১৯৬৭ সালে ইউনিসেফের প্রতিনিধি হিসাবে একটি প্রকল্পের কাজে প্রখ্যাত অভিনেতা মার্লন ব্রান্ডো ভারতে আসেন। দিল্লিতে অল ইন্ডিয়া রেডিওর স্টুডিওতে অমিতা মালিকের সঞ্চালনায় ব্রান্ডো ও সত্যজিৎ রায়ের মধ্যে এক দীর্ঘ কথোপকথন হয়, যা দূরদর্শনে সম্প্রচারিত হয়েছিল। সেই কথোপকথনের প্রথম অংশ গতকাল নাগরিক ডট নেটের পাঠকরা পড়েছেন। আজ দ্বিতীয় পর্ব।

 

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

মার্লন: আমার মনে হয় ভারতীয়রা সাধারণভাবে বুঝতে পারেন না, ভারতে, ব্রিটেনে, আমেরিকায় যে কোনো বিষয় নিয়ে ছবি করার যে স্বাধীনতা পাওয়া যায় — সেটা কী পরম সৌভাগ্য। যদি যৌনতা নিয়ে বিরাট কোনো গোলমাল না করেন, তাহলে আপনি যা ইচ্ছে ছবি করতে পারেন। আমাদের দেশেও যৌনতা নিয়ে কিছু বিধিনিষেধ আছে। সেগুলো এখানকার থেকে আলাদা। জাপান আরেকটা দেশ, সেখানে আবার ব্যাপার-স্যাপার আরেকরকম। কিন্তু ফ্রান্সে আপনি কোনো ছবি, মানে এমন কোনো রাজনৈতিক ছবি করতে পারবেন না যাতে সেনাবাহিনী বা ফ্রান্সের ভাবমূর্তি নিয়ে কিছু আছে। করলে সেন্সর করা হবে। তাই বলছি, আমাদের দেশগুলোতে যে স্বাধীনতা পাওয়া যায় ছবি করার ক্ষেত্রে, সে এক পরম সৌভাগ্য।

সত্যজিৎ: আমি কিন্তু চাই না আমার ছবিগুলোতে আমাকে প্রফেট বলে মনে হোক। আমি কোনো বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করতে চাই না, চোখে আঙুল দিয়ে সেটা দেখিয়ে দিতে চাই না, বুঝলেন? যাতে খুব বেশি প্রোপাগান্ডিস্ট ব্যাপার না হয়ে যায়। তবে আমি নিশ্চয়ই কতকগুলো সমস্যা পরিষ্কার দেখাতে চাই, যাতে মানুষ সেগুলো সম্পর্কে সচেতন হয়।

মার্লন: অবশ্যই। আমার মনে হয় ওটাই মূল তফাত, মানে ফিল্মকে এক ধরনের উদ্দীপক হিসাবে ব্যবহার করা। একটা ছবির কথা বলব ভাবছিলাম, জানি না আপনি দেখেছেন কিনা, হয়ত দেখেছেন। আমি ছবিটা দেখেছিলাম ইংল্যান্ডে; বিবিসির জন্য বানানো ছবি। দেখুন, এবার আমি নিজেই নিজের কথার উল্টো কথা বলতে যাচ্ছি। ছবিটা করেছে পিটার ওয়াটকিন্স নামে একটি অল্পবয়সী ছেলে।

সত্যজিৎ: ও, আপনি দ্য ওয়ার গেম ছবিটার কথা বলছেন।

মার্লন: হ্যাঁ। বিবিসি ওই ছবিটা দেখাতে দিচ্ছে না।

সত্যজিৎ: অথচ ওরাই ছবিটা কমিশন করেছিল।

মার্লন: আবার ওরাই ব্যান করে দিয়েছে।

মার্লন: আমি ছবিটা দেখে কেঁদে ফেলেছিলাম। অনেক সময় হয় না, একটা ছবি দেখতে গিয়ে মনে হয়, ও আচ্ছা, এই ব্যাপার? এর পরে তো ওই হবে, তারপরে এই হবে… ফলে আপনি হেলাফেলা করে ছবিটা দ্যাখেন। কিন্তু ওই ছবিটা সত্যিই আমার চোখে জল এনে দিয়েছিল, আর একটা সময়ের পর আমি চোখ ঢেকে ফেলেছিলাম। আর দেখতে পারছিলাম না।

সত্যজিৎ: আমি দেখার সুযোগ পাইনি, কিন্তু মনে আছে কেনেথ টাইনান একটা সমালোচনা লিখেছিলেন, সেখানে বলেছিলেন এটা সর্বকালের সেরা ছবি।

মার্লন: ভারতে কি ছবিটা দেখতে পাবেন মনে হয়?

অমিতা মালিক: আমি বলতে যাচ্ছিলাম, যে ভারতের জন্য আমরা ছবিটা আনিয়েছি, হয়ত টিভিতে দেখানো হবে। আর ফিল্ম সোসাইটিগুলোও নিশ্চয়ই দেখাবে ছবিটা। আমি নিশ্চিত।

সত্যজিৎ: কিন্তু একটা জিনিস আমার মনে হয় এখানে আমরা সকলেই জানতে চাই? চ্যাপলিনের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?

মার্লন: মিস্টার চ্যাপলিন একজন শিল্পী। উনি একজন অদ্ভুত লোক এবং অনেক দিক থেকে অনন্য। অভিজ্ঞতাটা অনেককিছুর সংমিশ্রণ। কখনো খুব মজার, আবার কখনো খুব ক্লান্তিকর। সবসময়েই খুব চাপের মধ্যে কাজ করতে হত, কারণ উনি সারাক্ষণ কাজ করেন। যখন তখন কাজের ঝোঁক আসে। উনি সবসময়েই কাজের মধ্যে থাকেন এবং লম্ফঝম্প করে বেড়ান। সত্যি কথা বলতে ওঁর সঙ্গে কাজ করার সময়ে হাতের পুতুল হয়ে যেতে হয়। একটা দৃশ্য ছিল, একজন আমার মুখের উপর ধোঁয়া ছাড়ছে আর আমি এইভাবে (হাত নেড়ে দেখান) ধোঁয়া সরাচ্ছি। চার্লি দৌড়ে এসে আমাকে বললেন “না, আমার এই দু আঙুল নাড়ানো পছন্দ নয়। সবকটা আঙুল ব্যবহার করো।” উনি ছবির প্রত্যেকটা ভূমিকায় অভিনয় করে দেখান। ব্যাপারটা দারুণ মজার। ধরুন আমি আর আপনি অভিনয় করছি, উনি লাফিয়ে উঠে আপনার ভূমিকাটা করবেন, তারপর এদিকে এসে অন্য ভূমিকাটা করবেন। এই নিয়ে ওঁর ব্যাখ্যাটা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। জানি না ছবিটা কতটা ভাল হবে, তবে…

সত্যজিৎ: আমেরিকায় মুক্তি পেয়েছে?

মার্লন: না, এখনো বেরোয়নি। তবে ব্রিটেনে খুব খারাপ রিভিউ পেয়েছে। ব্রিটিশ সমালোচকরা ছবিটাকে একেবারে শূলে চড়িয়ে দিয়েছে। চ্যাপলিনকে একেবারে কুড়ুল নিয়ে তাড়া করেছে বলা যায়।

সত্যজিৎ: চ্যাপলিনকে এভাবে আক্রমণ! লোকটা তো ফিল্মের মাস্টার একেবারে।

মার্লন: প্যারিসে অবশ্য বেশ উৎসাহব্যঞ্জক রিভিউ বেরিয়েছে। কয়েকটাতে তো রীতিমত প্রশংসা করা হয়েছে। জানি না শেষ পর্যন্ত কী হবে।

সত্যজিৎ: আপনি কি কুবরিকের সাথে কাজ করেছেন?

মার্লন: করতে যাচ্ছিলাম। আমি স্ট্যানলির সাথে কাজ করতে চাই…

সত্যজিৎ: ওয়ান-আইড জ্যাকস?

মার্লন: ওয়ান-আইড জ্যাকস ছবিটার জন্য ২০০ বা তারও বেশি অভিনেতা বসে ছিল, কিন্তু আমরা এক ফুট ফিল্মও শুট করতে পারিনি, কারণ ও লিখেই চলেছিল।

সত্যজিৎ: স্ট্যানলি যখন ওয়ান-আইড জ্যাকস তৈরি করতে যাচ্ছেন তখন আমি হলিউডে ছিলাম। তারপর তো আপনি দায়িত্ব নিলেন…

মার্লন: আসলে আমি ওকে বললাম, দ্যাখো স্ট্যানলি, আমাদের তো একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা ও বলল, আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। আমি বললাম, আমি সিদ্ধান্ত নেওয়ার অবস্থায় নেই। তখন ও বলল কিছু একটা করতেই হবে, কারণ ও যতদূর এগিয়েছে তার বেশি আর এগোতে পারবে না।

সত্যজিৎ: আপনি নির্দেশনায় যাওয়ার চেষ্টা করেননি কখনো?

মার্লন: না, কাজটা বড্ড ক্লান্তিকর।

সত্যজিৎ: হ্যাঁ, দুটো জিনিস একসাথে করা শক্ত।

মার্লন: আমার অভিনয় করার চেয়ে নির্দেশনায় আগ্রহ বেশি।

সত্যজিৎ: কিন্তু অভিনয় করতে করতে নির্দেশনায় আগ্রহ নেই?

মার্লন: সেটা বড্ড কঠিন।

সত্যজিৎ: সম্ভবত।

মার্লন: আসলে নিজের দৃষ্টিকোণ গুলিয়ে যায়। আপনি কখনো অভিনয় করেননি?

সত্যজিৎ: না!

মার্লন: আরে ওভাবে বলবেন না।

সত্যজিৎ: না না, ক্যামেরার পিছনে থাকা অনেক ভাল। কিন্তু বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা খুবই ক্লান্তিকর।

অমিতা মালিক: আমি জিজ্ঞেস না করে পারছি না, কোন ছবিতে অভিনয় করা আপনি সবচেয়ে উপভোগ করেছেন?

মার্লন: মনে হয় মিউটিনি অন দ্য বাউন্টি, কারণ ওটার শুটিং করতে আমাদের তাহিতি যেতে হয়েছিল। অভিনেতা হওয়ার অনেক মজার মধ্যে এটা একটা। কারণ এই পেশায় আপনি তারপর জাপানেও যেতে পারেন…

সত্যজিৎ: ভারতে আসা উপভোগ করেছেন তো?

মার্লন: নিশ্চয়ই উপভোগ করেছি। খুব উপভোগ করছি, দারুণ উদ্দীপ্ত বোধ করছি। আমি ভারত সম্পর্কে বেশকিছু জিনিস পড়েছি। কোনো একটা জায়গা সম্পর্কে পড়া, তারপর সেখানে যাওয়া, সেখানে দেখার জিনিসগুলো দেখা, সেখানকার মানুষের সাথে কথা বলা খুব মজার। জানেন তো, সবাই তিন দিনের জন্য নিউইয়র্কে যায় আর বলে “আমি আমেরিকায় গেছি”। অথচ ওটা কিন্তু আসল আমেরিকা নয়। আমি যদি বম্বে, কলকাতা বা হায়দরাবাদে যাই; তা দিয়ে কিন্তু বোঝা যাবে না আসলে দেশটা কীরকম। আমি যদি ভিতরের দিকে যাই, লখনৌ বা…

সত্যজিৎ: ওই শহরটা ঐতিহাসিক দিক থেকে খুব সমৃদ্ধ।

মার্লন: হ্যাঁ, অথবা আমাকে ছোট গ্রামগুলোতে যেতে হবে। আমি থেকেছি ওইসব জায়গায়…

সত্যজিৎ: আপনি কলকাতায় এলে আপনাকে নিশ্চয়ই শহরের আশপাশের গ্রামগুলোতে নিয়ে যেতে পারি। মানে বাংলার গ্রামে আর কি।

মার্লন: আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করতে চাই, কোনো ভাবনার প্রসারে ফিল্মকে ব্যবহার করার সম্ভাবনা সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?

সত্যজিৎ: আমার মনে হয় এটাই সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। সেই কারণে সবচেয়ে সাংঘাতিকও। কিন্তু সঠিক ভাবনাগুলো প্রচার করা উচিত।

মার্লন: কিন্তু সাংঘাতিক হলেও মাধ্যমটা সেন্সর্ড। সারাক্ষণ সেন্সরের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। আজকে ফেস টু ফেস নামে একটা ছবি দেখলাম। ভারতীয় মতামত সম্পর্কে ছবি। যে ট্যাক্সি চালায়, যে জুতো পালিশ করে, ছাত্রছাত্রী, চাষী — তাদের মতামত। ভারতের অনেকটা অংশের মুখ, একে অপরের মুখোমুখি। আমার দারুণ আকর্ষণীয় লাগল ছবিটা।

সত্যজিৎ: আমি আপনার সাথে একমত। এখানে যা যা কাজ হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম সেরা ওই ছবিটা।

মার্লন: একেবারে শেষে যে মন্তব্যটা আছে, সেটা হল ভারত সরকার মানুষকে যা যা দিয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে দামি উপহার হল মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। আমি অনেকসময় ভাবি, যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খাওয়ার স্বাধীনতার সমান কিনা। এটা পেট ভরে খেতে পাবার চেয়েও বেশি জরুরি।

শেষাংশ >> 

ভাষান্তর: প্রতীক

পড়ুন গোটা সিরিজ : সত্যজিৎ – ব্রান্ডো মুখোমুখি

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.