স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,
কে বাঁচিতে চায়?
দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে,
কে পরিবে পায়।

রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কবিতাটা পড়েছিলাম স্কুলে। তবে খানিকটা গড়পড়তা পড়ানো, সিলেবাসের চাপ আর খানিকটা অপরিণত চিন্তার দোষে লাইনগুলোর অর্থ সঠিকভাবে বুঝিনি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাটা আর পরীক্ষার জন্য পড়তে হয়নি, তার উপর সাধারণ মানুষের বাড়িতে পেয়াদা ঢুকছে দেখতে দেখতে কবিতাটার অর্থ অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে। তাই বারংবার ভাবি, স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচতে চায়? আমি চাই না, আপনাদের (পাঠক) কথা জানি না, তবে মনে হয় না আপনারাও চাইবেন। ঠিক আমার আপনার মতই তিস্তা শীতলবাদ, মহম্মদ জুবের, সিদ্দিক কাপ্পানরাও চাননি।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

তাহলে তাঁরা আজ পুলিশ হেফাজতের পরাধীনতায় আটকা পড়লেন কেন? উত্তরটা প্রকারান্তরে ঠিক পরের লাইনেই রয়েছে, “দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায়”। অর্থাৎ, সরকারপক্ষের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য দেখাতে যাঁরা সক্ষম, তাঁরাই একমাত্র স্বাধীনতা হীনতায় বাঁচতে চান। একজন দায়িত্ববান নাগরিক হিসাবে, সাংবাদিক হিসাবে, মানবাধিকার কর্মী বা একটা ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে তিস্তা বা জুবেররা চোখ কান বুজে সরকারের অনুগত হয়ে উঠতে পারেননি। সেহেতু যেমন কর্ম তেমনই ফল। তাঁদের স্বাধীন চেতনাকে শায়েস্তা করার পথ নিয়েছে সরকারপক্ষ।

আমিও একজন দায়িত্বশীল, স্বাধীনচেতা নাগরিক হিসাবে পাঠকদের উপর আমার ঠিক-বেঠিকের ধারণা চাপিয়ে না দিয়ে চেষ্টা করব কিছু তথ্যের ভিত্তিতে তাঁদেরই সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিকে খানিকটা এগিয়ে দিতে। তিস্তা একটা গুরুতর অপরাধ করেছেন। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গায় যেসব উচ্চতর প্রশাসনিক কর্তাদের ভূমিকা ছিল, তিনি তাঁদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে শাস্তির দাবি করেছেন, যে তালিকায় নাম ছিল গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এবং এই মুহূর্তে ভারতের দ্বিতীয়বার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। এ হেন অপরাধ যে তাঁকে সরকারপক্ষের কাছে বিরাগভাজন করে তুলবে তা বলাই বাহুল্য।

আর জুবেরের অপরাধ? উনি অল্টনিউজের প্রতিষ্ঠাতা, যারা ভুয়ো খবর যাচাই করে। উপরন্তু সাম্প্রতিককালে হরিদ্বারের ধর্মসভায় তীব্র হেট স্পীচ ফাঁস করতেও তিনি বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৯৮৩ সালে মুক্তি পাওয়া হৃষীকেশ মুখার্জির একটা ছবির শটের স্ক্রিনশট নিজের মন্তব্য সমেত টুইট করার জন্য। তাতে নাকি হিন্দু দেবতাকে অপমান করে ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করা হয়েছে। অথচ সেই টুইটের বক্তব্য হিন্দু দেবতারা নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা। ফিল্মের স্ক্রিনশটের সঙ্গে জুবের লিখেছিলেন ২০১৪ সালের আগে যা হানিমুন হোটেল ছিল, তা এখন হনুমান হোটেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মজার কথা, জুবেরের টুইটটা ২০১৮ সালের আর যে টুইটার হ্যান্ডেল থেকে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল, তা তৈরি হয়েছিল ২০২১ সালে। জুবের গ্রেপ্তার হওয়ার পর আবার দেখা গেছে সেই হ্যান্ডেলের আর কোনো অস্তিত্ব নেই।

বিশ্বের বহু গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিকদের সংগঠন জুবেরের গ্রেপ্তারের তীব্র নিন্দা করে তাঁর মুক্তির দাবি জানিয়েছে। নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী সাংবাদিক মারিয়া রেসাও প্রতিবাদ করেছেন। বিশ্বের নানা প্রান্তের মানবাধিকার কর্মীরা জানিয়েছেন তিস্তার মুক্তি চেয়েছেন, এমনকি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিও গুতিয়েরেজও এ নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু সরকারপক্ষের কি তাতে কিছু এসে যায়?

আরো পড়ুন তীব্র মেরুকরণ হওয়া সমাজে ফ্যাক্ট চেকিং যথেষ্ট নয়: প্রতীক

মনে হয় না। কারণ তাঁদের শাসনকালেই ইউএপিএ-র মত জনবিরোধী আইন আরও কঠোর হয়েছে, বাকস্বাধীনতা বারবার আক্রান্ত হয়েছে, একের পর এক কারারুদ্ধ করা হয়েছে প্রতিবাদীদের। ফাদার স্ট্যান স্বামী থেকে ছাত্রনেতা উমর খালিদ – প্রত্যেকেই সরকারের মানবতাবিরোধী পদক্ষেপের সমালোচনা করে হাজতে দিন কাটাচ্ছেন। অথচ নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে খুনি, দাঙ্গাবাজরা। এমতাবস্থায় তিস্তা বা জুবেরের মত মানুষের হাজতের বাইরে থাকাটাই আশ্চর্যের।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.