২০১৯ সালে অ্যামাজন প্রাইমের একটা সিরিজ দর্শক মহলে বেশ হইচই ফেলে দিয়েছিল। তখন একেই স্ট্রিমিং সার্ভিসের বাজার তুঙ্গে, তায় কন্টেন্টও ভাল। ফলে হইচইটা অস্বাভাবিক নয়। সিরিজের নাম দ্য বয়েজ, বিষয়বস্তু সুপারহিরো। এন্ডগেম পরবর্তী সুপারহিরো-স্রোত চলছে তখন। সাদা-কালো-ধূসর সবধরনের সুপারহিরোই ছোট ও বড় পর্দায় মুখ দেখাচ্ছেন। তবে দ্য বয়েজ সিরিজে মন্দ সুপারহিরোদের ছাপিয়ে ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছে তাদের নিয়ন্ত্রণকারী বহুজাতিক সংস্থাটি। সুপারহিরোরা পণ্য মাত্র, তাদের বিক্রি করতে কোম্পানি সদা তৎপর। তার জন্য আঙুল বাঁকাতে হলেও সমস্যা নেই। পণ্যের বাজারদর ধরে রাখতে রয়েছে প্রচারযন্ত্র, যখন দরকার সুপারহিরোদের মাহাত্ম্য এবং সুপারহিরোবিহীন বিশ্বের বিপদ মনে করিয়ে দেবে। কেনই বা করাবে না? বিপদের সময়ে জনতাকে উদ্ধার করতে সুপারহিরোরাই তো হাজির হন, নাকি?
এরকমই সুপারহিরো খুঁজে পেয়েছিলাম আমরা, এই বাংলাতেই, বছর সাতেক আগে। তখন ট্যাক্সির ‘দৌরাত্ম্যে’ মধ্যবিত্তের প্রাণ ওষ্ঠাগত, হলুদ-সাদা, এসি-নন এসির গোলযোগ ভীষণ। ঠিক সেই সময়েই সুপারহিরোর মত আগমন ঘটলো অ্যাপ ক্যাবের। ঝাঁ চকচকে গাড়ি, যত্নবান চালক, দ্রুত সফর এবং মোটের উপর শস্তা। সুপার ভিলেন ট্যাক্সিওয়ালাদের হাল খারাপ করার জন্য যথেষ্ট। সন্ধেবেলা টিভিতে টক শো চালু হল, কেন অ্যাপ ক্যাবই ভবিষ্যৎ। আজ যখন ভারতের গিগ ইন্ডাস্ট্রি তুমুল বিক্ষোভের সম্মুখীন, উবের ফাইলসের আঁচ ভারতে না লাগুক, পশ্চিমী দুনিয়ায় আগুন জ্বালাচ্ছে, তখন বারবার মনে পড়ে দ্য বয়েজ সিরিজের সুপারহিরো কোম্পানি ওঅট-আমেরিকানের কথা। যারা ব্যবসার স্বার্থে একেবারেই যা খুশি করতে রাজি। উবের ফাইলসে ক্যাব ব্যবসার দৈত্য উবেরের কেলেঙ্কারির প্রকাশিত রূপটা ভয়ঙ্কর, কিন্তু উবের ফাইলস বাদেও চেহারাটা নেহাত সুশ্রী নয়।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
উবের তো হঠাৎ কাঠগড়ায় উঠেছে, একেবারেই হালে, দ্য গার্ডিয়ান কাগজের রিপোর্টের দৌলতে। কিন্তু সমস্যাটা বুঝতে হলে আরও একটু গভীরে যাওয়া, অতীতের দিকে তাকানো জরুরি, নইলে উবেরকে ঠিক করে চেনা যাবে না। ২০০৮ সালে প্যারিসের এক শীতের সন্ধ্যায় ট্যাক্সি খুঁজে পাচ্ছিলেন না গ্যারেট ক্যাম্প এবং ট্রেভিস কালানিক। হন্যে হয়ে পথে পথে ঘোরার সময়েই তাঁদের মাথায় আসে এক পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনা থেকেই ২০০৯ সালে জন্ম নিল উবের। ২০১০ সালে সান ফ্রান্সিস্কোয় কেবল লাক্সারি ক্যাব হিসাবে শুরু হয় উবের। আর আজ ২০২২ সালে উবেরের রাজস্ব ১৭.৪৬ বিলিয়ন ডলার, সম্পত্তির পরিমাণ ৩৮.৭৭ বিলিয়ন ডলার। গোটা বিশ্বের ১২০০ শহর জুড়ে ছড়িয়ে এদের ক্যাব এবং ডেলিভারি ব্যবস্থা। উবেরের উল্কার মত উত্থানের গল্পটা যেন ‘আমেরিকান ড্রিম’-এর বাস্তব উপাখ্যান। কিন্তু আলোর পিছনে লুকিয়ে থাকা কালোটাকে হঠাৎ টেনে বার করেছেন মার্ক ম্যাকগান – উবেরের ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার প্রাক্তন চিফ লবিইস্ট। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার কাছে ফাঁস করে দিয়েছেন প্রায় ১,২৪,০০০ গোপন নথি। ২০১৩ থেকে ২০১৭, যে সময়ে উবের দ্রুত বৃদ্ধি পায়, ক্যাবের বাজার প্রায় গোটাটাই দখল করে ফেলে, তখনকারই নথি এগুলো।
কী বলছে উবের ফাইলস?
প্রাথমিক অভিযোগ, উবেরের ব্যবসার একটা বড় অংশই বেআইনি। অন্তত শুরুতে তাই ছিল। পরে বেআইনিকে আইনি করা হয়েছে টাকার জোরে। বহু দেশেই উবের ব্যবসা শুরু করে সে দেশের পরিবহন আইন সরাসরি লঙ্ঘন করে। যেমন অস্ট্রেলিয়া। ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ার বাজারে প্রবেশের সময় প্রয়োজনীয় লাইসেন্সই ছিল না উবেরের কাছে। ২০১৫ অবধি উবের বেআইনি ছিল গোটা অস্ট্রেলিয়াতেই। উবেরের প্রথম আইনি স্বীকৃতি মেলে ক্যানবেরায়, ২০১৫ অক্টোবরে। ততদিনে মেলবোর্ন, সিডনি উবেরের ব্যবসার জন্য দশটি বড় শহরের মধ্যে অন্যতম এবং সে ব্যবসার পুরোটাই বেআইনি। ২০১৬ সালের আগে ওই শহরগুলোতে আইনি হয়নি। আইনি করার জন্য উবেরের কর্তাব্যক্তিরা অস্ট্রেলিয়ার শাসক ও বিরোধী – দু পক্ষের সাথেই ভাব জমায়। তৎকালীন বিরোধী লেবার পার্টির পরিবহন বিষয়ক মুখপাত্র রায়ান পার্ক স্বীকারও করেছেন উবের কর্তাদের সাথে তাঁর সাক্ষাতের কথা। উপরন্তু এখন তিনি অস্বীকার করলেও উবের ফাইলসের দাবি গিগ অর্থনীতি সম্পর্কে বিল তৈরিতে উবের কর্মকর্তারা সরাসরি সাহায্য করেছিল লেবার পার্টিকে।
উবেরের রাজনৈতিক কলকাঠি নাড়া অস্ট্রেলিয়াতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ফ্রান্সের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী, বর্তমান রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রঁর সাথেও উবেরের অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি যেমন ট্যাক্স রেডের হাত থেকে বারবার উবেরকে উদ্ধার করেছেন, তেমনই তদানীন্তন সোশালিস্ট সরকারের হাত দিয়ে উবেরের স্বার্থ রক্ষার্থে বিলও পাস করিয়েছেন। মার্সেইয়ে উবের নিষিদ্ধ হবার পর তিনি বলেছিলেন “আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখছি বিষয়টা”। দুদিনের মধ্যে উঠে গিয়েছিল নিষেধাজ্ঞা। বস্তুত, ম্যাক্রঁ এবং উবেরের ফরাসি শাখা একত্রে কার্যত চুরমার করে দেয় ফরাসি ট্যাক্সি ব্যবসাকে। ফরাসি অভিধানে uberisation শব্দটা ঢুকে যায়, যার অর্থ ‘দীর্ঘ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসাকে নতুন ব্যবসার চ্যালেঞ্জ জানানো, যা একই পরিষেবা দেয় তুলনামূলক স্বল্প মূল্যে, অস্থায়ী কর্মী ব্যবহার করে’। প্রতিদানও পেয়েছিলেন ম্যাক্রঁ। উবের ফাইলস ফাঁস করা মার্ক ম্যাকগান স্বয়ং ছিলেন ২০১৭ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তাঁর অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই হয়তো এখনও ম্যাক্রঁ জোর গলায় বলে চলেছেন তিনি উবেরকে সাহায্য করে বেশ করেছিলেন। সদর্পে ঘোষণা করছেন, এরকম সাহায্য তিনি ভবিষ্যতে আবার করবেন।
২০০৪ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ইউরোপিয়ান কমিশনার পদে থাকা নিলি ক্রোয়েসের সঙ্গে উবেরের সম্পর্ক, দ্য গার্ডিয়ানের ভাষায়, ছিল ‘mega-confidential’। সেইসময় নেদারল্যান্ডসে তদন্তের সম্মুখীন হওয়া উবেরকে রক্ষা করতে সরাসরি ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটসহ আরো বেশ কিছু ক্ষমতাবান নেতা, মন্ত্রীর সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে সাহায্য করেন এই ক্রোয়েসই। উবেরের তখনকার সিইও ট্রেভিস কালানিক বৈঠকে বসেন বারাক ওবামার উপরাষ্ট্রপতি, বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের সঙ্গে। কালানিকের সাথে বাইডেনের কথোপকথনের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে উবের ফাইলসে, তাতে বেশ স্পষ্ট যে বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে রীতিমত দাবড়ানোর ক্ষমতা ছিল কালানিকের। ওবামার নির্বাচনী প্রচারাভিযানের অন্যতম দুই উপদেষ্টা জিম মেসিনা আর ডেভিড প্লুফও উবের কর্তাদের সঙ্গে নেতা-মন্ত্রী-আমলা-কূটনীতিকদের সম্পর্ক স্থাপনে সহায় হন। উবের ফাইলস বলছে ব্রিটেনের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী জর্জ অসবোর্ন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক, মন্ত্রী মাইকেল গভ, বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল, আরেক প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী সাজিদ জাভেদ – প্রত্যেকেই উবেরের সাথে গোপন বৈঠক সেরেছেন এবং সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন।
শুধু কনজারভেটিভ পার্টি নয়, উবেরের হাত ধরেছিল লেবারও। প্রাক্তন লেবার মন্ত্রী পিটার ম্যান্ডেলসন নাকি রাশিয়ায় ব্যবসা গোছানোর জন্য ক্রেমলিনের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে উবেরকে সাহায্য করেন। দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তাদের ব্যবসার জন্য ‘লবি’ বা তদ্বির করতে মোট ৭৫৮ জন শীর্ষ রাজনীতিবিদ এবং ৫৯০ জন প্রশাসকের সাথে যোগাযোগ করে উবের। ইন্টারন্যাশনাল কনসর্শিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসের মতে, এর জন্য কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই উবের প্রায় ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে ২০১৪ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে।
রাজনৈতিক নেতারা শুধু নন, শিক্ষাবিদ এবং মিডিয়াকেও উবের কিনে নিয়েছে বলে অভিযোগ। উবের ফাইলস বলছে ফ্রান্স, জার্মানির মতো দেশে লক্ষাধিক ইউরো ঘুষ দিয়ে গবেষক ও অর্থনীতিবিদদের দিয়ে গবেষণাপত্র তৈরি করিয়েছেন উবেরের লবিইস্ট ও পি আর বিশেষজ্ঞরা। সেই গবেষণার ফল ছেপেছে মিডিয়া, তার ভিত্তিতেই সরকারের উপর চাপ তৈরি করা হয়েছে উবেরকে আরও বেশি করে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য। ওইসব গবেষণাপত্রে ফল হিসাবে উঠে আসত এই, যে উবের কর্মসংস্থান বাড়াচ্ছে, তুলনামূলকভাবে অন্য পরিবহন ব্যবস্থার চেয়ে তারা বেশি কার্যকরী এবং এই সুফল ধরে রাখতে দরকার পরিবহন ব্যবস্থাকে আরও বেশি করে খোলা বাজারের হাতে তুলে দেওয়া দরকার। ফ্রান্সে এরকম রিপোর্ট তৈরি করতে প্রফেসর অগাস্টিন ল্যান্ডিয়ার নিয়েছিলেন পুরো এক লক্ষ ইউরো। ল্যান্ডিয়ারের রিপোর্ট ছেপে উবেরের ঢালাও প্রশংসা করেছিল ফাইন্যানশিয়াল টাইমস। তুলনায় জার্মান অর্থনীতিবিদ জাস্টাস হাউকাপ একই কাজ করেছিলেন বেশ শস্তায় – নিয়েছিলেন ভ্যাট বাদে মোটে আটচল্লিশ হাজার ইউরো।
স্রেফ রাজনীতিবিদ, গবেষক বা সংবাদমাধ্যমকে কিনে নিয়ে নিজেদের ব্যবসার পথ সুগম করা নয়, কালানিকের নেতৃত্বে উবেরের কিছু কীর্তি রীতিমতো মাফিয়াসুলভ। ফ্রান্স, বেলজিয়াম, স্পেনে উবের-বিরোধী প্রতিবাদ, অবস্থান ভাঙতে কালানিকের দাওয়াই ছিল উবের চালকদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া। হ্যাঁ, ইউরোপের সমস্যা মেটাতে এরকম একেবারে ‘দেশি’ উপায়ই অবলম্বন করেছিলেন উবের সিইও। আবার একইসঙ্গে কর ফাঁকি দিতে উবেরের তরফ থেকে চেষ্টা হয়েছিল কর জমা দেওয়ার দায় চালকদের উপরেই চাপিয়ে দিতে। এছাড়াও পুলিশ ও তদন্তকারী সংস্থাকে ফাঁকি দেবার জন্য ভুয়ো সাইট তৈরি বা কিল সুইচ ব্যবহার করে সিস্টেম বন্ধ করে দিয়ে তথ্য গোপন – ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে সবই করেছে উবের। অন্তত উবের ফাইলস তাই বলে। যাঁরা দ্য বয়েজ দেখেছেন, তাঁদের খুব আশ্চর্য লাগে কি? ওঅট-আমেরিকানের ছায়া তো উবেরে বেশ স্পষ্টই।
স্বাভাবিকভাবেই উবেরের কীর্তিকলাপ ফাঁস হওয়ার পর বিতর্কের ঝড় উঠেছে ইউরোপে। ফ্রান্সে উবের-বিরোধী বিক্ষোভ বহুদিন ধরেই ছিল, উবের ফাইলস সেই আগুনে ঘি ঢেলেছে। ম্যাক্রঁর গদি এমনিতেই পার্লামেন্টের নির্বাচনী ধাক্কার পরে টলমল করছে, তার উপর উবের ফাইলস উত্তাল ফরাসি রাজনীতি। বামপন্থী দলগুলো (বর্তমানে প্রধান বিরোধী শক্তি) এবং সবচেয়ে বড় ট্রেড ইউনিয়ন সিজিটি সংসদীয় তদন্তের দাবি করেছে। ইতালিতেও এমনিতেই ট্যাক্সি শ্রমিকদের বিক্ষোভ চলছিল, এখন প্রতিবাদের মাত্রা আরও বেশি। রোম, ফ্লোরেন্স, নেপলস, মিলানে চলছে উবের-বিরোধী ধর্মঘটও। নেদারল্যান্ডসে তদন্ত কমিশন গঠিত হচ্ছে, বেলজিয়ামেও তদন্ত কমিশন বসেছে। তবে বিরোধী ওয়ার্কার্স পার্টি দাবি করেছে শুধু কমিশন গঠনই নয়, উবেরকে দ্রুত নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। স্পেনের বার্সিলোনার মতই সরকার-নিয়ন্ত্রিত অ্যাপকে উবেরের পরিবর্ত হিসাবে তুলে ধরার দাবি করেছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সাংসদরা। বামশাসিত বার্সিলোনায় আগেই উবেরের পরিবর্ত হিসাবে পিকমি নামের একটি অ্যাপ চালু হয়েছে অ্যাপ-নিয়ন্ত্রিত ক্যাবগুলোকে সরাসরি সরকারের অধীনে আনার জন্য। এতে যেমন চালকদের আয় বেড়েছে, তেমনই খরচ কমেছে যাত্রীদেরও। উবের ফাইলস অনুযায়ী, ভারতেও উবেরের কীর্তি কিছু কম ছিল না। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখরের একটা গোদা বিবৃতি বাদে কোনো হইচই নেই কোথাও। ইন্ডিয়ান ফেডারেশন অফ অ্যাপ-বেসড ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স সংগঠনের তরফ থেকে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়েছে বটে, তবে তার শুনানি এখনো শুরু হয়নি।
উবেরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কালানিক ২০১৭ অবধি সিইও ছিলেন। উবের ফাইলসকে কেন্দ্র করে যত অভিযোগ, অভিযোগকারীদের মতে তার বেশিরভাগের দায়ই কালানিকের। স্বাভাবিক নিয়মেই কালানিকও অস্বীকার করেছেন সমস্ত অভিযোগ, বলেছেন উবেরের ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীরা উস্কেছেন সাংবাদিকদের। এসব নথি ভুয়ো, তিনি এসব কিছুই করেননি। কিন্তু উবেরের তরফে দেওয়া বিবৃতি বেশ চমকপ্রদ। জিল হ্যাজেলবেকার, উবেরের পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, বলেছেন তাঁরা ২০১৭ সালের আগে ঘটা অন্যায়গুলো অস্বীকার করছেন না। তাঁরা যে দ্রুত লাভের আশায় বহু অন্যায় করেছেন তা তাঁরা স্বীকার করছেন এবং তার জন্য অনুতপ্ত। উল্লেখ্য, একাধিক বিতর্কের মধ্যে কালানিক ২০১৭ সালেই সিইও পদ ছাড়তে বাধ্য হন, তাঁর জায়গায় আসেন দারা খসরুশাহী। উবেরের দাবি, গত কয়েক বছরে তারা নিজেদের আমূল বদলে ফেলেছে খসরুশাহীর নেতৃত্বে।
“We have not and will not make excuses for past behaviour that is clearly not in line with our present values. Instead, we ask the public to judge us by what we’ve done over the last five years and what we will do in the years to come,” বলছেন হ্যাজেলবেকার। বক্তব্যটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ উবের শুধু অপরাধ স্বীকার করছে না, তার দায় চাপিয়ে দিচ্ছে প্রাক্তন সিইওর ঘাড়ে। নতুন মুখের আড়ালে চেষ্টা করে চলেছে নিজেদের আবার তুলে ধরার। দায় অবশ্য অত সহজে এড়ানো যায় না। উবের ইটস (উবেরের খাবার ডেলিভারি শাখা)-এর বর্তমান অধিকর্তা এবং কোম্পানির এগারো সদস্যের এক্সিকিউটিভ টিমের অন্যতম পিয়ের দিমিত্রি গোর-কটির (সে সময়ে পশ্চিম ইউরোপে উবেরের প্রধান) বিরুদ্ধেও কিল সুইচ ব্যবহার করে তথ্য গোপনের অভিযোগ উঠে গেছে।
উবেরকে ঘিরে এত ক্ষোভ-বিক্ষোভ-প্রতিবাদের মাঝে একটা কথা কিন্তু মনে রাখা জরুরি। এই ‘উবের ফাইলস’ এবং এই ধরণের অপরাধগুলো আসলে অসুখ নয়, রোগের উপসর্গমাত্র। মূল ব্যারাম হল এই ব্যবসায়িক মডেলটাই। উবেরের ব্যবসা শুরু হয় লগ্নি পুঁজির সাহায্যে। দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে বাজার দখল করা তাই উবেরের পক্ষে বাধ্যতামূলক। নয়তো স্বল্প মেয়াদেই লগ্নিকারীদের হাতে মুনাফা তুলে দেওয়া যেত না। আবার এই লগ্নি পুঁজিই উবেরকে ক্ষমতা দেয় বাজার দখলের। বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি জুগিয়ে সাধারণ ট্যাক্সিচালক এবং সওয়ারী – দু পক্ষকেই ভাঙিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল উবের। কোনো জায়গায় ট্যাক্সি শিল্প ভেঙে পড়লে সেখানে উবেরের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে ওঠা খুবই স্বাভাবিক। তারপর ভর্তুকি ফিরে আসবে বহুগুণ মুনাফা হয়ে – এই ছিল উবেরের পরিচালকদের ভাবনা। বলা বাহুল্য, এই ব্যবসায়িক মডেল বহু দেশেই বেআইনি। তেমনই উবেরের মূল ভিত্তি যে গিগ ইন্ডাস্ট্রি, তাও আইনসিদ্ধ নয় বহু জায়গায়। গিগ ইন্ডাস্ট্রিতে স্থায়ী কর্মীর বদলে থাকে অস্থায়ী, চুক্তিভিত্তিক কর্মী। উবের, ওলা, অ্যামাজন, র্যাপিডোর মত অ্যাপ যাদের নাম দিয়েছে পার্টনার বা কন্ট্রাক্টর। এরা যেহেতু সরাসরি কোম্পানির কর্মচারী নয়, তাই এদের কোনো নির্দিষ্ট বেতন নেই, নেই নির্দিষ্ট কাজের সময়, নেই ছুটি, নেই সামাজিক সুরক্ষা। কোম্পানির মুনাফার রাস্তা তাই পরিষ্কার। আবার গিগ শ্রমিকরা যেহেতু বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় কর্মরত, একে অপরের সংস্পর্শে আসেন খুব কম ক্ষেত্রেই, তাই সাধারণত এঁরা সংগঠিতও নন। অতএব কোম্পানির বিরুদ্ধে শ্রমিক বিক্ষোভের সম্ভাবনাও কম।
বলা বাহুল্য, এভাবে পুরোপুরি অস্থায়ী কর্মী নির্ভর মডেল নিষিদ্ধ বহু দেশে। আর তাই সেসব দেশে উবের হয় সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে ব্যবসা চালিয়ে গেছে, নয়ত রাজনীতিবিদ ও প্রশাসকদের সাথে গোপন যোগসাজশের মাধ্যমে চেষ্টা করেছে শ্রম আইনের নিয়ন্ত্রণ আলগা করতে, বা একেবারে নতুন শ্রম আইন আনাতে। অস্ট্রেলিয়ার মত দেশে উবের সফল হয়েছে। আবার চীনে সরকার লগ্নি পুঁজি ও গিগ অর্থনীতির উপর খড়গহস্ত হওয়ায় হাত গোটাতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু চেষ্টা চালিয়েছে সব দেশেই। উবের ফাইলসে বর্ণিত প্রত্যেকটি কুকীর্তির উৎসই হল এই গিগ অর্থনীতি এবং লগ্নি পুঁজি নির্ভরতা। তাই যতই ‘উবের ফাইলস’ ২০১৭ সালে শেষ হোক, ২০২২ সালে এইসব অনৈতিক কার্যকলাপ যে থেমে গেছে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
ভারতেও উবেরের মতো অ্যাপভিত্তিক ক্যাব কোম্পানিগুলোকে নিয়ে সমস্যা লেগেই আছে। প্রাথমিক সমস্যা অবশ্যই কর্মীদের স্বীকৃতির। ভারতে গিগ শ্রমিকদের ‘শ্রমিক’ স্বীকৃতি নেই, তাই শ্রমিকের প্রাপ্য সুযোগসুবিধাও নেই। তৃতীয় বিশ্বের আর পাঁচটা দেশের মতই ভারতে শ্রম শস্তা, কাজের তুলনায় প্রার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। অতএব গিগ শ্রমিকদের কাজের নিশ্চয়তা আরও কম। বস্তুত, ভারতে গিগ শ্রমিক হওয়ার অর্থ হল উপরওয়ালার উপর ভরসা করে অবিরাম খেটে যাওয়া এবং মনে করা, খাটনির ফল একদিন পাওয়া যাবে। ভারতের গিগ শ্রমিকরা এখনো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অসংগঠিত। ফলে তাঁদের অধিকার আদায়ের পথ আরও কঠিন। উবের ও অন্যান্য ক্যাব কোম্পানির চালকদের নিয়ে কলকাতায় সিআইটিইউর নেতৃত্বে একটা শ্রমিক ইউনিয়ন গঠিত হয়েছে কিছুদিন আগে। পার্টনারের বদলে স্থায়ী শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতির দাবি ছাড়াও তাদের বাকি দাবিগুলোর মধ্যে প্রধান হল:
১. একতরফা চালকদের আইডি বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। বন্ধ আইডি খুলতে হবে।
২. দু চাকা ও চার চাকার জন্য ভাড়া নির্দিষ্ট করতে হবে।
৩. কোম্পানির কমিশন নিয়ন্ত্রণ করে ২০ শতাংশের মধ্যে আটকাতে হবে।
৪. মাসিক বোনাসের ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. মহিলা চালকদের সুরক্ষা ও বিশেষ বোনাসের ব্যবস্থা করতে হবে।
৬. ক্যাবগুলোকে দ্রুত কমার্শিয়াল লাইসেন্স দিতে হবে।
৭. নতুন এগ্রিগেটর আইন দ্রুত চালু করতে হবে।
এই দাবিগুলোর মধ্যে ১ ও ৭-এর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করি।
উবের এবং অন্যান্য ক্যাব কোম্পানি একতরফা বহু চালকের আইডি বন্ধ করে দেয়, স্রেফ যাত্রীদের অভিযোগের ভিত্তিতে। ড্রাইভার আইডি একবার বন্ধ হওয়া মানে চাকরি খোয়ানো। ফের ওই ক্যাব কোম্পানিতে আর গাড়ি চালাতে পারবেন না ওই ব্যক্তি। কর্মহীন যুবক-যুবতীর সংখ্যা এ দেশে এত বেশি যে এরকম যখন খুশি যাকে খুশি বসিয়ে দিতে পারে ক্যাব কোম্পানিগুলো। পেশা হারানো ব্যক্তির প্রতিবাদ করার কোনো উপায় থাকে না। এক্ষেত্রে কিন্তু সমস্যাটা একেবারেই দেশীয়। ভারতে রেকর্ড পরিমাণ বেকারত্বই উবেরের এই ‘হায়ার এন্ড ফায়ার’ মডেলকে বাঁচিয়ে রাখছে।
সপ্তম তথা শেষ দাবির গুরুত্ব সর্বাধিক। নতুন এগ্রিগেটর আইন আসলে ক্যাব অপারেটর সংস্থাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার আইন, যা চালু করার ব্যাপারে বেশ কয়েকবার আলোচনা হয়েছিল পরিবহন কর্তৃপক্ষ, শ্রমিক ইউনিয়ন এবং কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের মধ্যে। এই আইন অনুযায়ী কিছু সামাজিক সুরক্ষা প্রাপ্য হয় ক্যাবচালকদের। আলোচনা অনেক আগে হয়ে গেলেও এখনো সরকার এই বিধি চালু করার ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য করছে না। কেন? কাদের স্বার্থে? উবের ফাইলস ফাঁস হওয়ার পরে প্রশ্ন উঠতে কিন্তু বাধ্য।
গিগ অর্থনীতি, এক অর্থে দেখলে, ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদের যুগকে মনে করায়। দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে শ্রমিকশ্রেণি যে ন্যূনতম অধিকার অর্জন করেছিল, গিগ শ্রমিকরা তার কিছুমাত্র পায় না। সামাজিক সুরক্ষার যে বেড়াজাল তৈরি হয়েছিল, প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে বৃহৎ পুঁজি এখন তাকে সহজেই অতিক্রম করতে পারছে, গিলে নিতে পারছে ছোট পুঁজিকেও। আবার শ্রমিকশ্রেণিকে অসংগঠিত রেখে পুঁজির পথের কাঁটাও উপড়ে ফেলা হয়েছে সহজেই। প্রযুক্তি যেন সময়ের চাকা ঘুরিয়ে আবার অতীতে নিয়ে ফেলেছে শ্রমিক-মালিক সম্পর্ককে। তাই এই অস্থায়ী কর্মীনির্ভর কর্পোরেট দৈত্যরা আজ শ্রমিক আন্দোলনের কাছে এক বিশাল চ্যালেঞ্জ।
আরো পড়ুন অ্যামাজন লেবার ইউনিয়ন তৈরি যুগপৎ ঐতিহাসিক ও অবিশ্বাস্য
তবু আশার কথা, বিভিন্ন দেশেই গিগ শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হচ্ছেন ধীরে ধীরে। শ্রমিকদের প্রকৃত স্বীকৃতি ও অধিকারের দাবি উঠছে। ২০২১ ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টের রায় এক্ষেত্রে এক মাইলফলক। কোর্ট সর্বসম্মতিক্রমে রায় দিয়েছে, উবেরের শ্রমিকরা শ্রমিকই, স্বাধীন কন্ট্রাক্টর নয়। শ্রমিক হিসাবেই তারা সামাজিক সুরক্ষা ও অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার অধিকারী। এই রায় সরাসরি গিগ অর্থনীতির মূলে কুঠারাঘাত। সরকার এই রায় প্রয়োগ করলে উবের বাধ্য হবে আর পাঁচটা সাধারণ কোম্পানির মতই কর্মীদের অধিকারকে স্বীকার করতে। একইরকম নিয়ম বলবৎ হবে অন্য গিগ শ্রমিক নির্ভর কর্পোরেটগুলোর উপরেও। দুঃখের কথা, এমন রায় বিশ্বের প্রায় অন্য কোনো দেশেই দেওয়া হয়নি। তাই গিগ শ্রমিকদের জন্য রয়েছে কেবল ‘কন্ট্রাক্টর’ বা ‘পার্টনার’ জাতীয় গালভরা নাম এবং একরাশ বঞ্চনা।
তথ্যসূত্র:
https://www.supremecourt.uk/cases/uksc-2019-0029.html
https://www.brusselstimes.com/253617/belgiums-workers-party-wants-uber-out
https://www.icij.org/investigations/uber-files/uber-tax-havens-dodge-drivers/
https://www.theguardian.com/news/series/uber-files
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।