সাম্প্রতিক সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, এ রাজ্যের বেশ বড় সংখ্যার মহিলাকুল মনে করেন, স্বামীর হাতে স্ত্রীদের প্রহৃত হবার যথাযথ এবং যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সারা দেশের ছবিও খুব আলাদা কিছু নয়, বরং কোনও কোনও রাজ্যে এই সংখ্যাটা এ রাজ্যের চেয়ে বেশিই। এ ঘটনায়, বহু মানুষ স্বাভাবিকভাবেই হতাশ–বিরক্ত–বিব্রত–ক্রুদ্ধ। যাঁরা এই প্রহারের সংস্কৃতি–অভ্যাসের পক্ষে, এ কথা ধরেই নেওয়া যায় যে তাঁরা সামাজিক ক্ষমতাচিহ্নকে সম্পর্কচিহ্ন দিয়ে বোঝেন, তাকে শাসনের দায়িত্ব–অধিকারের মধ্যে ফেলেন। যিনি পোষণ করবেন, তিনি শাসন করবেন, যেমনটা সাধারণভাবে ঈশ্বর ও ভক্তের দেয়–গৃহীত সম্পর্কে ঘটে থাকে। ফলে শাসনের অধিকার, আলোচ্য।
পুলিস, সেনাবাহিনী, এঁদের উপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলে, এখন একটা কথা প্রায়শই শোনা যায়, এইসব রক্ষকদের কি মানবাধিকার নেই? এই প্রশ্নটি তোলা হয় এক–একটা তুঙ্গ সময়ে, যখন এ নিয়ে কোনো আলোচনার পরিসর থাকে না, যিনি বা যাঁরা প্রশ্নকর্তা বা কর্ত্রী, তাঁরা যে মুহূর্তে প্রশ্ন করেন, তখন যে পরিসর, তাতে উত্তর চাওয়া হয় হ্যাঁ বা না–তে। ওই মুহূর্তগুলির কারণেই প্রশ্নটি হয়ে ওঠে অতি সংবেদনশীল। এ প্রশ্নটা ওরকম তুঙ্গ মুহূর্তে করার পিছনে একটা রাজনীতি আছে। ওই তুঙ্গ মুহূর্ত, অতি সংবেদনশীল মুহূর্তটি এ প্রশ্নটা করার জন্য বেছে নেওয়া হয়, বা এই প্রশ্নটা করার জন্যই মুহূর্তটাকে এরকম অতি সংবেদনশীল, তুঙ্গস্পর্শী করে তোলা হয়। যাতে এ প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ বা না–তেই দিতে হয়। মানবাধিকার — মানে তো মানবের অধিকার। পুলিস কি মানুষ নয়, সেনারা কি নয় মানব, এ পেশার মানুষের কি খিদে পায় না, এদের কি পরিবার নেই, এদেরও তো বাড়ি ছিল ও রক্তের রং লাল – এরকম একটা যুক্তিবাতাবরণে যে কোনও তার্কিক আলোচনার পরিসর থাকে না, এ কথা যাঁরা ওই তুঙ্গ মুহূর্ত তৈরির পিছনের মাথা, তাঁরা জানেন। এখন মাথার পিছনে মস্তিষ্কহীন অনুসরণকারীর সংখ্যাধিক্য দেখা যায়, ফলে এরকম প্রশ্নমালার ভিড় যত্রতত্র তৈরি হতেই থাকে। এই অনুচ্ছেদের প্রথম বাক্যের যে প্রশ্নটা, তার তো একটা উত্তর দিতে হয়। তাহলে, যদি তুঙ্গ মুহূর্তেই সে প্রশ্ন করা হতে থাকে, এবং উত্তর হ্যাঁ বা না–তে চাওয়া হতে থাকে ক্রমাগত, তাহলে আমাদের আর অপেক্ষা বা উপেক্ষা করা উচিত হবে না। না। এটাই উত্তর। বোল্ড অ্যান্ড বিউটিফুল একটা না।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
পুলিস, যদি শুধু পুলিসকে আলোচনায় আনা হয়, তাহলে পুলিস কী পারে, সাধারণভাবে? পুলিস – মনে রাখতে হবে, সিংহম হতে পারে না, সিম্বা হতে পারে না, সূর্যবংশী হতে পারে না, আব তক ছাপ্পান বলে কলার ওঁচাতে তো পারেই না। এসব, যে যে কারণে হাততালিযোগ্য, সেগুলি সবই আইনবিরুদ্ধ। পুলিসের কাজ, আইনকে রক্ষা করা, নিজের এক্তিয়ারের মধ্যে থেকে। পুলিসের কিছু এক্তিয়ার রয়েছে। পুলিস আইন তৈরি করতে পারে না, পুলিস ন্যায়বিচার দিতে পারে না। পুলিসের কাজ, আইন ও শৃঙ্খলারক্ষা, যে আইনশৃঙ্খলার হিসেব নিকেশ তৈরি করেন আইনপ্রণয়নকারীরা, এবং ন্যায়বিচারের পথে অগ্রসরমান হওয়া, যে বিচার করে থাকে আদালত। উদাহরণ হিসেবে, ১৪৪ ধারা পুলিস প্রয়োগ করতে পারে, সে ধারাভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে, কিন্তু ব্যবস্থা নেবার নামে কাউকে কান ধরে ওঠবোস করাতে পারে না, বা কোনও শাস্তিই দিতে পারে না। শাস্তি দেবার অধিকারী — আদালত। পুলিস আইনভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারে, চার্জশিট দিতে পারে। সব ক্ষেত্রেই, পুলিসের অধিকার এইটুকুই। তার জন্য প্রয়োজনে, পুলিস গ্রেফতার করতে পারে, এমনকী পুলিস তাদের লক–আপেও কাউকে রাখতে পারে, তবে তারও শর্ত রয়েছে। ২৪ ঘন্টার মধ্যে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিকে আদালতে পেশ করতে হয়, এবং বিচারকের আদেশ অনুসারে তৎপরবর্তী বন্দোবস্ত হতে পারে। পুলিস, কোনও ধৃত ব্যক্তিকে লক–আপে মারধর করতে পারে না। ধৃত ব্যক্তির উপর কোনও জোর–জুলুম করতে পারে না। এই সব এবং আরও যেসব না রয়েছে, সেগুলি থেকে বিন্দুমাত্র অতিক্রম করে গেলে তাকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে অভিহিত করা হবে। পুলিস কি তাহলে গুলি চালাতে পারে না? সাধারণভাবে, পুলিসের গুলি চালানোর ক্ষমতা বেশ কিছু শর্ত সাপেক্ষে। সেসব শর্ত লঙ্ঘন করলে তা মানবাধিকার লঙ্ঘন।
কোন সময়ে পুলিস গুলি চালিয়ে কাউকে মেরে ফেলতে পারে? ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৬ নং ধারা (১৯৭৩) যদি লক্ষ্য করা যায়, তার তৃতীয় উপধারা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, যখন অভিযুক্ত ব্যক্তি এমন কোনও অপরাধে অভিযুক্ত যে সে অপরাধের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাবাস বা মৃত্যুদণ্ড, সে ক্ষেত্রে, একমাত্র সে ক্ষেত্রেই পুলিস সে অভিযুক্ত ব্যক্তির উপর এমনভাবে গুলি চালাতে পারে, যাতে ওই অভিযুক্তের মৃত্যু হতে পারে।
“(3) Nothing in this section gives a right to cause the death of a person who is not accused of an offence punishable with death or with imprisonment for life.”
তাছাড়া, মেরে না ফেলার জন্যও পুলিস কি গুলি চালাতে পারে না? পারে। ওই ৪৬ নং ধারার ২ নং উপধারাতেই বলা রয়েছে, কেউ যদি গ্রেফতারি এড়ানোর জন্য জোরাজুরি করেন, তাঁকে গ্রেফতার করার জন্য পুলিস যে কোনও পদ্ধতি নিতে পারে। (2) If such person forcibly resists the endeavour to arrest him, or attempts to evade the arrest, such police officer or other person may use all means necessary to effect the arrest
দুই আর তিন নং উপধারা যখন আলোচনায় চলেই এল, তখন ১ নংটাও একবার সেরে নেওয়া যাক। তাহলে একটু সুবিধেও হবে, আলোচনাটা গড়াতে। পুলিস সাধারণভাবে, গ্রেফতারির সময়ে, হেফাজতে নেবার সময়ে কাউকে স্পর্শও করতে পারে, যদি না যাঁকে হেফাজতে নেওয়া হচ্ছে, তিনি মৌখিকভাবে বা কার্যত সমর্পণ করে দেন। (1) In making an arrest the police officer or other person making the same shall actually touch or confine the body of the person to be arrested, unless there be a submission to the custody by word or action. তবে মহিলা অভিযুক্ত ও পুরুষ পুলিস হলে সে স্পর্শের অধিকারও পুলিসের থাকে না।
এ ছাড়া আরেকটি ক্ষেত্রেও পুলিস কাউকে মেরে ফেলতে পারে, যা আমি–আপনিও পারি। আত্মরক্ষার্থে। এখানে পুলিসের ও সাধারণ নাগরিকের মানবাধিকার সমদর্শী। এরকম মোট ছটি ক্ষেত্রে পুলিস ও সাধারণ মানুষ, উভয়েই কাউকে হত্যা করতে পারেন। যেমন ধর্ষণের উদ্দেশ্যে আক্রান্ত হলে, অস্বাভাবিক যৌনাপরাধের জন্য আক্রান্ত হলে, অপহরণ বা গুমের জন্য আক্রান্ত হলে, প্রভৃতি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, পুলিসের কাছে কেউ আত্মসমর্পণ করলে পুলিসের তাকে স্পর্শ অবধি করার প্রয়োজন নেই, পারে না, পুলিসের গ্রেফতারিতে বাধা না দিলে বা পাল্টা না মারতে গেলে পুলিস গুলি করতে পারে না, পলায়নকারী অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে পুলিস গুলি করতে পারে বটে, তবে সে ক্ষেত্রে সেই অভিযুক্তকে প্রাণে মারার মত করে গুলি করতে পারে যদি সে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ থাকে, যার শাস্তি হতে পারে মৃত্যু। অর্থাৎ, কোনও চুরিতে অভিযুক্ত নাগরিক পুলিসের হাত থেকে পালাতে গেলে পুলিস তাকে গুলি করে মারতে পারে না। আবার কোনও অপরাধ সংঘটিত হতে দেখলেও পুলিস গুলি করতে পারে। যেমন, কোনও হত্যার চেষ্টা সংঘটিত হতে দেখলে, কোনও ধর্ষণের চেষ্টা সংঘটিত হতে দেখলে, পুলিস গুলি চালিয়ে অপরাধীকে মারতে পারে। তবে, পুলিসকে প্রমাণ করতে হবে, ঘটনা সত্যিই এমনই ঘটছিল, যে অপরাধের সাজা হতে পারে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কারণ, ভারতীয় সংবিধানের ২১ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনের যথাযথ প্রয়োগ ব্যতিরেকে কোনও মানুষকে জীবনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
একটা কথা স্পষ্ট। পুলিসের কিছু বিশেষ অধিকার রয়েছে, আইনের রক্ষক হিসেবে। সে অধিকার সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি। সাধারণ মানুষ মানে, পরিভাষায় যাঁদের বলে সিভিলিয়ান। পুলিস, সে সাপেক্ষে, পার্সোনেল। পুলিস পার্সোনেল আর সিভিলিয়ানের অধিকার এক নয়। পুলিস, পুলিস পার্সোনেল হিসেবে অতিরিক্ত ক্ষমতাধারী। অতিরিক্ত ক্ষমতা থাকলে, তা লঙ্ঘনের সম্ভাবনাও অতিরিক্ত। তার চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের একটা পদ্ধতি থাকে, যে কোনও সিভিল সোসাইটিতে। রাজ্যে রাজ্যে মানবাধিকার কমিশন, কেন্দ্রীয় মানবাধিকার কমিশন, এসব চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের পদ্ধতি। ক্ষমতাদণ্ড যাতে সমান থাকে, তার তুল্যমূল্য বিচার ঠিক রাখতে। ফলে, পুলিসকে মনে রাখতে হয় যে তার লক–আপ মানে, তার কাস্টডি। পুলিস, লক–আপে আটক ব্যক্তির কাস্টডিয়ান। কাস্টডিয়ান মাত্র। ফলে, যাঁরা মনে করেন ও বলে থাকেন যে পুলিস লক–আপে নিয়ে গিয়ে দুই থাবড়া দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, তাঁরা আইনভঙ্গের কথা মনে করেন। আইন ভাঙার যাথার্থ্য দিতে থাকেন। আইনভঙ্গকে একটি মান্য পদ্ধতি করে তোলেন। যাঁরা মনে করেন ও বলে থাকেন যে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সমুদ্রের ধারে যাওয়া টুরিস্টদের পুলিস ওঠবোস করিয়ে ছেড়ে দিয়ে একটা দুর্ঘটনা এড়িয়েছে এবং আইন প্রয়োগ না–করে টুরিস্টদেরই উপকার করেছে, তাঁরাও পুলিসের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে চান, আইন–অতিরিক্ত ক্ষমতা।
পুলিসের অধিকার রয়েছে। উর্দি পরিহিত, অন ডিউটি পুলিসের নির্দিষ্ট অধিকার। গ্রেফতারির, প্রসিকিউশনের, চার্জশিট দাখিলের। এসব অধিকার সিভিলিয়ানের নেই। নেই বলেই সাধারণ নাগরিক, সিভিলিয়ান এ প্রেক্ষিতে দুর্বলতর, অরক্ষিত, ভালনারেবল। সে কারণেই সিভিলিয়ানের, সাধারণ নাগরিকের মানবাধিকার।
আরো পড়ুন আশা নিরাশার দোলায় দুলতে থাকে রাজনৈতিক বন্দীরা
যে মনন আগে থেকেই পুলিস পার্সোনেলের হাতে দেওয়া নির্দিষ্ট অধিকারের গণ্ডি ছাপিয়ে আরও অধিকার দিতে চায়, সে মননের সঙ্গে, দাস–প্রভু সম্পর্কের দাস মননের তেমন কোনও ফারাক নেই। শুরুতে উল্লিখিত, স্বামী–প্রহারে স্ত্রী–র সায়ের যে পরিসংখ্যান, নজর করে দেখলে দেখা যাবে তার সঙ্গেও এ মনন সম্পৃক্ত।
স্বামীর প্রহারের অধিকার নেই, আইনগত বা নীতিগতভাবে। পুলিসের মানবাধিকারও সেই আলোকেই দেখতে হবে।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।