কয়েকদিন আগে হবু শিক্ষকদের আন্দোলন দমন করতে গিয়ে তাঁদের কামড়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল রাজ্য সরকারের অধীনস্থ পুলিসকর্মীদের বিরুদ্ধে। হবু শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চিমটি কাটার অভিযোগও উঠেছে আইনের রক্ষকদের বিরুদ্ধে। এবার সরকারি কর্মচারীদের রাস্তায় ফেলে পেটানোর পাশাপাশি নির্বিচারে ঘুসি মারতে দেখা গেল পুলিসকর্মীদের। এমনকি প্রবীণ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মীরাও রেহাই পেলেন না। বকেয়া মহার্ঘ ভাতার দাবিতে বুধবার বিধানসভা অভিযানের ডাক দিয়েছিল রাজ্য সরকারের বেতনভুক এবং পেনশনভুক্ত কর্মচারীদের ৩০টি সংগঠনের যৌথ মঞ্চ। সেখানে বেশকিছু পেনশনার ছিলেন। প্রত্যেকেই বৃদ্ধ, অসুস্থ। তাঁদের উপরেও নির্বিচারে চড়াও হলেন পুলিসকর্মীরা।
আন্দোলন দমনে পুলিসের দুর্ব্যবহার নতুন নয়। প্রতিটি সরকারই পুলিসকর্মীদের ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামলাতে। কিন্তু যাঁরা প্রতিবাদীদের কামড়ে দেন, চিমটি কাটেন, বৃদ্ধ পেনশনভোগীদের ঘুসি মারেন, সরকারি কর্মীদের রাস্তায় ফেলে লাথি মারেন, তাঁরা আদৌ সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন কিনা তা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। পুলিসকে মানবিক হতে হবে – এ দাবি নিঃসন্দেহে ন্যায্য। কিন্তু ভারতীয় নাগরিকদের দুর্ভাগ্য, আমরা এই দাবি করার জায়গায় নেই। এ দেশের পুলিসের কাছে মানবিকতা প্রত্যাশা করা আর ভারতীয় ফুটবল দলের কাছে বিশ্বকাপ খেলার দাবি তোলা প্রায় একইরকম মূঢ়তা। কিন্তু সরকারের যাতে মুখ না পোড়ে, লালবাজার বা ভবানী ভবন যাতে অস্বস্তিতে না পড়ে, সেটুকু নিশ্চিত করতে তো সচেষ্ট হতেই পারেন পুলিসকর্মীরা। আঁচড়ে, কামড়ে, ঘুসি মেরে, চিমটি কেটে আন্দোলন দমন করার নামে তাঁরা তো কার্যত রাজ্য সরকারকেই বেআব্রু করে দিচ্ছেন।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিপুল খরচ করে পুরীর আদলে মন্দির তৈরি করতে পারে। বারাণসীর গঙ্গারতির মত ধর্মীয় অনুষ্ঠান কলকাতায় করার উদ্যোগ নিতে পারে। খেলা, মেলা, বিভিন্ন উৎসবে কোটি কোটি টাকা খরচ করতে পারে। কিন্তু সরকারি কর্মীদের বকেয়া মহার্ঘ ভাতা মেটাতে পারে না। একদিকে রাস্তার আন্দোলনে পুলিস লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে বারবার আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছে সরকার, যাতে ডিএ দিতে না হয়।
প্রাপ্য ডিএ নিয়ে এই টালবাহানার প্রতিবাদেই বুধবার পথে নেমেছিল সরকারি কর্মীদের যৌথ মঞ্চ। জমায়েত ছিল ধর্মতলায়, রানী রাসমণি রোডে। উদ্দেশ্য ছিল বিধানসভার সামনে গিয়ে নিজেদের দাবিদাওয়া তুলে ধরা। রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছিলেন সরকারি কর্মীরা, ছিলেন প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক-শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মীরা। নিজেদের বেশকিছু দাবিদাওয়ার পাশাপাশি অনুজদের পাশে দাঁড়াতে হাজির হয়েছিলেন বৃদ্ধ পেনশনভোগীরাও। শান্তিপূর্ণ মিছিল কয়েক পা এগোতেই রুদ্রমূর্তি ধরে পুলিস। দফায় দফায় আক্রমণ করা হয় সররকারি কর্মীদের। ধর্মতলা থেকে বিধানসভা যাওয়ার রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় ব্যারিকেড তোলা হয়। কিন্তু এত কিছু করেও আন্দোলনকারীদের দমানো যায়নি। তাঁদের একাংশ বিধানসভার সামনে পৌঁছে যান, স্লোগান দিয়ে বকেয়া ডিএ দাবি করতে থাকেন। এই ছিল তাঁদের অপরাধ।
সরকারি কর্মীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিস। নির্বিচারে পেটে, মুখে লাথি ও ঘুসি মারা হয়। অনেকে রক্তাক্ত হন। সেই অবস্থাতেই আটক করা হয় তাঁদের। পুলিসকর্তারা জানিয়েছেন, ৪৬ জন আন্দোলনকারী গ্রেফতার হয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট ধারায় মামলা রুজু হবে। পুলিস যে ঘুসি মারছে, সংবাদমাধ্যমের ভিডিওতে তা স্পষ্ট দেখা গিয়েছে। এই প্রসঙ্গে কলকাতা পুলিসের যুগ্ম কমিশনার (সদর) শুভঙ্কর সিনহার সংক্ষিপ্ত জবাব, বিষয়টি তাঁরা “দেখবেন”।
পুলিস যে ঠিক কেমন করে এই বিষয়গুলি ‘দেখে’, তা বাংলার মানুষের অজানা নয়। দু সপ্তাহ আগে ক্যামাক স্ট্রিটে যে পুলিসকর্মীরা চাকরিপ্রার্থীদের কামড়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা বহাল তবিয়তে আছেন। গত সপ্তাহে কালীঘাটে যাঁরা আপার প্রাইমারির চাকরিপ্রার্থীদের চিমটি কেটেছিলেন, তাঁদেরও কিছুই হয়নি। সমস্যা হল, পুলিসের উপর সাধারণ মানুষের ভরসা এমনিতেই তলানিতে। আচরণ ক্রমশ দাবাং ছবির চুলবুল পাণ্ডে চরিত্রে সলমন খানের মত হয়ে উঠলে সেটুকুও থাকবে না।
বুধবার যখন বকেয়া ডিএ-র দাবিতে আন্দোলনরত সরকারি কর্মীদের নির্বিচারে পেটানো হচ্ছে, ঠিক তখনই মহার্ঘ ভাতা সংক্রান্ত কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছে রাজ্য সরকার। নবান্নের আইনজীবী শীর্ষ আদালতে দাবি করেছেন, কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের সমান হারে রাজ্য সরকারি কর্মীদের মহার্ঘ ভাতা দিতে গেলে রাজ্যের অর্থভাণ্ডারে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
আরো পড়ুন পুলিসের কি মানবাধিকার নেই নাকি?
যে পুলিসকর্মীরা আন্দোলনকারীদের আঁচড়ে দেন, কামড়ে দেন, ঘুসি বা লাথি মারেন, তাঁদের বেতন দিতে অবশ্য সরকারি অর্থভাণ্ডারের সমস্যা না হলেই বাঁচা যায়।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।