সচেতনভাবেই ছোট নিউজ পোর্টাল এবং সামাজিক মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে

দিনটা ২৭ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৩৩। রাইখস্ট্যাগের প্রহরীরা হঠাৎ দেখতে পেলেন লেলিহান শিখা। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল খবর। সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত হলেন অ্যাডলফ হিটলার সহ অন্যান্য নাজি নেতারা। হিটলার ততদিনে তাঁর জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলেছেন। তিনি এসে বললেন, আর কিছু করার নেই, এবার কমিউনিস্টরা সবকিছু শেষ করে দেবে, সুতরাং আর কোন পথ নেই। এবার কমিউনিস্টদের ধংস করাটাই কাজ। যারা নাজিদের সামনে আসবে তাদেরই এবার সরিয়ে দেওয়া হবে। পরের দিন সকালে তৎকালীন জার্মান রাষ্ট্রপতি পল ফন বেনেকেনডর্ফ হিন্ডেনবুর্গকে দিয়ে এক ডিক্রি স্বাক্ষর করানো হল। শুরু হল হিটলারের স্বৈরাচারী শাসন। প্রথমেই জার্মান নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা হল, তারপর তাঁদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করা হল। বলা হল, কী বলবেন আর কী বলবেন না তা নাজি বাহিনীর অনুমোদনসাপেক্ষ। পুলিশকে যে কোন বাড়ি খুঁজে দেশদ্রোহী, অর্থাৎ যারা হিটলারের মতাদর্শে বিশ্বাস করেন না, সেই রকম মানুষ খুঁজে বার করার নির্দেশ দেওয়া হল। এরপর ৫ই মার্চ আবার নির্বাচন ঘোষণা হল। গলি থেকে রাজপথ নাজি পতাকা ও পোস্টারে ছেয়ে গেল। নাজিরা যে ফল আশা করেছিলেন, সেই তুলনায় কিন্তু আশানুরূপ ফল হল না। বামপন্থীরা প্রায় ৩০ শতাংশ ভোট পেলেন। ১৫ই মার্চের মধ্যে প্রায় দশ হাজার কমিউনিস্টকে গ্রেপ্তার করা, তাঁদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করা সব ততদিনে হয়ে গেছে। তারপর তৈরী হল কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, যেখানে হাজার হাজার মানুষকে বন্দী করে রাখার ব্যবস্থা করা হল। এরপর ২৩শে মার্চ, ১৯৩৩ সালেই আবার রাইখস্ট্যাগ বসে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, কোন বিরোধী মতকে আর সহ্য করা হবে না। পরের চার বছরে যে কোন আইন পাশ করাতে হলে আর রাইখস্ট্যাগ বা রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন থাকবে না, এই নিয়ম চালু করা হয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। হিটলার তাঁর বক্তৃতায় বলেন, যুদ্ধ এবং শান্তির মধ্যে কোন একটা পক্ষ বেছে নিতে হবে জার্মানদের। তারপর শুরু হয় নাজি মতাদর্শে জার্মানদের দীক্ষিত করার প্রক্রিয়া। সরকারী চাকরিতে যত ইহুদি এবং বিরোধী মতাবলম্বী মানুষ ছিলেন তাঁদের বরখাস্ত করা হয়। নতুন শ্রম আইন পাশ করে কলকারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সংগঠিত করতে না পারার বন্দোবস্ত করা হয়। সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। জার্মানিতে থাকে শুধু নাজি পার্টি। অ- জার্মান লেখকদের বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে অনেকে ভেবেছিলেন কেবল রাজনৈতিক বিরোধীদেরই আক্রমণ করা হবে। তাই তখনো ইহুদিরা নাজিদের এই কর্মকান্ডের বিরোধিতা করেননি। তারপর ইহুদিদের জিনিষপত্র বয়কটের হুমকি দেওয়া শুরু হয়, যার শেষ পরিণতি হলোকস্ট।

এ তো গেল অন্য দেশের কথা। এবার আসা যাক নিজের দেশের বিষয়ে। ঘটনাচক্রে এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সরকার যে নতুন আইন আনতে চলেছে, তার সঙ্গে খুব বেশী তফাৎ নেই উপরের ইতিহাসের। মূলধারার গণমাধ্যমকে এমনিতেই এই মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণ করছে কেন্দ্রীয় সরকার। কী খবর দেখানো হবে, কী দেখানো হবে না — সবই বলে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। সংবাদমাধ্যমের মালিকরা তার কথাতেই ওঠে বসে। ফলে বিরোধীদের আন্দোলন আমি, আপনি কমই দেখতে কম পাই। অঘোষিত জরুরী অবস্থা চলছে। সেই জন্যেই যে কোন ছোট বড় আন্দোলন, যা কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে হচ্ছে, তার প্রচারের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে সোশাল মিডিয়া বা সামাজিক মাধ্যম। গত তিন মাস ধরে চলে আসা কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্যি। মূলধারার গণমাধ্যমে কিন্তু খবর হয়নি যে এই অবস্থান বিক্ষোভে এখনো অবধি প্রায় ২০০ জন মানুষ মারা গেছেন প্রবল শীতে। কিন্তু আমরা জেনেছি, এবং তার বহিঃপ্রকাশও দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন রাজ্যে কৃষকেরা সংগঠিত হচ্ছেন। যার ফলে শাসক ভয় পাচ্ছে, আর তার ফল পাঞ্জাবের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপির ধুয়ে মুছে যাওয়া। আজকের দিনে কোন ঘটনাই চেপে রাখা যায় না। তাই শাসককে এই নতুন আইন আনতে হচ্ছে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

বলা হয়েছে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে নাকি এই আইন অত্যন্ত জরুরী। দেশের ভিতরে কারা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন তাঁদের চিহ্নিত করা জরুরী। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে কিছুদিন আগেই স্বেচ্ছাসেবক চাওয়া হয়েছে, যারা চিহ্নিত করবে কারা দেশের বিরুদ্ধে কথা বলছে, অর্থাৎ কারা দেশদ্রোহী। ঠিক ১৯৩৩ সালে যা হয়েছিল তারই পুনরাবৃত্তি যেন। বলা হয়েছে যে সচিব পর্যায়ের একজন কাউকে সরকার থেকে বসানো হবে, যার কাছে এই সোশাল মিডিয়া কোম্পানিরা জানাবে দেশবিরোধী কথা লেখার ঘটনা। পরিষ্কার বলা হয়েছে, যদি ট্রাম্পের ক্ষেত্রে ক্যাপিটল হিলের দাঙ্গাকারীদের চিহিত করা যায়, তাহলে আমাদের দেশে কারা লালকেল্লায় জাতীয় পতাকার অবমাননা করেছে বা চক্রান্ত করেছে তাও চিহ্নিত করা প্রয়োজন। অথচ লালকেল্লার যে উদাহরণ মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ দিয়েছেন সেটা কিন্তু মিথ্যে। জাতীয় পতাকার অবমাননা আদৌ হয়নি। যে ব্যক্তি তেরঙ্গার কাছে শিখ ধর্মের পবিত্র পতাকা ঝুলিয়েছে, সে-ও বিজেপিরই ঘনিষ্ঠ। কৃষক আন্দোলনকে কালিমা লিপ্ত করার লক্ষ্যেই তাকে ট্রাক্টর মিছিলের দিন ঐ আন্দোলনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু সেই কথা এড়িয়ে কেন্দ্রীয় সরকার খুব সচেতনভাবেই ছোট নিউজ পোর্টাল এবং সামাজিক মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের কথা বললেন। যাতে ভবিষ্যতে এই দিক দিয়ে আর তাঁদের সরকারের সমালোচনা না হয়। এই ছোট পোর্টালগুলোর খবর বা অভিমত যে মানুষকে প্রভাবিত করছে তা কিন্তু সরকার বেশ বুঝতে পারছে। তাই তারা তাদের বিদেশী পূর্বসুরীর রাস্তাই নিল। সামাজিক মাধ্যম এবং ছোট পোর্টালদেরও পরোক্ষে বার্তা দেওয়া হল, হয় আমাদের হয়ে কথা বলো, না হয় বন্ধ করো। এটা কি ইতিহাসের সেই হিটলারের দেখানো পথেই হাঁটা নয়? এর পর কি আমাদের ভবিতব্য জার্মানির মতো গণহত্যা, না গ্যাস চেম্বার? সেই দিকেই কি আমরা এগোচ্ছি? এটাই কি ফ্যাসিবাদ নয়? আমরা কি এখনো বুঝব না? আমরা কি চুপ করে সমস্ত কিছু মেনে নেব? বিপদ বুঝেও আমরা সংগঠিত হয়ে এর প্রতিবাদ করব না? যদি না করি, তাহলে আগামী দিনে এই লেখার লেখক, প্রকাশককেও হয়ত বন্দী হতে হবে।

ছবি ঋণ: Wikimedia

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.