পয়লা এপ্রিল, ২০২২ কিছু মানুষ প্রায় অসাধ্য সাধন করেছেন। নিউইয়র্কের মতন ডেমোক্র্যাট রাজ্যের একমাত্র রিপাবলিকান অঞ্চল বা বোরো স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে অ্যামাজন সংস্থার কর্মীদের প্রথম লেবার ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করা গেছে। যদি এ উদ্যোগ ভয়ানক দুর্বিপাকে ভেসে না যায়, তবে সত্যিই অভিনন্দনযোগ্য।

বৈষম্য কতটা তীব্র আর লড়াইটা কত কঠিন, তা বুঝতে গেলে শুরুতেই মনে রাখা দরকার, অ্যামাজন কর্ণধার জেফ বেজোস এক সেকেন্ডে যা রোজগার করেন (মোটামুটি ২০০০-৩০০০ ডলার) তা আমাদের এক মাসের মাইনের কাছাকাছি বা তার চেয়েও বেশি। ধরে নিলাম, আমরা গবেষণা-নিবিষ্ট, দিনে ৮-১০ ঘন্টা কাজ করেও, ছাত্র-কর্মী তকমা নিয়ে, শিক্ষার এই পর্যায়ে লক্ষ্মী প্রায় ত্যাগই করেছি। তবু আসুন কথাটা আবার পড়ে দেখি। জেফ বেজোসের এক সেকেন্ডের আয় তাঁর সংস্থার সাধারণ স্তরের কর্মীদের এক সপ্তাহের (৭ দিন=৬,০৪,৮০০ সেকেন্ড) রোজগারের থেকেও বেশি। মনে পড়ে যায়, যেমন আমরা ছোটবেলায় জেনেছিলাম, একটি প্রথম বিশ্বের মানুষের একবেলার খাবার (calorific consumption) আফ্রিকার কিছু দেশের মানুষের গড় ১২ দিনের খাবারের থেকেও বেশি।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

আমরা দেখেছিলাম, গত শতাব্দীর শেষভাগে ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানবভাবনা ভেঙে পড়েছিল একের পর এক দেশে। ইতিহাসে যেহেতু প্রত্যেক রাষ্ট্র, প্রত্যেক ক্ষমতাই কখনো না কখনো বশীভূত হয়, তাই জর্জ অরওয়েলকে লিখতে হয় “There is only power, no law”। আমরা দেখেছি, কীভাবে বাণিজ্যিক মিথ্যার কাছে সংগ্রামের ইতিহাস হেরে যায়, মুছে যায়। শক্তি চট্টোপাধ্যায় লেখেন “বদলে যেতে যেতে, একটি মানুষ থমকে দাঁড়ায় জীবনে হাত পেতে”। ঠিক তেমনই সাম্যভাবনার মুখ থেকে মুখোশ বদলাতে বদলাতে আমরা যেখানে এসে দাঁড়ালাম, সেখানে থমকে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

সিএনএন বিজনেসের প্রতিবেদন বলছে “There were 2,654 votes in favor of unionizing and 2,131 votes against it by the end of the second and final day of public vote counting on Friday. Out of approximately 8,325 eligible voters, 4,785 votes were counted and another 67 were challenged. Seventeen ballots were voided.”

সেনেট এবং ডেমোক্র্যাট ক্যাবিনেট অ্যামাজনের কর্মীদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। বার্নি স্যান্ডার্সের মত প্রথম সারির রাজনীতিবিদ স্বভাবতই জানিয়েছেন সমর্থন ও শুভেচ্ছা। লকডাউনের শুরুতে স্বাস্থ্যের অধিকারে দাবিতে JFK8 (অ্যামাজন ওয়্যারহাউস) থেকে বরখাস্ত হওয়া ক্রিস স্মলসের প্রায় একক জেদে সামান্য বাসস্টপের মিটিং আর একসাথে খাওয়াদাওয়ার মধ্যে দিয়ে এগোনো লড়াই এসে দাঁড়ায় ইউনিয়ন তৈরি করার পক্ষে ৫০ শতাংশের বেশি ভোটে। একটি একক বঞ্চনা ও তার হাত ধরে জেগে ওঠা গোষ্ঠী-অনুভূতি গত সাতাশ বছরের অনতিক্রম্য এক বেড়া টপকাতে পারল। আগামী পাঁচদিনের মধ্যে এই জনমতের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সুযোগ পাবে অ্যামাজন। তারা “গভীর দুঃখ ও হতাশার” সঙ্গে জানাচ্ছে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। জানাচ্ছে জনাদেশের বিরুদ্ধে কীভাবে প্রয়োজনে আইনি পথে এগোনো যায় সেই সিদ্ধান্ত তারা নিচ্ছে এবং অবশ্যই চাইছে দিকভ্রষ্ট শ্রমিকদের চেতনা ফেরাতে, “ঘর ওয়াপসি”-র মত।

পঞ্চাশ বছর এগিয়ে এসে, এই আপাত স্বপ্নের দেশের দিকে যদি একটু নিবিড়ভাবে তাকিয়ে দেখি, তাহলে কল্পনাতীত ক্লেদ ও ক্লেশ দেখতে পাওয়া যায়। দেখতে পাওয়া যায় প্রতি মুহূর্তে মানবিক দুঃখ, যা ঝকঝকে সুপার মার্কেটে সাজানো থাকে। ন্যূনতম পারিশ্রমিকের যে আশ্চর্য খেলা এ দেশে চলে, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। ইউনিয়ন তৈরি না হতে দেওয়ার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইনি ও সামগ্রিক খাতে (union-busting consultations) প্রায় চার মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে অ্যামাজন। এমনই একটি ইউনিয়ন-বিরোধী সভার একটি ভয়েস রেকর্ড থেকে জানা গেছে, অ্যামাজনের প্রতিনিধি প্রায় বেআইনিভাবে কর্মীদের জানাতে চেষ্টা করেছে ইউনিয়নে যোগ দিলে ন্যূনতম বেতনে টান পড়তে পারে। উল্লেখ্য, নিউইয়র্কের নিয়ম অনুযায়ী ঘন্টায় ১৫ ডলারের পরিবর্তে ১৮ ডলার পারিশ্রমিক দেয় অ্যামাজন। কাজেই সেই বাড়তি সুবিধাটুকু থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কাকে এই ভোট প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছিল, যা সেই সভাতেই তৎক্ষণাৎ চিহ্নিত করা হয়।

NLRB (ন্যাশনাল লেবার রিলেশনস বোর্ড) জানাচ্ছে, সাধারণত এই ধরনের প্রত্যক্ষ চেষ্টা ও বাধ্যতামূলক মিটিংয়ে শ্রমিকদের মতামতের উপর প্রভাব বিস্তার করেই বারবার ইউনিয়ন তৈরির চেষ্টা ভেস্তে দেওয়া হয়। যেমন অ্যালাবামায় (BHM1) গত বছর এবং এ বছর ন্যূনতম ৩০% ভোটও পায়নি ইউনিয়ন। এই ধরনের একপেশে প্রভাবশালী মিটিং ঐচ্ছিক করে দেওয়ার জন্যই PRO Act (প্রোটেক্টিং দ্য রাইট টু অর্গানাইজ) পাস করানোর চেষ্টা করে চলেছে সমস্ত শ্রমিক ইউনিয়ন। কর্মীদের ব্যক্তিগত মতপার্থক্যও উঠে এসেছে অ্যালাবামার ব্যর্থতার বিশ্লেষণে। পাশাপাশি দক্ষিণের রাজ্যগুলোর পারিপার্শ্বিক রাজনীতি এবং অর্থনীতিও অনেকাংশে দায়ী।

তবে ২০২১ সালেই ভাবা হয়েছিল অ্যালাবামার ব্যর্থ চেষ্টা হয়ত অন্যত্র সাফল্য এনে দেবে। যেমন কোভিড-পরবর্তী এই দুটো বছরে আমরা দেখেছি ইউরোপজুড়ে একাধিক শ্রমিক ধর্মঘট ও প্রতিবাদ অন্য মাত্রা নিয়েছে। ব্রিটেনের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব বেশ কিছু ছোটবড় প্রয়াসের সাফল্য। IWGB (ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন অফ গ্রেট ব্রিটেন) আর UVW (ইউনাইটেড ভয়েস অফ ওয়ার্ল্ড)-এর হাত ধরে, ব্রিটেনে SOAS ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন, লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সে সাফাইকর্মীরা দাবি পূরণের অধিকার পেয়েছেন, এমনকি শিক্ষাক্ষেত্রে UCU (ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড কলেজ ইউনিয়ন)-এর সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ সাফল্য পেয়েছে এই ‘গিগ ইকোনমি’-র যুগেও। তাই স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে JFK8 ওয়্যারহাউজে এই প্রথম লেবার ইউনিয়ন তৈরি হওয়া গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক।

বর্তমানে অ্যামাজনের বেশকিছু দোকান ও পরিষেবা রোবোটচালিত এবং স্বয়ংক্রিয় করা হচ্ছে। আমি জানি, আমার পাশের টেবিলের সহকর্মী দোকান-বাজারে চায় রোবোটটাকেই চায়। মানুষকে ব্যবহার করে বাতিল করে দেওয়ার দিকে যখন এক পা এক পা করে আমরা এগোচ্ছি, তখন এই লেবার ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার খবর মনে হয় পরাবাস্তব। কিন্তু আজ থেকে ১০০ বছর আগে ব্যাপারটা এতখানি বিস্ময়কর ছিল না। উডি গুথরি গান বেঁধেছেন “This land was made for you and me”; বলছেন জমির কথা, নিজস্ব মাটির কথা। টড রান্ডগ্রেন গেয়েছেন, “We’ve been so downhearted, we’ve been so forlorn” (Just One Victory), একটিমাত্র জয় চাই। তা থেকেই আমরা বাকি জয়ের রসদ পেয়ে যাব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের একশো বছরে আমেরিকায় রেলপথ ও কয়লাখনির শ্রমিকদের একের পর এক সফল ইউনিয়নভিত্তিক প্রতিবাদের ইতিহাস আছে।

সেই চিত্রনাট্য বদলাল কী করে? বদলাল সমাজের নিও-লিবেরালিজম বা নব্য উদারবাদ অভিমুখে এগিয়ে যাওয়া এবং পশ্চিমী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের অপপ্রয়োগের ফলে। নব্য উদারবাদ সার্বিকভাবে একচেটিয়া ব্যবসা এবং বেসরকারীকরণকে ত্বরান্বিত করে। আইনগতভাবেও নানাভাবে শ্রমিক ও ক্রেতার পরিবর্তে বহুজাতিক সংস্থা এবং পুঁজিপতি মালিকপক্ষের স্বার্থই রক্ষিত হয়। তার সঙ্গে অবচেতনে যুক্ত হয়েছে শ্রেষ্ঠ চাকর হয়ে ওঠার দৌড়, যা আমরা ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে দেখতে পাই। ন্যায্য ছুটি নিতে ভয় পাওয়া, ছুটি না নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আরেকটু নেকনজরে আসা এবং আরও একটু ভালো থাকতে চাওয়া এই দৌড়ের অঙ্গ।

মনে পড়ে, একসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন এক আদর্শ শ্রমিকের ধারণা তৈরি করেছিল — “স্তাখানভ, দি আইডিয়াল সোভিয়েত ওয়ার্কার”। সেই চরিত্র কর্মীদের সমাজ বা রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করত। কিন্তু নব্য উদারবাদচালিত প্রাইভেট-কর্পোরেট-বাণিজ্যিক স্বার্থ একেবারেই আলাদা। এটা অসম বন্টন চালিয়ে যাওয়ার প্রধান উপায়।

আমরা তো জেনে এসেছি, মার্কিন দেশের মানুষ নিজের ন্যায্য অধিকার এক চুল ছাড়েন না। অথচ অব্যবহৃত ছুটির পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে চমকে উঠতে হয়। কী করে ৪১ শতাংশ মানুষ, সর্বমোট ১৬৯ মিলিয়ন দিন অর্থাৎ ৫২ বিলিয়ন ডলার অর্থমূল্যের এই তথাকথিত স্বার্থ ত্যাগ করে চলেছেন?

“Last year, the number of unused vacation days in the US reached a 40-year high. Researchers at Oxford Economics hired by the US Travel Association put the numbers at about 169m days, equivalent to $52.4bn in lost benefits. The main culprit? America’s workaholic culture. It’s not that Americans do not want a vacation – it’s that they are afraid to take it.

A survey of 1,005 Americans, conducted last year by Skift, found that just 15% of Americans planned to take a real vacation in 2014. That same survey found that 33% of Americans couldn’t afford a vacation, 30% were too busy and that 22% were going to take a short vacation over a summer weekend.” (সূত্র: Skift, Opinion, Guardian & Google consumer survey)

উদ্বৃত্ত অর্থের এই পাহাড়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কী করে পাওয়া গেল ইউনিয়ন তৈরি করার পক্ষে সম্মতি? এত বছর পর স্ট্যাটেন আইল্যান্ডসের মত একটা জায়গায় রেফারেন্ডামের এই অভূতপূর্ব ফল স্বপ্নের মত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইউনিয়নের উপর যে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ কাজ করে, তা আমাদের অজানা নয়। খোঁচড়বৃত্তির আশঙ্কাও যে মনে আসে না, তা নয়। স্বস্তির প্রথম নিঃশ্বাস ফেলার পরে অনেকগুলো কাজ বাকি থাকবে। ক্রমাগত যন্ত্রমানব নিযুক্তির যুগে আকস্মিক সুসংবাদে ভেসে যেতে ভয় করে। তবু ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের এই জয় বেশ খানিকটা ভরসা দেয় আমাদের মত আরও অনেককে, যারা দেশ ছেড়ে এই বিদেশে নিরন্তর কাজ করি স্বল্প আর্থিক সহায়তায়। তবে আমরা মনে রাখতে চাই কবি অরুণ মিত্রের কথা “যখন কারো পা রাত্তিরে ডুবে থাকে/ তার মুখে কোনো সূর্য ফোটে কি?”

মতামত ব্যক্তিগত

আরও পড়ুন

দ্য উওম্যান ওয়ার্কার

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।