারণ আপনি তো ভাল করেই জানেন, ক্যামেরা যখন ক্লোজ আপে আসে তখন আপনি অভিনেতাকে বলেন, কিচ্ছু করতে হবে না, স্রেফ ক্যামেরার সামনে থাকো। অভিনয় কোরো না, শুধু চিন্তা করো। কারণ তুমি কী নিয়ে ভাবছ সেটা ক্যামেরা দেখবে। ঠিক সেটাই আমেরিকায় হয়েছে।
সত্যজিৎ: ঠিক তাই।
মার্লন: ক্যামেরা মিস্টার নিক্সনের মুখটাকে ক্লোজ আপে ধরেছিল। দেখা যাচ্ছিল যে উনি আছেন… ক্যামেরা এখন যেমন দেখে। আমার মনের মধ্যে কী চলছে দেখতে পায়। আর নিক্সনের চালাকি দেখা যাচ্ছিল, সংকল্পের অভাব আর দ্বিধাও দেখা যাচ্ছিল। অন্যদিকে কেনেডি ছিলেন সোজাসাপ্টা এবং দৃঢ়বিশ্বাসী। রাজনীতির পণ্ডিত ব্যক্তিরাও সকলে এটাই বলেছিলেন।
সত্যজিৎ: আসলে সিনেমা একটা অসাধারণ মাধ্যম তো।
মার্লন: আর আশ্চর্য ব্যাপার হল রাজনীতিবিদরা অভিনেতা হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু অভিনেতারা রাজনীতিবিদ হচ্ছে না [সত্যজিৎ হাসেন]। রাজনীতিবিদরা অবশ্য চিরকালই অভিনেতা ছিল, কিন্তু স্বীকার করত না। এখন ওদের মেকআপ করেই কথা বলতে হয় [ব্রান্ডো গজরান]।
অমিতা মালিক: আসলে সত্যজিৎবাবু যেমন বললেন। সিনেমা সাংঘাতিক হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু তাহলেও এটা একটা শিল্পমাধ্যম এবং শুভ শক্তি। এটা কি আপনারা মানেন?
সত্যজিৎ: সম্ভাবনাগুলো সবই এখনো ভালর দিকেই, তাই না?
মার্লন: আমার মনে হয় খারাপের দিকেও।
সত্যজিৎ: আপনি কীভাবে সিনেমাকে ব্যবহার করবেন তার উপর নির্ভর করছে। এবং সেইজন্যেই নির্দেশক এখনো এত গুরুত্বপূর্ণ।
মার্লন: নাজি জার্মানিতে এক মহিলা সেই যে ফিল্মটা বানিয়েছিলেন…
সত্যজিৎ: হ্যাঁ, লেনি রিফেনস্টাল।
মার্লন: দারুণ।
সত্যজিৎ: অলিম্পিক।
মার্লন: স্রেফ নাজিবাদের জন্যে… আপনি আমাদের দেশে কবে আসছেন?
সত্যজিৎ: ঠিক বলতে পারছি না। যাব হয়ত কোনোদিন।
মার্লন: আশা করি আপনি আমার বাড়িতে উঠবেন। ইউ উইল বি মোস্ট ওয়েলকাম।
সত্যজিৎ: অনেক ধন্যবাদ। সে তো আমার সৌভাগ্য। হলিউডে আমার অনেক বন্ধু আছে, তাদের সবার সাথে দেখা করব।
অমিতা মালিক: তাহলে আপনি আমাদের দেশে অতিথি হয়ে এসে সত্যজিৎ রায়কে আপনার দেশের অতিথি হওয়ার আহ্বান জানালেন, এই বার্তা নিয়েই আমরা শেষ করছি।
আমরা আশা করি আপনি আবার আসবেন। ইউ উইল অলওয়েজ বি ওয়েলকাম। মার্লন ব্রান্ডো, সত্যজিৎ রায় — দুজনকেই ধন্যবাদ।
মার্লন: ধন্যবাদ।
সত্যজিৎ: ধন্যবাদ, অমি।
ভাষান্তর: প্রতীক
পড়ুন গোটা সিরিজ : সত্যজিৎ – ব্রান্ডো মুখোমুখি
- পর্ব ১ : সত্যজিৎ রায় মানুষটা আর তাঁর ছবি একে অপরের পরিপূরক: ব্রান্ডো
- পর্ব ২ : ছবিগুলোতে আমাকে প্রফেট বলে মনে হোক চাই না: সত্যজিৎ
- পর্ব ৩ : যত দিন যাচ্ছে সিনেমা উইশ মেশিনে পরিণত হচ্ছে: ব্রান্ডো
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
অসম্ভব রকমের সাবলীল, ফ্লুইড ট্রানসলেশন। বহুদিন পরে একটা ভাল ট্রানসলেশন পড়লাম। একটা ছোট ব্যাপার, ওটা যতদচর জানি অ্যালেন গিনসবার্গ।
দুর্দান্ত একটি সাক্ষাৎকার!
[…] শেষাংশ >> […]