দেবজিৎ ভট্টাচার্য

একদল নারীপুরুষ বাঁদনা পরবে মেতেছে। মহিলাদের পরনে শাড়ি, আঁচল কোমরে গোঁজা। চুলের খোঁপায় অসংখ্য বুনো ফুল আঁটা। পুরুষরা সাধারণত খালি গায়ে কিংবা শার্টপ্যান্ট পরে ধামসা-মাদলে তাল দিচ্ছে। যে যার কোমরে হাত রেখে সমানে নেচে চলেছে।

আমি এখন বসে আছি কলকাতার এক পেল্লাই আবাসনের ফ্ল্যাটের পাঁচ তলার ছাদে। চারপাশে আলোর ঝলকানি। প্রতিটা ফ্ল্যাট বাড়ির গায়ে টুনি বালব লাগানো। ফ্ল্যাটবাড়ির টুনি বালবের আলোয় পাশের ছোট ছোট বাড়িগুলোকে বড়ই অসহায় দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে তারা যেন কেমন গুম মেরে বসে রয়েছে। ছাদ থেকে নিচের দিকে তাকালেই দেখা যাচ্ছে শহরের ছেলেমেয়েরা পশ্চিমি পোষাক পরে, ডিজে গানের তালে কোমর দুলিয়ে কালীঠাকুর আনতে চলেছে দলে দলে। কিছুক্ষণের মধ্যে চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল এমনই পাঁচ-ছটা ম্যাটাডোর। আগামীকাল কালীপুজো। প্রতিবারের মত এবারও কলকাতা মেতেছে নিজস্ব ঢঙে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

ঠিক এইসময় পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম, ঝাড়গ্রামের আদিবাসী জনজাতির মানুষও মাতেন বাঁদনা পরবে। মাতেন ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড় অঞ্চলের আদিবাসীরাও। দেশের ৮৭% কৃষিজীবি আদিবাসীর কাছে এই পরব খুবই আদরের। এ তাঁদের ধর্মীয় সংস্কৃতি নয়, রুজিরুটি জোগানের সংস্কৃতি। তাঁরা কৃষিকাজের জন্যই বহুকাল ধরে এই পরব পালন করে আসছেন। গঙ্গা দিয়ে আদিবাসীদের হিন্দুতে পরিণত করার বহু জল বয়ে গেলেও এই উৎসব বন্ধ করা যায়নি কখনোই। শুধু কিছু হিন্দুত্ববাদী সংস্কার করতে পারা গেছে বলা চলে। পশ্চিমবঙ্গে এই উৎসব গ্রামবাংলার অন্যতম বৃহৎ লোকোৎসব হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিল একসময়। যদিও দেশি-বিদেশি বড় ব্যবসাদারদের পক্ষে দাঁড়ানো সরকারগুলোর ইচ্ছাকৃত অবহেলায় তা দিন দিন লোপ পেয়ে চলেছে। সংবাদমাধ্যমগুলোও এই উৎসব থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছে।

কালীপুজোর অমাবস্যার দিনই আদিবাসীরা বাঁদনা পরব পালন করে থাকেন। নতুন করে চাষের মরসুম শুরু হওয়ার পর মূলত কৃষিকাজে ব্যবহৃত বলদ, মহিষকে পুজো করতেই কুর্মি জনজাতির মানুষ এই উৎসব শুরু করেছিলেন বহুকাল আগে। তারপর ধীরে ধীরে তা বাকিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। কৃষিজীবী কুর্মিরা প্রধানত বনের হিংস্র পশুর হাত থেকে বলদ, গরু, মহিষসহ বিভিন্ন গবাদি পশুকে রক্ষা করতেই এই উৎসব চালু করেছিলেন।

“গাইকা পুতা ভালা সিসু বালক গও, মহিসেক পুতা ডামাল; (অরে) বাঘেক পুতা ভালা দমে বলিমান গও, রগদাই ধরত্র ধেনু গাই” – এই প্রাচীন সহরই (বাঁদনা) গীতটি নাকি তারই প্রমাণ, এমনটাই বলেছেন আদিবাসীদের নিয়ে গবেষণা করা পণ্ডিতরা।

ঠেকায় পড়ে মাথা খাটিয়ে কুর্মি জনজাতির মানুষ উপলব্ধি করেছিলেন তাঁদের পক্ষে বনের হিংস্র পশুর হাত থেকে গবাদি পশু রক্ষা করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। তাই গবাদী পশুগুলোর মধ্যে থেকে সবথেকে বলবান অংশকে (বলদ) একসময় আত্মরক্ষার কসরৎ শেখাতে লাগলেন। এখনো কৃষিজীবী আদিবাসীদের জীবনে বলদ-গাইয়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাদের ব্যবহার করলে কৃষিকাজ তুলনায় সহজ হয়। তাই “গরইআ” বা “গহাইল” পুজোর মাধ্যমে গোধন পুজো করা। অবশ্য এই পুজো আমাদের দুর্গা, কালী কিংবা বাড়ির লক্ষ্মী, গণেশ পুজো করার থেকে একেবারে আলাদা। এই সংস্কৃতিতে পুজোর কোনো কঠিন মন্ত্র নেই, বিশেষ পূজারী নেই। সবাই মনে মনে বলতে থাকে গবাদী পশুর (গোধন) উদ্দেশে – “সুস্থ নিরোগ থাকো। দুধ ঘি দাও, গোবর সার দাও। হাল টান গাড়ি টান গতর লাগাই। হামদিককে বাঁচাই রাখো।” এই পুজোতে ব্যবহার করা হয় শালুক ফুল আর চালের গুঁড়ো। জলছাড়া দুধে গুলে বাড়িতে তৈরি বিশুদ্ধ ঘিয়ে ছেঁকে তৈরি করা পিঠেই এই পুজোর প্রসাদ।

বাঁদনার তোড়জোড় শুরু হয় সাধারণত আদিবাসী সমাজে হুদুড় দুর্গা স্মরণসভার পর থেকেই। মূল উৎসব শুরু হয় কালীপুজোর অমাবস্যার চারদিন আগে থেকে। পাঁচদিন ধরে চলে এই উৎসব। প্রথম দিন ঘর ও আশপাশ পরিষ্কার করে আলপনা দিয়ে সাজানো হয়। দ্বিতীয় দিন সবাই মিলেমিশে মাংস রেঁধে খান। তৃতীয় দিন গরুকে ভালো করে স্নান করিয়ে শিংয়ে সর্ষের তেল মাখিয়ে শিং ভর্তি সিঁদুর তিলক লাগিয়ে সারা গায়ে রং দিয়ে টোটেমের চিহ্ন এঁকে দেওয়া হয়। চতুর্থ দিন দুই শিং বরাবর ধানের শিষের মোড় (মুকুট) পরিয়ে, গলায় বুনো ফুলের মালা চড়িয়ে সপরিবারে গায়ে গায়ে গরু চুমানো (ঘোরানো) এবং পুজো করা হয়। পঞ্চম অর্থাৎ শেষ দিনের মাথায় অমাবস্যার নিঝুম কালো রাতে গ্রাম কে গ্রাম জেগে থাকে। গরুর সেবায় রাত কাটাতে আলাদা আলাদা দল ভাগ করে ‘ধাঙাইড়া’ (যারা গরুর সেবা করে) বের হয় গ্রামে গ্রামে। তারা বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে সহবত গীত গাইতে থাকে প্রত্যেক কৃষকের বাড়িতে ঢুকে। সঙ্গে থাকে ঢোল, ধামসা, মাদল, করতাল, সহনাই, পেঁপতি, টিনভাঙা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র। গহাইলের সামনে গীত গাওয়ার শেষ শব্দ উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে সকলে “কুলকুলি”(ঠোঁট ও হাতের তালুর আওয়াজ মিলিয়ে চিৎকার) দেয়। সব বাদ্য একসাথে “গিজগিজ গিজিং গিজিগিন, গোজাক গোজাক গিজিগিন” বাজতে থাকে। এই বোল বাজে পুনরায় গীত শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত। চারপাশ আলোকিত রাখতে রাতভোর জ্বলে গহাইলে (উঠানের গোয়াল) ঘিয়ের প্রদীপ। পরদিন দুপুরে বুটি বাঁদনা পালনের জন্যে গরুখুঁটা কাড়াখুঁটা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসব পালিত হয় গরুগুলোকে বিশেষভাবে সম্বোধন করতে। সেইসময় বলা হয়, “সুইনেছি ভাদরে কাদনা, আসছে পরব মকর বাঁদনা!”

আরো পড়ুন মাওবাদী দমনের নামে মধ্য ভারতে ঠিক কী চলছে? অতি সাম্প্রতিক ঘটনার প্রিজমে

আদিবাসী সমাজে রাই (মালিক), রইয়া (মালকিন) কৃষিকাজ বরদা বা বলদের সাহায্যে সম্পন্ন করে বলে সহযোগী বরদাকে উৎসাহিত ও সম্মান দিতেই এই পরব পালিত হয়। অর্থাৎ সহরাই বা বাঁদনা পরব আদিবাসী সমাজে পালন করা হয় মূলত উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্ক সমন্বয়ের মান বজায় রাখতে। বরদার মা অর্থাৎ গাইয়ের পুজো হয় জীবন জীবিকা বজায় রাখতে। কারণ গাই ছাড়া বরদা কী করে আসতে পারে? গাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে ‘গরইয়া’ পুজো করা হয়ে থাকে। আদিবাসী শাসন ব্যবস্থায় রাই ও রইয়ার প্রচলন আর্যদের আগমনেরও আগে থেকে।

এই পরবের ১১ পর্ব: (১) তেলদেওয়া, (২) গঠপুজো, (৩) জাগান, (৪) ঝাগড, (৫) গহাল পুজো, (৬) চুমান, (৭) কাঁচিজিওরি, (৮) চৈখপুরা (৯) নিমছান, (১০) গরুখুঁটা, (১১) কাঁটা কাড়হা।

বছর পাঁচেক হল কালীপুজোর আগের কয়েকদিন সোশাল মিডিয়ায় নানারকম বিকল্প বয়ানের বহর দেখা যায়। তার প্রতিবাদও হয়। কিন্তু আদিবাসী জনজাতির মানুষের পরবগুলো নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না।

নিবন্ধকার গণআন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.