ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হলেন ঋষি সুনক। কতটা বদলাবে ব্রিটেনের অর্থনীতি? সুবিধা হবে আমজনতার? ভারতের কি আদৌ কোনো লাভ হবে? নাগরিক ডট নেটের সঙ্গে খোলামেলা কথা বললেন শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক শুভাশীষ মোদক চৌধুরি

ঋষি সুনক ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হলেন। এই ঘটনার কি কোনো বিশেষ তাৎপর্য আছে?

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এই প্রশ্নটাকে অনেকভাবেই দেখা যায়। সার্বিকভাবে আমি খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করছি। অবশেষে ব্রিটেন এমন একজন প্রধানমন্ত্রী পেল, যিনি অর্থনীতিটা পূর্বসূরীদের চেয়ে অনেকটাই ভালো বোঝেন। তবে অর্থনীতি বোঝা আর বাস্তবে তাকে প্রয়োগ করার মধ্যে বহু যোজন ফারাক রয়েছে। তাই এখনই খুব নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাবে না। আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।

সুনকের প্রধানমন্ত্রী হওয়াকে কেন্দ্র করে আবার পরিচিতিসত্তার রাজনীতির প্রশ্নটাও উঠে এসেছে। একজন অভিবাসী, একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত অথবা একজন সংখ্যালঘু – বিভিন্ন বর্গের মানুষ সুনককে তাঁদের একজন বলে মনে করছেন, সুনক প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় তাঁরা খুশি হয়েছেন। এই আবেগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের উদযাপনের মুহূর্ত তো খুব বেশি আসে না। কিন্তু আমাদের বিষয়টাকে সার্বিকভাবে দেখতে হবে। নতুন প্রধানমন্ত্রী ছাপ ফেলার মত সদর্থক কিছু করবেন, এমনটাই তো প্রত্যাশা। আশা করা যায় সুনক তাঁর পূর্বসূরী ট্রাসের মত এমন কিছু করবেন না, যা দেশের অর্থনীতিকে আরও বিপন্ন করবে। মনে রাখা দরকার, ট্রাসের প্রধানমন্ত্রিত্ব লাভকে কেন্দ্র করেও কিন্তু বিভিন্ন পরিচিতির মানুষজন আপ্লুত হয়েছিলেন। সেইসময় মহিলা এবং ‘নন-এলিট’ অংশের ক্ষমতায়নের কথাও আলোচিত হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ব্যাপারটা খুব সুবিধার হল না।

ঋষি সুনক কী ধরনের অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করবেন বলে আপনার মনে হয়?

দেখুন, ঋষি সুনক একজন টিপিকাল কনজারভেটিভ রাজনীতিবিদ। সংসদে তাঁর ভূমিকা থেকেই এটা স্পষ্ট। তিনি সবসময়েই দৃঢ়ভাবে নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির পক্ষে সওয়াল করেছেন। সামাজিক সুরক্ষার মত বিষয়গুলোতে সরকারের ভূমিকা আরও কমানোর পক্ষে তিনি। ঋষি সুনক একদিকে যেমন দরিদ্র এবং শারীরিকভাবে অক্ষমদের সামাজিক সুবিধাগুলো খর্ব করার পক্ষে, ঠিক তেমনই কর্পোরেট কর কমানো, ধনীদের উপর করের বোঝা হ্রাস করা, হাউজ অফ লর্ডসে অভিজাত পরিবারগুলোর আধিপত্য বজায় রাখার পক্ষেও দাঁড়িয়েছেন। তিনি দৃঢ়ভাবে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক, কর্মচারীদের অধিকার সংকুচিত করার পক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন। পরিবেশ সংক্রান্ত বিধিনিষেধগুলো সহজ করতে চেয়েছেন। ঋষি সুনক ব্রেক্সিটের দৃঢ় সমর্থক। তিনি মনে করেন, ইউনাইটেড কিংডমের উচিত ইউরোপের বাকি অংশের থেকে স্বাধীন হওয়া। একইসঙ্গে তিনি আবার স্কটিশ এবং ওয়েলশ সরকারকে ইউনাইটেড কিংডমের ভিতরে বেশি ক্ষমতা দেওয়ার বিরোধী।

তাই আমি মনে করি সুনক এমন একগুচ্ছ নীতি প্রণয়ন করবেন, যেগুলোকে আমরা পরস্পরবিরোধী বলতে বাধ্য হব। তবে এটা ব্যক্তি সুনকের দায় নয়। এলিট কনজারভেটিভ পার্টির রাজনৈতিক দর্শন অনুযায়ীই চলবেন নতুন প্রধানমন্ত্রী।

আপনার কি মনে হয় ঋষি সুনক ব্রিটেনের অর্থনীতির মোড় ঘোরাতে পারবেন?

প্রথমেই আমাদের একটা কথা স্পষ্ট করে বোঝা উচিত যে ব্রিটিশ অর্থনীতির হাল এখন অত্যন্ত শোচনীয়। পাশাপাশি এটাও আমাদের মেনে নিতে হবে, যে ব্রেক্সিট, করোনা অতিমারী এবং ইউক্রেন যুদ্ধ সত্ত্বেও ঋষি সুনক চ্যান্সেলর (অর্থমন্ত্রী) হিসাবে অর্থনীতিটা খুব খারাপ সামলাননি। যদিও ব্রেক্সিটের একজন বড় সমর্থক হিসাবে অর্থনীতির এই বেহাল দশার জন্য তিনি নিজেও আংশিক দায় এড়াতে পারেন না, তবু অর্থনীতির মৌলিক বিষয়গুলো তিনি অন্য অনেকের চেয়ে ভাল বোঝেন। বরিস জনসনের দাবি মেনে সুনক একগুচ্ছ জনমোহিনী নীতি গ্রহণ করায় সংবাদমাধ্যম দাবি করেছিল ব্রিটেনের অর্থনীতি স্বখাতসলিলে ডুবতে চলেছে। তা কিন্তু হয়নি। ঋষি সুনক পালিয়ে যাননি। অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ার হাত থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করেছেন।

সুনক তাঁর চ্যান্সেলর হিসাবে জেরেমি হান্টের সঙ্গেই কাজ করবেন। তাঁরা দুজনেই এলিটিস্ট, কিন্তু অর্থনীতি নিয়ে তাঁদের কিছু বাস্তববাদী চিন্তাভাবনা রয়েছে। গোটা দেশে জীবনধারণের খরচ বিপুল। আমার মনে হয় এই সংকটকালীন পরিস্থিতিতেও তাঁরা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং সরকারের ঘাটতি কমাতে চেষ্টা করবেন। ইতিমধ্যেই তিনি কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন। এই পদক্ষেপগুলো কী হতে পারে? আমার মতে, সুদের হার আরও বাড়বে, সামাজিক পরিষেবা এবং সুরক্ষা খাতে কোপ পড়বে, কর বাড়বে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, সুনক এমন এক অর্ন্তদ্বন্দ্বে জর্জরিত সরকারকে নেতৃত্ব দিতে চলেছেন, যারা দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। এই সব কড়া পদক্ষেপ সরকার এবং কনজারভেটিভ পার্টির জনপ্রিয়তা আরও কমাবে। সুনকের বিরুদ্ধে তাঁর দলের অন্দরেই বিদ্রোহ হতে পারে। তবে কনজারভেটিভ পার্টির অধিকাংশ সাংসদ জানেন, অর্ন্তবর্তীকালীন নির্বাচন হলে নিজেদের আসন ধরে রাখা মুশকিল। হয়ত এই কারণেই সুনক তাঁর নীতিগুলো কিছুটা হলেও প্রয়োগ করতে পারবেন, সাময়িকভাবে অর্থনীতিকে কিছুটা চাঙ্গা করতে পারবেন। তবে দীর্ঘ মেয়াদে আমি তাঁর মধ্যে আশাপ্রদ কিছু দেখছি না।

সুনকের কাছে আপনার ঠিক কী প্রত্যাশা তাহলে?

নতুন প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন করতে পারেন। আমি তিনটে বিষয়ের কথা বলতে চাই।

কর: করের হার যে বাড়বেই তা কার্যত নিশ্চিত। আশা করি করের বোঝা শ্রমজীবী মানুষের উপর খুব বেশি চাপানো হবে না। আমি চাই ধনীদের পাশাপাশি ব্যাঙ্ক এবং কর্পোরেটদের উপর বেশি কর আরোপ করা হোক। ইদানীংকালে খনিজ তেলের কোম্পানিগুলো অনেক লাভ করেছে, তাদেরও করের বোঝা বাড়ুক। তবে বাস্তবে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। সুনক এবং কনজারভেটিভদের ইতিহাস অন্তত তাই বলে।

সামাজিক সুরক্ষা: স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার মত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো থেকে সরকার নজর প্রায় সরিয়েই নিয়েছিল। আমি আশা করব নতুন প্রধানমন্ত্রী অন্যভাবে ভাববেন। বর্তমানে হাসপাতাল এবং স্কুলগুলোতে কর্মীসংখ্যা অত্যন্ত কম। পরিচালনার হালও তথৈবচ। এখনই যদি সরকার নজর না দেয়, তাহলে এই দুটো ক্ষেত্র আগামীদিনে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়বে।

ব্রেক্সিট এবং আর্ন্তজাতিক বাণিজ্য: আমি জানি যে এটা দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার, এখনই কিছু হওয়া সম্ভব নয়। তবে আমি আশা করব, ব্রেক্সিট যে ভুল ছিল সরকার তা উপলব্ধি করবে এবং বাকি ইউরোপের সঙ্গে দ্রুত অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলবে। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি হওয়াটাও জরুরি এবং তাতে দুই দেশেরই লাভ। তবে আবারও বলছি, সুনকের তীব্র অভিবাসনবিরোধী অবস্থান আমাকে খুব বেশি আশাবাদী হতে দিচ্ছে না। সুয়েলা ব্র্যাভারমন কদিন আগেই ভারতীয় অভিবাসীদের বিরুদ্ধে প্রায় যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। বলেছিলেন তিনি আর কোনো ভারতীয় অভিবাসীকে ব্রিটেনে ঢুকতে দিতে চান না। সুনক তাঁকেই হোম সেক্রেটারির দায়িত্ব দেওয়ায় আমার সংশয় আরও তীব্র হয়েছে।

সুনকের প্রধানমন্ত্রিত্বকে দক্ষিণ এশীয়রা কীভাবে দেখছেন?

সব দক্ষিণ এশীয়র কথা আমি বলতে পারব না। তবে ধনী ভারতীয় হিন্দুদের একাংশ সুনক প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় অত্যন্ত উৎফুল্ল। তাঁরা এর মধ্যে নিজেদের ধর্মীয় এবং জাতিগত পরিচিতির উত্থান দেখতে পাচ্ছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন স্বামী বিবেকানন্দের নামের বিকৃত উচ্চারণ করেছিলেন, তখনো এই ধনী ভারতীয় হিন্দুদের একাংশ উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। কেউ এসবে খুশি হতেই পারেন, তবে ব্রিটেন বা ভারত কোনো দেশেরই অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

সুনকের ব্যক্তিগত সাফল্যের জন্য কি ভারত লাভবান হবে?

আদপেই নয়। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন প্রধানমন্ত্রী খুব বেশি হলে যা করতে পারেন তা হল নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়া। কিন্তু তিনি তা করবেন না। অন্য ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের মতই তিনি নিজেকে প্রবল দেশপ্রেমিক ব্রিটিশ প্রমাণের চেষ্টা করবেন। তাঁর ভারতীয় মূলকে যেন ছাপিয়ে ওঠে দেশপ্রেমিক ব্রিটিশ পরিচয় – এই হবে তাঁর চেষ্টা। টিপিকাল কনজারভেটিভ ভোটব্যাঙ্ক রক্ষা করতে এটা তাঁকে করতেই হবে। তাঁর সহকর্মী প্রীতি প্যাটেল বা ব্রেভারমানের মতই তিনিও যথাসম্ভব চেষ্টা করবেন ব্রিটেনে ভারতীয়দের আসা কমাতে। ভারতের শাসকরাও সুনকের এই বাধ্যবাধকতা বুঝবেন বলেই মনে হয়।

এতদিন পর্যন্ত সুনক যে সব অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করেছেন, তার সদর্থক এবং নঞর্থক দিকগুলো যদি সংক্ষেপে বলেন…

আমার মনে হয় ঋষি সুনকের কিছু অর্থনৈতিক পদক্ষেপ বেশ সদর্থক। যদিও সেগুলিকে পুরোপুরি ওঁর পদক্ষেপ বলা মুশকিল।।

করোনার সময়ে যাতে মানুষকে চাকরি না হারাতে হয়, সে বিষয়ে তিনি উদ্যোগ নিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের ঋণের ব্যবস্থা করেছেন। এনার্জি বিলের উপর ভ্যাট তুলে দিতে চেয়েছেন, দরিদ্রদের জীবনধারণের জন্য কিছু সাহায্যের ব্যবস্থা করেছেন। ব্রেক্সিট সুনকের অত্যন্ত খারাপ পদক্ষেপগুলোর একটা। কোভিডের সময় “eat out to help out” নীতি নিয়েছিলেন, যা কিনা অতিমারী আরও ছড়িয়ে দিয়েছিল। পরিবেশের প্রশ্নে তিনি দুই নৌকায় পা দিয়ে চলেছেন। অভিবাসন নিয়ে তাঁর সব সিদ্ধান্তই গোলমেলে।

ইউক্রেন প্রসঙ্গে সুনকের অবস্থান কী হতে চলেছে?

যে কোনো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকেই ইউক্রেনের পক্ষে এবং রাশিয়ার বিপক্ষে দাঁড়াতে হবে। এটা কেবল ব্রিটেনের রাজনৈতিক-কূটনৈতিক অবস্থানই নয়, দেশের সিংহভাগ মানুষও এটাই চান। বরিস জনসন যে পথে হেঁটেছেন, সুনকও সেই পথেই হাঁটবেন। সেইজন্যই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেই সুনক প্রথম ফোনে কথা বলেছেন জেলেনেস্কির সঙ্গেই।

আরো পড়ুন বরিস বিদায় ও যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ

সুনকের উদ্দেশে কোনো বার্তা দিতে হলে কী বলতেন?

ব্রিটেনের জন্য সময়টা অত্যন্ত কঠিন। ক্ষমতাসীন দল বিপুল ভোটে জিতেছে, কিন্তু সদর্থক কিছু করতে পারেনি। বিরোধীদেরও পর্যাপ্ত শক্তি নেই। সুনকের ভালো কিছু করাটা তাই গোটা দেশের জন্য ভীষণ জরুরি। আমার তরফ থেকে তাঁর জন্য রইল সংশয়ী শুভেচ্ছা।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.