রোজ ভোর পাঁচটায় বাড়ি থেকে বেরোতে হয় সুশীল জানাকে। ছেলেমেয়ে দুটো অত সকালে ঘুম থেকে ওঠে না। তাই রোজই ওদের ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে বেরোতে হয় সুশীলকে। ঘুম চোখে, সাইকেল চালিয়ে স্টেশনে এসে ট্রেন ধরে রোজ সোনারপুর থেকে যাদবপুর এসে, হেঁটে কর্পোরেশনের কনজারভেন্সি ডিপার্টমেন্টের গাড়িগুলো যেখানে রাখা থাকে সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সকাল ছটা। গরমকালে অত অসুবিধা না হলেও শীত আর বর্ষাতে বেশ অসুবিধা হয়। কিন্তু এটাই এ কাজের দস্তুর; কামাই করা যাবে না। যে অঞ্চলটা সুশীল আর বাচ্চুর দায়িত্বে আছে, সেই অঞ্চলে মোটামুটি তিনশো বাড়ি, দুটো রাস্তা আর বেশ কিছু গলি আছে। রোজ রাস্তাগুলো প্রথমে ঝাঁট দিতে হয়, তারপর লোহার গাড়ি ঠেলে, হুইসেল দিতে দিতে ঘুরে ঘুরে বাড়ির ময়লা সংগ্রহ করা। তারপর গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে এলাকা থেকে বেশ কিছুটা দূরে ময়লার ভ্যাটে ফেলে আসতে হয়। সেখান থেকে কম্প্যাক্টর মেশিন ময়লা তুলে নিয়ে যায়।
সপ্তাহে একদিন ছুটি, তাও পালা করে। দুজন একসঙ্গে ছুটি নিতে পারে না। ডিউটি শুরু যখন, তখন সময় লিখে একটা খাতায় সই করতে হয়। সমস্ত ময়লা ফেলে, গা হাত পা ধুয়ে কর্পোরেশন অফিসে গিয়ে রিপোর্টিং করতে করতে দুপুর বারোটা। তারপর ছুটি, বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর দুটো। না, সুশীল কিংবা বাচ্চু — কেউই কিন্তু কর্পোরেশনের স্থায়ী কর্মী নন, এনারা সবাই ঠিকা কর্মী। মাসের শেষে ঠিকাদার পেমেন্ট পায়, তারপর সুশীল, বাচ্চুরা মাইনে পান — থোক ৭৮২৫ টাকা। বছরে ১৪টা ক্যাজুয়াল লিভ। সুশীলরা শুনেছেন, ঠিকাদার নাকি জন প্রতি ১০০০ টাকা বেশি পেয়ে থাকেন। কিন্তু তাঁকেও তো এলাকার নেতা-মন্ত্রীদের কিছু টাকা দিতে হয়। সেটাই নাকি নিয়ম। তাই তাঁরা কেন মাত্র ৭৮২৫ টাকা পান তা নিয়ে ঠিকাদারকে প্রশ্ন করার কথা মাথায় আসেনি সুশীল, বাচ্চু বা তাঁদের মতো যাঁরা রোজ শহরের নাগরিকদের ময়লা ফেলার পৌর পরিষেবা দিয়ে থাকেন, তাঁদের। ওঁদের ওই কটা টাকা মাইনেও আবার অনিয়মিত। কোনো মাসের প্রথমে পেলেও পরের মাসে হয়ত মাইনে পেতে পেতে অর্ধেক মাস কেটে যায়। কাগজপত্রে বা মোবাইলে মাঝে মধ্যে দেখেছেন কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের ডিএ বাড়ানো হয়, কিন্তু সুশীলদের ওই থোক মাইনে নড়েও না চড়েও না। সরকারের পক্ষ থেকে কোভিডের সময়ে বাড়ি থেকে যাঁরা ময়লা সংগ্রহ করেন, তাঁদের প্রথম সারির সৈনিক হিসেবে গণ্য করে, দ্রুত টীকাকরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। ব্যাস,ওটুকুই প্রাপ্তি। বেশিরভাগ কর্মীর কাছে একটা দস্তানা পর্যন্ত নেই, হাতের ব্যবহার ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। প্রভিডেন্ট ফান্ড আছে, অসুস্থ হলে সরকারি ইএসআই হাসপাতালে চিকিৎসা পাবেন — এইটুকু আশ্বাস ছাড়া আর কিছু নেই।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে সরকারি কর্মচারীরা তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে ছোটখাট আন্দোলন সংগঠিত করেন। সেরকম কোনো আন্দোলন করা যায় কি না তা নিয়ে সুশীল, বাচ্চুরা অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু ঠিকাদারদের বক্তব্য, কাজ বন্ধ করে কোনো আন্দোলন করা যাবে না। কাজে ঢুকেছিলেন ১৬২৫ টাকায়, মাইনে বাড়তে বাড়তে এখন ৭৮২৫ টাকা। যে মাইনেতে তাঁরা প্রাথমিকভাবে ঢুকেছিলেন, তার চেয়ে খুব বেশি উন্নতি হয়নি। সন্তানদের পড়াশোনা প্রায় বন্ধ, যেটুকু চলছে, তা চালিয়ে যেতেই দুটো স্মার্টফোন কিনে দিতে হয়েছে। যেভাবে সম্প্রতি মোবাইল রিচার্জের খরচ বেড়েছে, তাতে ওটুকুও চালানো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামীদিনে খরচ যে আরও বাড়বে তা ভাল করেই বুঝতে পারছেন সুশীল। কবে পুরোদমে স্কুল খুলবে, সেই আশায় দিন গুনছেন।
পাঁচ বছরে একবার পৌরসভার কাজের ভিত্তিতে পৌরনির্বাচন হয়। কে কত ভাল পরিষেবা দিতে পেরেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত হয় পৌর প্রতিনিধিদের ভাগ্য। ডান, বাম নির্বিশেষে যে কোনো প্রার্থী তাঁদের প্রচারে যে পৌর পরিষেবা দেওয়ার কথা বলছেন, তাতে সুশীলরা যে পরিষেবা দিয়ে থাকেন, সেই ধরনের পরিষেবা আরও কত ভালভাবে নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, তাও থাকছে। কিন্তু যে মানুষগুলো বছরে ৩৬৫ দিন ভোর থেকে এই পরিষেবা দেন, তাঁদের কথা কি কোনো দল ভাবছে? কীভাবে তাঁদের জীবনযাত্রার মানের একটু উন্নতি করা যায় তা নিয়ে কি কোনো রাজনৈতিক দল ভাবছে?
এ তো গেল রোজকার আবর্জনা পরিষ্কার করার কাজের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের কথা। শুকনো ময়লা বা যে ময়লা রিসাইকেল করা যায়, সেই ময়লা নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা আবার অন্যভাবে শোষিত হচ্ছেন। মূলত যাঁরা ১০০ দিনের কাজের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদেরই এই কাজে নিযুক্ত করা হয়। সেখানেও সমস্যা। কেন্দ্র থেকে মাঝেমধ্যেই জানানো হয় ১০০ দিনের কাজের টাকা শেষ হয়ে গেছে। তখন রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা বা রিসাইকেলযোগ্য ময়লা যাঁরা সংগ্রহ করেন, তাঁদের কাজ বন্ধ থাকে। অনেক রাজনৈতিক দল তাঁদের প্রচারপত্রে বলে থাকেন, পৌরনির্বাচন কোনো রাজনৈতিক দিশা পরিবর্তনের জন্য হয় না, এই নির্বাচন শুধুমাত্র পৌর পরিষেবা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করার নির্বাচন। অনেক ভোটারও সেভাবেই ভাবছেন। প্রার্থীরা ব্যক্তি হিসাবে কেমন, তা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। সমস্ত রাজনৈতিক দল প্রচার করছে, কিন্তু কোনো দলের প্রচারেই কি এই ঠিকা কর্মচারীদের স্থায়ী করার কথা আছে? থাকলেও কতটা গুরুত্ব দিয়ে? কলকাতা কর্পোরেশনে নাকি এই মূহুর্তে ২৮,০০০ শূন্য পদ। অন্য পৌরসভাগুলোতে হয়ত আরও অনেক শূন্য পদ আছে। যখন চারিদিক থেকে দাবি উঠছে ১০০ দিনের কাজ ২০০ দিন করা হোক, তখন কোনো কোনো দল এই কর্মচারীদের স্থায়ী করার দাবিকে সামনে আনছেন, কিন্তু তা নিয়ে জোরালো আন্দোলন কোথায়?
কলকাতা হাইকোর্ট রাজ্য সরকারকে জানাতে বলেছে কবে বাকি পুরসভাগুলোতে ভোট হবে। সব দলই প্রচারে বলে থাকে, ক্ষমতায় এলে শূন্য পদে নিয়োগ করবে। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর সুশীল, বাচ্চুদের কথা কোনো দলের মনে থাকে না। ওঁরা যে তিমিরে থাকার সেই তিমিরেই রয়ে যান। নির্বাচনের দিনও কিন্তু ওঁদের ছুটি থাকবে না। যে কাজ করার কথা, তা করার জন্য সেই ভোর পাঁচটাতেই রওনা হতে হবে সোনারপুর থেকে।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
[…] […]