গত ১৬ এবং ১৭ ডিসেম্বর, ২০২১, দেশব্যাপী ব্যাঙ্ক ধর্মঘটের ব্যাপ্তি কি আদৌ আটকাতে পারবে এই বছর সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে পাশ হতে চলা ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ বিলকে? সময়ের কাছে সে উত্তর জমা রেখেও বলা যায়, গত দুদিন দেশজুড়ে ব্যাঙ্ক ধর্মঘটের আগেও আলাপ আলোচনার চেষ্টায় যে পরিমাণ উদাসীনতা কেন্দ্রীয় সরকার দেখিয়েছে, দেশের অর্থনীতির পক্ষে তা দুর্ভাগ্যজনক।

“বেসরকারি হলে পরিষেবা ভাল হবে” স্লোগান বর্তমান শাসক কিম্বা যে সর্মথকদের মুখে অহরহ ধ্বনিত হচ্ছে, তাঁদের কাছে বিনীত প্রশ্ন, সরকারি হলে পরিষেবা ভাল হচ্ছে না কেন?

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

করোনা-উত্তর ভারতীয় অর্থনীতির কথা ছেড়ে দিলেও, ২০১৬ সালের নোটবন্দির পর থেকেই এই তথাকথিত গরীব, আম আদমির সরকারের সঙ্গে আচ্ছে দিনের কোনো সম্পর্ক নেই। ২০১৪ সালে যে শ্রমিক অবসর গ্রহণের পর স্থায়ী আমানতের মাসিক সুদ পেতেন ৮.৪% হারে, তিনিই এখন সুদ পান ৬% হারে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, আজ থেকে মাত্র সাত বছর আগে খাওয়ার বা গাড়ি চড়ার তেল এ দেশে তরল সোনা বলে গণ্য হত না।

জীবনানন্দ দাশ বহু বছর আগে লিখে রেখে গেছিলেন “মানুষটা মরে গেলে যদি তাকে ওষুধের শিশি / কেউ দেয়, বিনি দামে, তাতে কার লাভ, এই নিয়ে ভীষণ সালিশি।”

এক অদ্ভুত জাঁতাকলে আটকে রয়েছে বর্তমান ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা। অর্থমন্ত্রী সরাসরি বলেছেন, এই অর্থবর্ষেই অন্তত দুটি ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের কথা। অর্থমন্ত্রীর স্বপ্নের পাইপলাইন প্রকল্পে ব্যাঙ্ক অত্যন্ত সোনার ডিম পাড়া হাঁস। অথচ সম্ভাব্য ক্রেতা হিসাবে যে শিল্পপতিদের নাম ভেসে আসছে, তাঁরাই আবার ব্যাঙ্কগুলির বিপুল অনাদায়ী ঋণ অর্থাৎ এনপিএ শোধ না করা উইলফুল ডিফল্টার। অর্থাৎ আমার আপনার যে টাকা ঋণ হিসাবে নিয়ে শোধ করতে না পারায় ব্যাঙ্কগুলো ধুঁকছে বলে দাবি করা হয়, সেই টাকা দিয়েই ব্যাঙ্ক কিনবেন শিল্পপতিরা। অথচ শেষ কোয়ার্টারের ফলাফল অনুযায়ী সব কটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক লাভের মুখ দেখেছে। কিন্তু হাইকোর্টের বারংবার নির্দেশ সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার এই বিশেষ ঋণখেলাপি গোষ্ঠীর নামের তালিকা আজ অব্দি প্রকাশ করেননি।

অর্থনীতি হল বিজ্ঞান। উদারনীতির নামে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের যে বিষবৃক্ষের বনসাই সরকার তৈরি করতে চাইছেন, তার শিকড় বর্তমান করোনা-উত্তর পক্ষাঘাতগ্রস্ত ভারতীয় অর্থনীতির আরও গভীরে প্রবেশ করবে। সমস্ত অর্থনৈতিক সুযোগসুবিধা — গৃহঋণ, কৃষিঋণ, শিক্ষাঋণসহ সমস্ত সুবিধা কুক্ষিগত থাকবে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের মধ্যে। গরীব, মধ্যবিত্তের হাতে রইল লন্ঠন। যে জিনিস ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণের ফলে। অসংখ্য শাখা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, অর্থাৎ কর্মসংস্থান আরও কমবে। ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের ফলে কেবল মাত্র ব্যাঙ্ক কর্মীরাই ক্ষতিগ্রস্থ হবেন বলে যাঁদের ধারণা, তাঁরা জেনে রাখুন। মধ্যবিত্তের হেঁশেল অব্দি সে আঁচ পৌঁছাতে খুব বেশি ঋতু পেরোতে হবে না আমাদের।

করোনা-উত্তর যুগে প্রাণ বাঁচাতে যখন আক্ষরিক অর্থেই নিও-লিবারাল অর্থনীতি থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে শুরু করেছে প্রথম বিশ্বের প্রায় সবকটি দেশ, ভারতবর্ষ তখন উল্টো দিকে হাঁটতে চাইছে। সেই বেসরকারি ব্যাঙ্কিংয়ের রাস্তায় চলেছে, যে বিপদসংকুল রাস্তা নিয়ে একদা ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের ডিরেক্টর জন মেনার্ড কেইনস আতঙ্কিত মন্তব্য করেছিলেন “ভারতের মত বিপজ্জনক ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন।”

পরিবর্তন যে হয়েছিল, তা ১৯৬৯ সালে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের পর ফেল করা ব্যাঙ্কের সংখ্যা আর ১৯৬৯ সালের আগে ফেল করা ব্যাঙ্কের সংখ্যা দেখলেই বোঝা যায়।

জাতীয়করণের লাইফ জ্যাকেট ছিল বলেই, ২০০৮ সালের ভয়াবহ আর্থিক সুনামির সময় ভারতীয় অর্থনীতি সে ঢেউ পেরিয়ে এসেছিল নির্বিঘ্নে।

বাস্তবে ফেরাই ইতিহাসের শিক্ষা। বিশ্বায়নের মোহিনী মায়ায় না মজে, গত দশকে কিম্বা প্রায় সাত বছরে কী হল আর কী হতে চলেছে সেইদিকে নজর ফেরানো দরকার। গত কয়েক দশকে কৃষি উৎপাদনের হার ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের নীচে নেমে গেছে, শিল্পোন্নতির হার পূর্ববর্তী দশকের হারের অর্ধেকেরও কম। শুধু ব্যাঙ্কের শাখা নয়, সরকারি নীতির প্রভাবে অসংখ্য কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, হু হু করে বাড়ছে কর্মহীনদের সংখ্যা, অবাধ আমদানির ফলে কৃষি ও শিল্পের ভবিষ্যৎ ঘোর অনিশ্চিত। আসলে একশো বছর আগে যা ছিল সাম্রাজ্যবাদ, একশো বছর পর তাকেই আমরা নব্য সাম্রাজ্যবাদ বলতে ইতস্তত করছি। ক্রিপ্টোকারেন্সি আর ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের যুগে তা-ই এখন বিশ্বায়ন।

ধনবন্টনের এই বেড়ে চলা বৈষম্যে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ মোটেই কেবল দশ লক্ষ কর্মী ও তাদের পারিবারিক সমস্যা নয়। সমস্যা দেশের এবং দেশীয় অর্থনীতির।

প্রধানমন্ত্রী সোচ্চারে বলছেন, ব্যাঙ্ক ফেল করলে তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পাঁচ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে। বাকি টাকার কোন হিসাব নেই। তার চেয়েও বড় কথা, ব্যাঙ্ক ফেল করবে না — এ কথা দেশীয় সর্বাধিনায়কের মুখেও নেই। অথচ ব্যাঙ্ক ফেল করলে পাঁচ লাখের এক অদ্ভুত “বাহির বাড়িতে লন্ঠন আর ভিতর বাড়িয়ে ঠনঠন” চলছে।

অর্থনীতির সেই রক্ষাকবচটা যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে, ধর্মঘট তার জন্যেই। এই লড়াইকে আগামীদিনে আরও মাটির কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে, রূঢ় বাস্তবের প্রতিটি অণু পরমাণুর সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে। শীতকালীন অধিবেশনে এই বিল ফিরিয়ে নেওয়া না হলে ‘স্ট্রাইক ইন দ্য টাইম অফ করোনা’ বাড়বেই। সাধারণ মানুষ পক্ষ নিন। হয় নিজের পক্ষ, নইলে মাদার ইন্ডিয়া ছবির সুখী লালাদের পক্ষ। সময়ের লড়াই সময়ের সঙ্গেই এগোবে, ভারতীয় অর্থনীতি পিছু হটবে না, হটতে দেওয়া হবে না।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.