গত ১২ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের অনেক বড় ক্ষতি করে ফেলেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িকতার নিবিড় চাষ হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হচ্ছে। সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম পুনঃপ্রবর্তন করা হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা এখন ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে এবং তার শেকড় অনেক গভীরে। আওয়ামী লীগ সরকার গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে,অনেক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে। দেশে একটি কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করেছে। রাজনৈতিক শক্তি, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এখন চরমভাবে আক্রান্ত। সামাজিক শক্তি বলে আর কিছুই নেই। মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে আওয়ামী লীগ তার বংশবদ করে তুলেছে।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে তৈরি করা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, গত নয় বছরে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ৩,৬৭৯টি হামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১,৫৫৯টি বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা। এই সময়ে হিন্দুদের ৪৪২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেয়া হয়েছে। প্রতিমা, পূজামণ্ডপ, মন্দিরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ১,৬৭৮টি। এসব হামলায় আহত হয়েছেন ৮৬২ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। নিহত হয়েছেন ১১ জন। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
এবারের দুর্গাপূজার শেষ তিন দিনে সারা দেশে কমপক্ষে ৭০টি পূজামণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এসব হামলায় কমপক্ষে চার জন নিহত, কমপক্ষে ৭০ জন আহত, ৩০টি বাড়ি এবং ৫০টি দোকান ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।
প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও হিন্দুদের মন্দিরে কিংবা বসতবাড়িতে হামলা হচ্ছে। কিন্তু হামলা ঠেকাতে সরকার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করছে না কেন? মানুষের ভোট ছাড়াই বছরের পর বছর ক্ষমতায় টিকে রয়েছে যে সরকার এবং যাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মত শক্তিশালী বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি এখন দেখা যাচ্ছে না, সেই ‘মহা শক্তিধর’ সরকার সাম্প্রদায়িক হামলা ঠেকাতে পারছে না কেন? সরকারের বাহাদুরি কোথায় গেল? তাহলে কি সরকারই চাইছে হামলা হোক?
সাম্প্রদায়িক হামলা হলে রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ লাভবান হয়। “বিএনপি-জামাতের ষড়যন্ত্র” বলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি-কে কোণঠাসা করার সুযোগ পায় আওয়ামী লীগ। এবারও আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামাতের ষড়যন্ত্রের কথা বলছে। আওয়ামী লীগের কথা যদি সত্য বলে ধরে নিই, তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় — যে সরকারের দাপটে বিএনপি আজ কার্যত ‘গৃহবন্দী’, সেই ‘মহাশক্তিধর’ সরকার বিএনপি-জামাতের ষড়যন্ত্র ঠেকাতে পারে না কেন?
আওয়ামী লীগ গাছেরটা খাবে, তলারটাও কুড়াবে! সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা যত বাড়বে, সংখ্যালঘুসহ দেশের মানুষের একটা অংশ ততই আওয়ামী লীগকে আঁকড়ে ধরবে। এই হিসাবটা আওয়ামী লীগ ভালই বোঝে। হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হবে, তার ফসলও শেষ বিচারে আওয়ামী লীগের ঘরেই যাবে।
আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক স্বার্থে সংখ্যালঘুদের বারে বারে বলির পাঁঠা বানায়। সংখ্যালঘুদের বিপন্নতাকে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগ তার রাজনীতিকে পুষ্ট করে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশে এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে — এমন জুজুর ভয় দেখিয়ে আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের বশ করে। ‘ভয়ংকর’ ভবিষ্যতের কথা কল্পনা করে সংখ্যালঘুরা শঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং আওয়ামী লীগকেই তার শর্তহীন ভালবাসা উজাড় করে দেয়। কিন্তু বর্তমান অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতার কথা ভুলেও চিন্তা করে না। সব কিছু উজাড় করে দেয়া সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, অধিকারের কথা আওয়ামী লীগের চিন্তা করার দায় নেই। সংখ্যালঘুদের বোধহীন, প্রতিবাদহীন করে তুলতে আওয়ামী লীগ শতভাগ সফল।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে — কে কাকে নিয়ে খেলছে? আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক স্বার্থে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে নিয়ে খেলছে, নাকি সাম্প্রদায়িক শক্তি আওয়ামী লীগকে নিয়ে খেলছে? রাজনৈতিক সুবিধা, কৌশলগত ঐক্য — এসবের চেয়েও বড় সত্য হচ্ছে, আওয়ামী লীগ দলটা ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়িক দলে পরিণত হচ্ছে। অতীতের মতো আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এবারের সাম্প্রদায়িক হামলাতেও অংশ নিয়েছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে সাম্প্রদায়িক শক্তিরও বেশ সুবিধা! মুক্তিযুদ্ধকে ঢাল হিসাবে তুলে ধরে আওয়ামী লীগ মানুষকে বশ করে রাখবে, আর অন্যদিকে সাম্প্রদায়িকতার অবাধ চাষ চলবে। বর্তমান গণতন্ত্রহীনতার সময়ে তো সাম্প্রদায়িক শক্তির বোনাস সুবিধা!
এই যে সাম্প্রদায়িক হামলা চলছে, তার পেছনে রাজনীতি আছে। সেই রাজনীতিটা বোঝা দরকার। রাজনীতির হিসাবটা সহজ আবার গোলমেলেও বটে। বাংলাদেশে হিন্দুদের পূজামণ্ডপ, বসতবাড়ি আক্রান্ত হচ্ছে, আর ভারতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি লাভের হিসাব কষছে। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা তথা বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলার কারণে নাকি বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের শান্তিপুর উপনির্বাচনে তিন গুণ বেশি ভোটে জিতবে! ত্রিপুরার আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির পরাজয় ঠেকাতে ত্রিপুরা-সংলগ্ন কুমিল্লায় পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব চালানো হয়েছে বলে কেউ কেউ যে ব্যাখ্যা করছেন, তাকে কি আর কোনোভাবেই উড়িয়ে দেয়া যাবে? মোদি সরকারের সঙ্গে হাসিনা সরকারের বিশেষ বন্ধুত্বের কথা সবাই জানে। পশ্চিমবঙ্গের বিগত বিধানসভা নির্বাচনের আগে মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোটের জন্য নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশে নির্বাচনী সফরের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল হাসিনা সরকার।
কেউ কেউ বলছেন, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পুরোপুরি নিজেদের পক্ষে বা নিয়ন্ত্রণে এনে প্রতিপক্ষ বিএনপিকে বিপর্যস্ত করার যে পরিকল্পনা ধরে আওয়ামী লীগ এগোচ্ছে, তারই অংশ হিসাবে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চলছে। এবারের হামলা তারই ধারাবাহিকতা। শুধু জাতীয় রাজনীতিই নয়, স্থানীয় রাজনীতিরও নানা হিসাব-নিকাশের নিদারুণ শিকার সংখ্যালঘুরা।
সাম্প্রদায়িকতা মানুষের বোধ-বিবেক-মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে দেয়। বিপ্লবী আন্দোলনে সাম্প্রদায়িকতা এক বড় বাধা। মতাদর্শিক লড়াই তীব্র করে সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটাতে হবে। সাম্প্রদায়িকতার কারণে শ্রেণিচেতনা হারিয়ে যায়। সাম্প্রদায়িকতা রুখতে শ্রেণিচেতনাকে শাণিত করে তীব্র শ্রেণিসংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর বিশ্ব রাজনীতির চেহারাটা বদলে গেছে। সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের একটা যোগসূত্র আছে। সাম্প্রদায়িকতাকে পুষ্ট করছে সাম্রাজ্যবাদ। তাই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইকে বাদ দিয়ে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লড়াইকে অগ্রসর করা যাবে না।
সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িক শক্তির পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধেও লড়াই তীব্র করতে হবে। সরকারের ব্যর্থতা, নিষ্ক্রিয়তা, মদতের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হলে, সাম্প্রদায়িক হামলা চলতেই থাকবে। আওয়ামী লীগের ওপর ভর করে যাঁরা ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ’ গড়তে চান, তাঁরা নিঃসন্দেহে মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। মুক্তিযুদ্ধের পুনর্জাগরণ ঘটানোর ক্ষেত্রে বিএনপি তো বটেই, আওয়ামী লীগও বাধা। “বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ” বলে বাঙলার মধ্যবিত্তের যে অহংকার, তার বিপরীতেই আওয়ামী লীগের অবস্থান।
গণতন্ত্র ছাড়া অসাম্প্রদায়িকতা হয় না। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকারকে হঠাতেই হবে। তাই বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির উত্থান এখন খুবই জরুরি।
নিবন্ধকার বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য। মতামত ব্যক্তিগত।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।