নীচের ছবিটি দেখুন। এবং লেখাটি পড়ুন। এবং, ছবিটি দেখুন। লেখাটিও পড়ুন ঘুরে ফিরে।

This slideshow requires JavaScript.

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

কলকাতা পুলিশের নতুন প্রস্তাব: শহর থেকে ২৪টি ট্রাম রুট হাপিস করে দেওয়া হবে চিরতরে। এ অবশ্য নতুন কোনো ঘটনা নয়, সরকারি মুকুটে নতুনতম পালক মাত্র। ট্রাম বেপাত্তা করে দেওয়ার এই মহান সাধনায় তাঁরা বহুকাল ধরেই একনিষ্ঠভাবে ব্রতী। যেমন ধরুন, তথ্য বলছে, ২০১৪-১৫ সময়টায় শহরে চলত ১২৭টি ট্রাম, রুট ছিল ৫৬টি, আর সব মিলিয়ে ৭১ কিলোমিটার ট্রাম রুট বরাদ্দ ছিল কলকাতার রাস্তায়। কী রকম প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা দেখুন, তার তিন বছরের মাথায় শহরে চলছিল ৪১টি ট্রাম, মানে তিন ভাগেরও এক ভাগ, রুট হয়ে গেল সাকুল্যে ২০টি, আর ট্রামপথ গিয়ে ঠেকল মোটে ২৮ কিলোমিটারে। আর ২০১৮-১৯ সালের সর্বশেষ তথ্য বলছে: কলকাতায় এখনকার ট্রামসংখ্যা আরও সাতটি কমে ৩৫-এ এসে দাঁড়িয়েছে, রুট সাতটা, আর সর্বমোট ট্রামপথ ঠেকেছে সবেধন ১৯ কিলোমিটারে। আজ যখন এই লেখা লিখছি, তখন রুট আরও একটি কমে ছটিতে পর্যবসিত। বলুন তো, প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা ছাড়া কী-ই বা বলা চলে একে?

অবশ্য, নির্যাতনের আরও কিছু বাকি ছিল, এর পরেও। তথ্য দেখলে মনে হয়, ট্রামকে ভেতর থেকে ধসিয়ে দেওয়া হয়েছে, এবং, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই। ধরুন না, ২০১৩-র সাড়ে ছ হাজার কর্মীর ভার ছাঁটতে ছাঁটতে ২০১৮-র ট্রাম এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩৭০০ কর্মীতে। ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের গ্রাসাচ্ছাদন যে কীভাবে হয়, এ বিষয়ে আমাদের মাথা ঘামিয়ে কী-ই বা লাভ? ধরুন, তারপর, ২০১২ নাগাদও, কিছু না হোক, অন্তত ৭০ হাজার মানুষ ট্রামে চড়তেন ফি-দিন। আবার বলছি, প্রতিদিন। তার ঠিক দু বছর পর গড় অনুপাত কমে এল ৪৫ আর ৫০ হাজারের মাঝামাঝি। বেশ। ২০১৭-য় সেই সংখ্যা আরও খানিক কমল — এবার অধোগামী হতে হতে ছুঁয়ে ফেলল বিশ হাজারের মাত্রা। আর, ২০১৮? ১৫ হাজারের গণ্ডি টপকে, কর্তৃপক্ষের চমৎকার বদান্যতায় অধঃপাতের নতুন রেকর্ড গড়ল ট্রামের দৈনিক যাত্রীসংখ্যা। ২০১২-র ৭৫ হাজার ধুঁকতে ধুঁকতে ছ বছরে নেমে এল ১৫ হাজারেরও কমে।

চমকপ্রদ। এবং, মজাদারও।

তারপর ধরা যাক সরকারের তরফে বার্ষিক বিনিয়োগের কথা। এই সারণী খুঁড়লেও আশ্চর্য সব চমক মিলবে। ২০১১ সালে যে সরকারি বিনিয়োগ ছিল সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার আশেপাশে, ২০১৩-তেও যা তিন কোটি, এমন কী, ২০১৭-তেও যা ১.৩ কোটি বজায় রাখতে পেরেছে — ২০১৮ সালে, সেখানে, আদৌ কোনও টাকাই বরাদ্দ হয়নি! আবার ধীরে ধীরে বলি: ট্রামের পেছনে বরাদ্দ হয়নি একটি টাকাও।

চমকের অবশ্য শেষ হয় না। ২০২০ সালে উড়ালপুল বিশেষজ্ঞ কমিটি সরকারের পরিবহণ মন্ত্রকের কাছে সুপারিশ জানাল — শহরের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ব্রিজ: শেয়ালদা, কালীঘাট এবং অরবিন্দ সেতু থেকে ট্রামপথ লোপাট করে দেওয়া হোক৷ কর্তৃপক্ষ সানন্দে মেনেও নিয়েছেন বোধ হয় সেসব। অন্তত, বিরোধিতাটুকুর কোনো হদিশ আমরা পাই না। কী বিচিত্র দেখুন, ট্রাম-উৎসাহীরা ২০১৯ থেকে লাগাতার, বড়বাবুদের তিনটি বাছাই করা মন্ত্রণালয়: কেএমডিএ, কলকাতা পুলিশ এবং পরিবহণ দফতরকে আর্জি জানিয়ে গেছে, আর কিছু না পারুন, শহরের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রুটে আবার ট্রাম ফেরানো হোক অনতিবিলম্বে। এই তিনটে রুট আমাদের চেনা। এসপ্ল্যানেড-টালিগঞ্জ, এসপ্ল্যানেড-বিধাননগর এবং এসপ্ল্যানেড-বেলগাছিয়া। না, শীতলহৃদয় মন্ত্রকগুলিতে চিঁড়ে ভেজেনি এর পরেও। বরং, পরম উৎসাহে পরিবহণ নিগমের কাছে শ্রীযুক্ত কলকাতা পুলিশ সুপারিশ করেছে, এক-আধটা নয়, সম্ভব হলে ২৪টা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ট্রামের শেষ চিহ্নটুকুও উপড়ে ফেলা হোক। এইসব প্রস্তাবিত জায়গার মধ্যে রয়েছে, এমন কী, হাস্যকরভাবে শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়, বিধান সরণি, গ্যালিফ স্ট্রিট, এজেসি বোস রোড, আমহার্স্ট স্ট্রিট আর মহাত্মা গাঁধী রোডের মত গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্কও। আমফান ঝড়ের পর বীভৎস ক্ষয়ক্ষতির নমুনা দেখিয়ে, খিদিরপুর আর ময়দানের মধ্যবর্তী রুট যেখানে ৩৬ নম্বর ট্রাম চলত — আজ দেড় বছর হয়ে গেল, বেবাক বন্ধ রাখা হয়েছে। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ নাগাড়ে সরকারকে বলে চলেছেন খোলার জন্য, কিন্তু নানাবিধ ব্যস্ততায় বোধহয় কলকাতা পুরসভা এ সব ছাইপাঁশ শোনার সময় পান না। ট্রাম-দরদী তাঁরা কলকাতার মানচিত্রে নিভে আসা এক-এক জন সংখ্যালঘু।

‘কালাপাহাড়ি’ কাজকর্ম ঠিক কাকে বলে, আমরা জানি না। কিন্তু এর চেয়ে বড় কালাপাহাড়ি ধৃষ্টতা ও দুঃসাহস, বোধহয়, পৃথিবীর কোনও দেশে প্রত্যাশাও করা যায় না। যে ট্রাম কলকাতার অনিবার্য স্মারক, এবং ঘটমান সময়ের চিহ্ন দিয়ে এসেছে আজ এতগুলি বছর — তাকেই লাটে তুলে দিচ্ছেন বড়বাবুরা। মনে রাখা ভাল, ১৮৭৩ সালে কলকাতায় প্রথম ট্রাম চলেছিল, এবং সম্ভবত এশিয়াতেও প্রথম। ১৮৮০-তে কলকাতা ট্রামওয়েজ কর্পোরেশনের স্থাপনা। আর, বিশ শতাব্দীর গোড়ায়, আজ থেকে ঠিক ১২০ বছর আগে, ১৯০২ সালে শহরে চলল প্রথম বিজলিবাতির ট্রাম। এই আশ্চর্য সম্ভ্রান্ত ঐতিহ্যের পরেও, নির্বিচারে, টুঁ শব্দটি না করে ট্রামকে খুন করে ফেলা যায় এবং শহরবাসী চুপ থেকে মৃদু সম্মতিও জানান সেই প্রক্রিয়ায়।

চমৎকার। এবং, প্রত্যাশিতও বটে।

কেবল, এ সব সমাধা করে ফেলার আগে, মাথায় রাখবেন ট্রামের উপকারী দিকগুলোও, নিদেন — ভবিষ্যতের অবিচুয়ারির স্বার্থে। মাথায় রাখা ভাল, আজকের সময়ে যখন তীব্র ডিজেলগন্ধী ধোঁয়ায় কাশতে আর হাঁপ টানতে টানতে দিল্লিতে ফরমান জারি করতে হয় — ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তায় বরদাস্ত করা হবে না আর, সেই সময়ে কার্বনবিহীন ও পরিবেশবন্ধু ট্রামের গুরুত্ব ঠিক কতখানি। কলকাতার দুর্ঘটনা-সংকুল রাস্তায়, যেখানে মানুষ হুমড়ি খায় আর আছাড় খায় এগোতে পিছোতে, সেখানে ট্রাম একটি জাতির সম্পদ হতে পারত, দুর্ভাগ্যবশত, তা হয়ে উঠল না কখনো। প্রশ্ন আরও। ট্রামে কারা ওঠেন? কত টাকা টিকিট একটি ট্রামযাত্রার? স্বাস্থ্যকর আবহে, মাত্র ১০ টাকার (তা-ও সেটা করোনা-পরবর্তী সময়ে) বিনিময়ে, কলেজ স্ট্রিট থেকে শ্যামবাজার যাওয়া যায়। পকেটবান্ধব তো বটেই, সব থেকে বড় কথা, বহু প্রবীণ এবং মহিলা ট্রাম চড়েই যাতায়াত করেন। স্কুলজীবনের অভিজ্ঞতায় দেখা, উত্তর কলকাতার দীর্ঘ ওয়ান ওয়ে একমুখী রুটে, ট্রাম ছাড়া স্কুলছাত্রদের কোনো সম্বলও ছিল না। সম্ভবত এখনো নেই।

তাতে অবশ্য আমাদের কিছুই বিশেষ আসবে এবং যাবে না। এই উপকারের তালিকা আরও বর্ধিত করে চলা যায়। যেমন, ভাবুন না, একটি বাসে গাদাগাদি করেও ঠিক কতজন যাত্রী যেতে পারেন? মামুলি কাণ্ডজ্ঞানেও, ট্রামের নিতান্ত একটি সফর তাকে পাঁচ গোল দেওয়ার ক্ষমতা রাখে বিনা আয়াসে। এ রকম আশ্চর্য সাস্টেনেবল ও পরিবেশবান্ধব, ট্রাফিকবান্ধব, যাত্রীবান্ধব পরিবহণব্যবস্থা, কী সুচারু ধ্বংসের মুখোমুখি চলেছে প্রতিনিয়ত। আর, মৌনী কলকাতা, অখণ্ড নীরবতায় দেখে রাখছে সেসব।

আমার ধারণা, কলকাতা শহরের আধিকারিকবৃন্দ যে ভণ্ডামির নজির রেখেছেন এ বিষয়ে, তা তুলনারহিত। এই দেখুন না, ২০১৯ সালের ১২ অক্টোবর কোপেনহেগেন শহরে আহূত ৪০ মেয়রের সমাবেশে ফিরহাদ হাকিমের সগর্ব উক্তি: আগামী ১১ বছরের মধ্যে নাকি কলকাতায় দেখা দেবে ঝাঁ চকচকে ইলেকট্রিক ট্রাম। পরিবেশবান্ধব ট্রামের সহায়তায় মুড়ে দেওয়া হবে সমস্ত কলকাতা। তেত্রিশ বছর না যাক, কারুর কথা না-রাখা প্রমাণ করতে তেত্রিশ মাসই যথেষ্ট। মাননীয় মেয়রের দিব্যদৃষ্টির ঠিক দু বছর পেরিয়ে এসে কলকাতা পুলিশের বিচিত্র বোধোদয়: ২৪টি অকুস্থল থেকে, অবশেষে একটু একটু করে লোপাট করে দেওয়া হবে কলকাতা ট্রামের শেষতম চিহ্ন।

চমকপ্রদ। এবং, বিশ্বাস্যও বটে।

কাছাকাছি দৃষ্টান্ত হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার তরফে মেলবোর্ন ট্রামের আশ্চর্য রক্ষণাবেক্ষণ এবং ও-শহরের বিপুল ট্রাম-সচলতার উদাহরণ, নাহয় থাক আজ। জানা যাচ্ছে, ইংল্যান্ডের ট্রামকেন্দ্রিক নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ‘ওয়াটট্রেন’-এর অ্যান্ড্রু গিলসের মত সমঝদাররা কলকাতা পুলিশের এই প্রস্তাব শুনে যৎপরোনাস্তি ক্ষুণ্ণ, ক্ষুব্ধও বটেন। কিন্তু, আবিশ্ব ট্রামপ্রেমিকদের এ হেন অসন্তোষ মেটাতে সরকার এখনো স্পষ্টভাবে কিছু করেনি। সম্ভবত, কখনো করবেও না, কারণ ট্রাম ভোট দেয় না, আর মুখ্যমন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীও নির্বাচিত করে না। এই লজ্জা তামাম কলকাতার সম্বল হয়ে থেকে যাবে। এবং, আজ যতই পরিবহণ নিগম লিখিত ভাবে ‘না’ বলুক না কেন — শতাব্দীপ্রাচীন ট্রামের একটি একটি করে রুট কলকাতার গা থেকে, বাহুল্যময় গয়নার মত, খসিয়ে ফেলা হবে এক-এক করে।

এভাবেই, দিনের আলোয়, আস্তে আস্তে, ট্রামকে হত্যা করে ফেলা হবে। মনে রাখবেন, ইচ্ছাকৃত প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা। আর অদূরে, কলকাতা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে — এবং, মুচকি হাসবে।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

1 মন্তব্য

  1. Article on Kolkata tram by Simul Sen is simple fantastic.Very bold yet literal and contemporary relevant article. The people of Kolkata should be ashamed of their silence and watching the death of tram without a single word of protest.

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.